সেমন্তী ঘোষের প্রবন্ধ ‘বাংলা নামে দ্বেষ’ (১০-৮) পড়ে দু’-চার কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। ভাষা, ধর্ম, জাত নিয়ে ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পড়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির একেবারে কোণঠাসা দশা। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, হঠাৎ কেন এতগুলি রাজ্য জুড়ে বাংলার প্রতি, বাঙালির প্রতি এত দ্বেষ, এত অসূয়া, এত ঘৃণা দেখা যাচ্ছে? এর আসল কারণ কী?
কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর তৈরি করা ‘এক দেশ এক নেতা, এক দেশ এক ধর্ম, এক দেশ এক ভাষা, হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান’-এর তত্ত্বই বিষবৃক্ষের মূলে? এই ধারণা প্রতিনিয়ত তৈরি করা হয়েছে এবং হচ্ছে ও তাতে ক্ষণে ক্ষণে বারিসিঞ্চন করা হচ্ছে গত এগারো বছর ধরে, সেই বিষবৃক্ষের ফল এক সময় না এক সময় তো পরিপূর্ণ পক্বতা লাভ করবেই। মুশকিল হল, বহু প্রয়াস সত্ত্বেও বাঙালিদের কিছুতে বাগে আনা যায়নি। এঁরা মাছ-মাংস খাওয়া ছাড়বেন না, হিন্দির দাদাগিরি মেনে নেবেন না, যথেষ্ট পরিমাণে গো-মাতৃভক্ত হতেও পারেন না, এবং সর্বোপরি এঁদের মধ্যে অন্ধভক্তি ও মৌলবাদ তেমন ডালপালা মেলতে পারেনি, যেমনটা মেলতে পেরেছে অন্য বলয়ে। হয়তো, নির্বাচনে বাংলাতে জয়লাভ করতে না পারার ক্ষোভও মিশে আছে এর মধ্যে।
হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত মাতব্বর দলটি ভাষার মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন এনে মানুষের ঐক্যকে খণ্ডিত করার খেলায় মেতেছে। প্রবন্ধকার অত্যন্ত ঠিক ভাবেই অনুধাবন করেছেন যে, বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের শিকড় এমন ভাবে প্রোথিত যে তাকে মূলসমেত উপড়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব। দেখেশুনে তাই মনে হয় সমস্ত সমস্যা ধুলোয় ঠেলে ধর্মীয় বিভাজনকে পাখির চোখ করাই বুঝি একমাত্র সত্য। যদিও, মুখে সমগ্র হিন্দু সুরক্ষা, হিন্দু জাতীয়তাবাদ, হিন্দু সংস্কৃতির কথা বলা দলটির মূল লক্ষ্য হল ব্রাহ্মণ্যবাদকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে হিন্দু নিম্নবর্গীয় মানবাত্মার ঠাঁই নেই। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে প্রান্তবাসী মানুষের উপর অত্যাচারের ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর দিলে তা স্পষ্টই বোঝা যায়। তাই নির্বাচনের সময় মুসলমানের সঙ্গে বিভাজন করে সমগ্র হিন্দু সমাজকে কাছে টানার চেষ্টা করলেও অদূর ভবিষ্যতে এই শাসকপ্রভু হিন্দুধর্মের প্রান্তিক মানুষদেরও স্নেহছায়া থেকে বঞ্চিত করবে বলেই মনে হয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে অনেক বাঙালি হিন্দুর উপর আক্রমণ তারই প্রমাণ।
তাই সমস্ত বাঙালির সতর্ক থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
উলুখাগড়া যেন
সেমন্তী ঘোষের ‘বাংলা নামে দ্বেষ’ প্রবন্ধে এই দেশে বাঙালিদের প্রতি অন্যায় অত্যাচারের বিষয়টি প্রকট হয়েছে। আজ হঠাৎ স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরে প্রধানত বিজেপিশাসিত প্রদেশগুলি, যেমন, হরিয়ানা, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ওড়িশায় বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক, মূলত মুসলমান, যাঁরা নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মালদহ, মুর্শিদাবাদ থেকে গিয়েছেন, প্রামাণ্য কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের নানা ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। এর মূল কারণ শাসক দলের ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান’ এই আগ্রাসী মনোভাব। দেশের অন্যতম ভাষা বাংলাকে দমিয়ে হিন্দির রাজত্বের সম্প্রসারণ করলে পশ্চিমবঙ্গের শাসনদণ্ডও হাতে পাওয়া যাবে— এই বুঝি উদ্দেশ্য।
নাগরিকত্ব নিয়ে বিপদ পশ্চিমবঙ্গবাসী হিন্দু মুসলমান উভয়েরই। এ পুরোপুরিই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের খেলা, সাধারণ বাঙালি নাগরিক এর শিকার হয়ে যাচ্ছেন। রাজ্যের শাসক দলও নানা দুর্নীতির পর বাঙালির অস্মিতাকে হাতিয়ার করেছে, ভোট বৈতরণি পার হওয়ার জন্যে। কেন্দ্র রাজ্য উভয় ক্ষেত্রেই মেরুকরণের রাজনীতির রক্তচক্ষু দেখা যাচ্ছে। তার জন্য সাধারণ বাঙালি নাগরিক কেন নিপীড়নের শিকার হবেন? এই বিষময় রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার। বাঙালি নাগরিক হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই দেশের মাটির সন্তান, তাঁদের শ্রমের ঘামের মর্যাদা দিতে হবে।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
আশা আশঙ্কা
‘বিবিধের মাঝে মহা মিলন’ (১৫-৮) নামে অধ্যাপক সুগত বসুর প্রবন্ধটির শিরোনামেই প্রতিফলিত স্বাধীন ভারতের মূল মন্ত্র ও আদর্শ। এবং দেশ জুড়ে ‘বিবিধতা’ বা বৈচিত্র লোপের দমবন্ধকারী চেষ্টার মাঝে প্রবন্ধকারের এই চিন্তা-ভাবনা একটু স্বস্তির বাতাস বলেই আমার বিশ্বাস।
সংবিধানের ‘প্ৰস্তাবনা’য় ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়’ শব্দটি যোগ করার পরামর্শ দেওয়া ছাড়াও অধ্যাপক বসু প্রসঙ্গের প্রয়োজনে সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাসে ফিরে গিয়েছেন।
আসলে ‘প্রস্তাবনা’ হল সংবিধানের অন্তরাত্মা। আইনগত বিচারে এর বিশেষ মূল্য না থাকলেও এই প্রস্তাবনা-ই হল সংবিধানের নৈতিক ভিত্তি, যাকে সংবিধানের নির্যাস রূপেও দেখা যায়। খ্যাতনামা ইংরেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্নেস্ট বার্কার তাঁর প্রিন্সিপলস অব সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল থিয়োরি-তে প্রস্তাবনা-কে সংবিধানের ‘মূল বক্তব্য’ বলে অভিহিত করেছেন। আবার ধীরেন্দ্রনাথ সেনের মতে প্রস্তাবনা হল নিষ্ঠাপূর্ণ সঙ্কল্প।
তবে, প্রস্তাবনায় উল্লেখ থাকলেই যে সব আদর্শ বা সঙ্কল্পের উপযুক্ত রূপায়ণ সব সময়ের জন্য নিশ্চিত করা যায়, এমনটাও নয়। উল্টো দিকে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত কোনও আদর্শ থেকে রাষ্ট্রকে যদি কখনও বিচ্যুত হতে দেখা যায়, তবে সেই বিচ্যুতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে অন্তত জনমত গড়ে তোলা যায়। তাই, রাষ্ট্রের মধ্যে অতিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার সম্ভাবনার বীজ উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে অধ্যাপক বসু ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়’ শব্দটি ‘প্রস্তাবনা’য় অন্তর্ভুক্তিকরণের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তাকে স্বাগত। এটি কার্যকর করা গেলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ সি কাশ্যপ তাঁর আওয়ার কনস্টিটিউশন বইতে সংবিধানের প্ৰস্তাবনায় যে সব মৌলিক সাংবিধানিক মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে সংবিধান প্রণেতাদের চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে বলে উল্লেখ করেছেন, সেই তালিকায় (সার্বভৌমিকতা, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সাধারণতান্ত্রিক প্রকৃতি, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, ব্যক্তিমর্যাদা এবং জাতির ঐক্য ও সংহতি) ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়তা’ নামে নতুন একটা মূল্যবোধ সংযোজিত হবে।
তবে, এর পরেও আরও কিছু বলার থেকে যায়। যে ভাবে দেশের বৈচিত্র বা বিভিন্নতা মুছে ফেলে ‘এক দেশ এক ভোট’-এর কায়দায় সবাইকে এক ছাঁচে ফেলার কুচেষ্টা চলছে চার দিকে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে ‘বিবিধের মাঝে’ শব্দবন্ধটারই হয়তো আর কোনও গুরুত্ব থাকবে না। তাই ভাবছিলাম, ‘বহুত্ববাদী’ বা ইংরেজিতে ‘প্লুরালিস্ট’ শব্দটা যদি প্রস্তাবনার অন্তর্ভুক্ত করানো যায়, তবে কেমন হয়? দেশের বর্তমান আইনপ্রণেতাদের কাছে এ বিষয়ে এক বারটি ভেবে দেখার অনুরোধ জানালাম।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
বর্জ্য নিয়ে
পূর্ত দফতরের বিজ্ঞাপনী প্রচারে দেখা গেল বৈষম্যের একটি সমার্থক শব্দের ব্যবহার। “ভেদাভেদ থাকুক। মনে নয়— ময়লার বালতিতে।” আমাদের বাড়ির বর্জ্য উৎসেই আলাদা করার সুফলের মধ্যে প্রধান পুনর্ব্যবহারযোগ্য বস্তু চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ার সরলীকরণ, ডাম্পিং গ্রাউন্ড বা ভাগাড়ের উপর অতিরিক্ত বোঝার হ্রাস, পরিবেশ দূষণের লঘূকরণ, পচনশীল জৈব পদার্থের ঠিক প্রক্রিয়াকরণ, এবং ফলস্বরূপ স্বচ্ছ ও স্বাস্থ্যকর অঞ্চলের গঠন। কিন্তু স্বল্প সংখ্যক মানুষই এই দায়িত্ব পালন করেন। শহর, শহরতলির এবং বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে এই পরিবেশবান্ধব বিভেদের বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে তথা বাস্তবায়িত করতে কি বিজ্ঞাপনী চমক যথেষ্ট? না কি কঠোর নিয়ম প্রবর্তন জরুরি?
শুভস্মিত চক্রবর্তী, কলকাতা-৬০
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)