রাতের মন্ট্রিয়েল। দূরে রামধনুর রঙে আলোকিত জাক কার্টিয়ের ব্রিজ।
এপ্রিল ১২।
আমি থাকি কানাডার মন্ট্রিয়েল শহরে। কানাডার সমস্ত করোনা আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ এই শহরের। তবে সরকার থেকে সব রকম পদক্ষেপ করা হচ্ছে যাতে সমস্ত মানুষের পাশে থাকা যায় এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী করোনা আক্রান্ত হন ব্রিটেনে গিয়ে। সেখান থেকে ফিরে তিনি গৃহবন্দি থাকেন ১৪ দিন। তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীও গৃহবন্দি থাকেন স্বেচ্ছায়।
এই শহরে এখনও গণপরিবহণ সচল। স্বাস্থ্যকর্মীদের যাতায়াতের কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত। মানুষজন রাস্তায় বেরোচ্ছেন একা একা হাঁটতে অথবা পোষ্যকে সঙ্গে নিয়ে। মুদিখানার দোকান খোলা আছে। যদিও সেখানে নির্দিষ্ট সংখ্যায় ক্রেতা ঢুকতে পারছেন। বাকিদের বাইরে ৩-৪ ফুট দূরত্ব রেখে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আমার প্রায় দু’বছরের অভিজ্ঞতায় মন্ট্রিয়েলের এ দৃশ্য অভূতপূর্ব।
পরিস্থিতি সম্পর্ক জনগণকে সচেতন করতে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সঙ্গে প্রত্যেকটি প্রভিন্সের প্রধানরা প্রতি দিন বক্তব্য রাখছেন। যাঁরা জীবিকা হারাচ্ছেন বা করোনা সঙ্কটের কারণে কাজ করতে পারছেন না, সরকার থেকে তাঁদের অর্থসাহায্য করা হচ্ছে। আমার মতো অনেকেই এখানে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। এই সময় ভাড়া না পেলে ভাড়াটেদের যাতে বাড়ির মালিকরা উচ্ছেদ করতে না পারেন সে দিকটাও নজর রাখা হচ্ছে। অন্তত এই বিপদের সময় লোকজনের মাথার উপর থেকে ছাদ যাতে চলে না যায় সেটা নিশ্চিত করাই উদ্দেশ্য।
এ বার আমার এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। মার্চের শুরুতে একটি নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছি আমি। যে অফিসে কাজ করি, সেই বাড়ির প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট থেকে আমাদের এক দিন জানানো হয় যে, ওই অফিস বাড়ির তিন জন কর্মচারির করোনার উপসর্গ দেখা গিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অধিকার আইনের জন্য ওঁদের পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। এর পর আমরা সবাই ভয় পেয়ে বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করি। এর প্রায় এক সপ্তাহ বাদে ১৬ মার্চে জানা যায় যে, ওই তিন জনের মধ্যে দু’জনের টেস্ট নেগেটিভ এবং এক জন পজিটিভ। পজিটিভ ভদ্রলোক আবার নিজের পরিচয় প্রকাশের অনুমতিও দেন। তখন দেখি যে ক’জনের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে এক জন এই ভদ্রলোক!
জানার পর থেকে এত দিনে প্রায় তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত। আমার কোনও উপসর্গ নেই। কিন্তু দু’সপ্তাহে এক বার যেটুকু না বেরোলেই নয়, তার বেশি বেরচ্ছি না। জানি সারা ক্ষণ ঘরের মধ্যে থাকতে ভাল লাগেনা। কিন্তু তা না করলে আমি অজান্তেই হয়ত ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারি অন্য কারও মধ্যে। আনন্দের খবর হল, আমার সহকর্মী সেই ভদ্রলোক ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং ঘর থেকে কাজ শুরু করেছেন।
ওষুধের দোকান, মুদিখানা ছাড়া রেস্তরাঁগুলো খোলা আছে। তবে শুধু হোম ডেলিভারির জন্য। মন্ট্রিয়েল যে প্রভিন্সে রয়েছে অর্থাৎ ক্যুবেকে সেখানে সমস্ত নন-ইমার্জেন্সি বিজনেস ৪ মে পর্যন্ত বন্ধ। এখন সরকার আলোচনা শুরু করেছেন কী ভাবে ধাপে ধাপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায়। গ্রীষ্মের সমস্ত বড় উৎসব বাতিল করা হয়েছে ৩১ অগস্ট পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সমাবর্তন-সহ সব ক্লাস বাতিল করেছে। এই সেমিস্টারে পরীক্ষার বদলে পেপার লিখে জমা দিচ্ছেন সব ছাত্রছাত্রীরা। সমস্ত ক্লাস অনলাইনে হচ্ছে। তবে বিমান পরিষেবা এখনও চালু। অন্তর্রাষ্ট্রীয় বিমান তো বটেই, ইউরোপে যাওয়ার টিকিট এখনও পাওয়া যাচ্ছে!
তবে সরকার ও বিরোধী দলগুলি একজোট হয়ে কাজ করছে। যাঁদের দরকার ( কানাডিয়ান অথবা অভিবাসী) সবার কাছে টাকা পৌঁছে দিতে। যাঁরাই ইমার্জেন্সি ফান্ডে আবেদন করবেন, তাঁরা যোগ্য হোক বা না হোক, সরকার তাঁদের সাহায্য এগিয়ে দিচ্ছে। পরের বার ট্যাক্স রিটার্নের সময় সে যোগ্যতা নির্ধারণ হবে।
বিপদের সময় মানুষের পাশে থাকা ও সব রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াই মনুষত্বের অন্যতম পরিচায়ক। পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতাই এই মহামারী থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ।
কুণাল রক্ষিত
মন্ট্রিয়েল, কানাডা
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy