সেমন্তী ঘোষের লেখা ‘আমাদের ভাবাবেগ জিন্দাবাদ’ (৯-১১) প্রবন্ধ সম্পর্কে দু’-চার কথা। ১৮৭৫ সালে ‘বন্দে মাতরম্’ কবিতাটি লেখা হয়। ১৮৮২-তে আনন্দমঠ প্রকাশিত হয়। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস স্থাপন হয় এবং কয়েক বছরের মধ্যেই ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনির দ্বারা ভারত একত্রিত হয়ে যায়। ১৮৯৬ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে এই গান গাওয়া হয়েছিল। ইংরেজ সরকার বুঝতে পেরেছিল ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর (১৮৯৪) চার বছর পরই আর ডব্লিউ ফ্রেজ়ার তাঁর গ্রন্থে বঙ্কিমকে ‘হিন্দু রিভাইভালিস্ট’ বলে আখ্যায়িত করেন। বঙ্কিম বিরোধিতার ক্ষেত্রটি আরও মজবুত হয়ে উঠল। বঙ্কিমকে সাম্প্রদায়িক বলতে আর কোনও বাধা থাকল না— কারণ সাহেবরা তো সে কথাই বলেছেন!
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ এবং ব্রাহ্মসমাজ বঙ্কিম বিরোধিতার পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু প্যান-ইসলামিক আন্দোলনের কারণে বঙ্কিম বিরোধিতা ধারাবাহিক ভাবে চলছে। আনন্দমঠ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক কারণে বঙ্কিম বিরোধিতা চলছে। কোথাও এই বিরোধিতা প্রত্যক্ষ ভাবে, আবার কোথাও পরোক্ষ ভাবে চলছে।
ইসলাম ধর্ম এবং প্যান ইসলাম এক নয়, কিন্তু দু’টি বিষয়কে গুলিয়ে দেওয়া হল। ১৮৬০ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে প্যান-ইসলামিক আন্দোলন ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবীদের প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তাঁরা প্যান-ইসলামিক ভাবধারার পক্ষে কলম ধরেন এবং মুসলমান যে আলাদা জাতি, ভাবনাটিকে জোরালো ভাবে প্রচার করতে থাকেন। ঠিক তখন বঙ্কিমচন্দ্র প্রকাশ করলেন আনন্দমঠ। ভারত জুড়ে জাতীয়তাবাদের স্রোত বইতে শুরু করল।
শক্তিশালী ভারত যে প্যান ইসলামের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে— সে কথা বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম উপলব্ধি করেছেন এবং সে কারণে তিনি সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন, ভারতীয়তাবোধ বা জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে সুচিন্তিত মত প্রকাশ করলেন। বঙ্কিমের ধর্ম আলোচনায় ও ধর্ম ব্যাখ্যাতেও হিন্দু ধর্ম মানবধর্মে এবং বিশ্বজনীন ধর্মে রূপান্তরিত। বঙ্কিমচন্দ্র বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আত্মিক যোগগুলিকে তুলে ধরলেন এবং ভারতকে এক সূত্রে বেঁধে দিলেন।
নারায়ণ সাহা, কলকাতা-৮৪
আগেও আক্রান্ত
সেমন্তী ঘোষের ‘আমাদের ভাবাবেগ জিন্দাবাদ’ প্রবন্ধটি প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তিনি পূর্বেও আলোকপাত করেছেন। ‘জনগণমন: একটি গানের অন্তর্ঘাত’ প্রবন্ধে (আলপনা রায়, অমল পাল এবং মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ গ্রন্থে প্রকাশিত, প্রথম প্রকাশ: পৌষ ১৪২১) প্রাবন্ধিকের প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ: “…এমন একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, ১৯৯৩ সালে উত্তরপ্রদেশে ভারতীয় জনতা পার্টির নেত্রী সাধ্বী ঋতাম্ভরা একটি ক্যাসেটে নিজের নানাবিধ অগ্নিবর্ষী বক্তব্য রেকর্ড করে সমর্থকদের মধ্যে বিলি করছিলেন। রেকর্ড করা বক্তব্যের আগাগোড়াই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল জাতীয় সংগীত। সাধ্বীর মত স্পষ্ট। জনগণমন যিনি লিখেছেন, এবং জনগণমন-কে যাঁরা জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারিত করেছেন, তাঁদের বিষয়ে এই হিন্দুত্ববাদী নেত্রী একটিই শব্দ বারবার ব্যবহার করেছেন: ‘গদ্দারি’! অর্থাৎ হিন্দু ভারতের সঙ্গে গদ্দারি করে অহিন্দু ভারতবাসীদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই গানটি লেখা হয় এবং গানটিকে জাতীয় সংগীত করা হয়। এই গানের ইতিহাসের মধ্যে তাই হিন্দুত্ব বর্জন এবং মুসলিম তোষণের ছাপ নাকি স্পষ্ট। অবশ্যই জনগণমন গানটির বিরুদ্ধে এই আক্রমণের মূল হেতু বন্দে মাতরম্। সে গানটির বদলে কেন জনগণমন-কেই জাতীয় সংগীত নির্ধারিত করা হবে, এই ছিল তাঁর বক্তব্য।”
বস্তুত, ২০১৪ সাল, প্রধানমন্ত্রী মোদী ও তাঁর দলের ক্ষমতায় আসার সময় থেকেই ভাবাবেগ, মুক্তচিন্তা, বাক্স্বাধীনতা এই দেশে আক্রান্ত। সাংবাদিক হত্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের সুবিধাবাদী পরিবর্তন, প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক গবেষণাধর্মী বই প্রকাশের উদ্যোগ করেও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে আসার নজির বিস্তৃত!
বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য, শ্রীরামপুর, হুগলি
দুর্ভাগ্যজনক
সেমন্তী ঘোষের প্রবন্ধ ‘আমাদের ভাবাবেগ জিন্দাবাদ’ (৯-১১) তাৎপর্যপূর্ণ এবং অনেক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। প্রবন্ধে লেখা হয়েছে, “ভাগ্যিস এ চিঠি লেখার চার বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছেন! নয়তো ‘কটূক্তির হিল্লোল’-এ আর ‘স্বদেশি হাওয়া’র ঝোড়ো ঝাপটায় বোধ হয় তাঁর শ্বাসরোধ হয়ে যেত।” এই মন্তব্য একটি বীজ থেকে আজ মহীরুহে পরিণত হওয়া এক অকাট্য সত্যকে যেন তুলে ধরে।
প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি ধর্মের আবেগের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের কোনটা উচিত অনুচিত তা নির্ধারিত হবে? এই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশ ভাগের ইতিহাসও। ‘বন্দে মাতরম্’-এর যে স্তবক জাতীয় গান হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে তা আজও যদি ধর্মীয় কারণে গাওয়া না যায়, তাকে কী বলা যাবে, ধর্মনিরপেক্ষতা, না কি ধর্মীয় গোঁড়ামি? কালের আকাশে সেই অপরিচ্ছন্নতায় কি আমাদের কণ্ঠ আজও বাক্রুদ্ধ? যে বীজমন্ত্রে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম-শহিদের রক্তে স্বাধীনতা পেয়েছি তা আজ অস্বীকার করছি, বন্দে মাতরম্-এর ধর্মীয় ব্যাখ্যায়? এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য দেশের পক্ষে আর কী হতে পারে?
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
সমাজ শোধরাক
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে এক জনস্বার্থ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির বিকল্প হিসাবে মারণ ইনজেকশন দেওয়ার প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকার এক হলফনামায় নাকচ করে দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘বিতর্ক স্বাগত’ (২২-১০) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বিরলতম অপরাধেও শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড তথা ফাঁসির ঔচিত্য নিয়ে সামাজিক বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে কিছু কথা।
যখন ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধ ঘটে তখন বৃহত্তর সমাজের পরিসর থেকে অপরাধীর চরম সাজা হিসাবে ফাঁসির দাবি ওঠে। কেউ কেউ তো আবার অপরাধের প্রমাণাদি সংগ্রহ করে আদালতে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর শাস্তি দানের ধৈর্যও ধরতে চান না। তাঁদের দাবি থাকে তৎক্ষণাৎ সম্ভাব্য অপরাধীকে ‘এনকাউন্টার’ করে হত্যা করা হোক। যেন এতেই আক্রান্ত প্রকৃত বিচার পাবে আর জনগণের ক্ষোভেরও হবে নিরসন! কিন্তু অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিতে যে আদৌ অপরাধ কমে না তার বহু নজির আছে। বিশ্বের বহু দেশ থেকে চরম শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের প্রথা উঠেও গিয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী নেপালে পর্যন্ত সাজা হিসাবে ফাঁসিকে রদ করা হয়েছে। এক বার কারও ফাঁসি হয়ে গেলে পরবর্তী তথ্য প্রমাণে আসামিকে নির্দোষ মনে হলেও করার কিছু থাকে না।
এই প্রসঙ্গে ২০০৪ সালে হেতাল পারেখ ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় ১৪ বছর জেলে থাকার পরে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসি নিয়ে বিতর্কটি বহুচর্চিত। মনোবিজ্ঞানীরা কিন্তু বহু দিন ধরে বলে আসছেন কোনও মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। অসুস্থ সমাজ পরিবেশ থেকে যে বিকৃত মানসিকতা তৈরি হয় সেখান থেকেই জঘন্য অপরাধ ঘটে। তাই অপরাধীর চরম শাস্তি চাওয়ার চেয়ে সুস্থ সমাজ তৈরির কাজে ব্রতী হওয়াই বেশি জরুরি নয় কি?
সংবাদে প্রকাশ নেদারল্যান্ডস-এ অপরাধীর অভাবে কর্তৃপক্ষ বহু জেলখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। আর দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে স্থানাভাব হেতু উত্তরোত্তর কারাগারের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে হচ্ছে। আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যহীনতা এবং সুশিক্ষা জন্ম দেয় অপরাধমুক্ত সুস্থ সমাজের। আমাদের দেশে কবে হবে তেমন উন্নত ও সংবেদনশীল সমাজ তৈরির কাজ?
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)