Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Dublin

লকডাউন শেখাল অনেক কিছু

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।

ডাবলিনের রাস্তা শুনশান। —নিজস্ব চিত্র।

ডাবলিনের রাস্তা শুনশান। —নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২০ ১৭:৫১
Share: Save:

গত বছর নভেম্বরে ডাবলিনে এলাম। নতুন দেশ, নতুন জীবনের উত্তেজনায় তখন মন উত্তেজিত। প্রথমেই দেখে অবাক হলাম যে ঠান্ডা আর বৃষ্টির মিশেল শ্লথ করতে পারেনি এখানকার কর্মপ্রাণ মানুষগুলোকে। ডাবলিনের জনসংখ্যার গড় বয়স ২৫ বছর, তাদের উচ্ছল জীবনযাপন আর উদ্দাম নৈশজীবনের এক অন্য রুপকথা চোখের সামনে বাস্তব হয়ে ধরা পড়ল। আমার পড়াশোনা, বড় হয়ে ওঠা শান্তিনিকেতনে। কিন্তু একেবারে অন্য রকম এই মানুষজন, এদের কাজ, উল্লাস, জীবনযাপন এ সব কিছুই বেশ ভাল লাগছিল আমার। মিশে যাচ্ছিলাম এই জীবনস্রোতে। এমন সময় পৃথিবীতে শুরু হল অতিমারির তাণ্ডব। এই ছোট্ট আপনভোলা দেশ সেই চক্রব্যূহ থেকে বাঁচাতে পারল না নিজেকে।

এই দেশে করোনা আক্রান্তের প্রথম খবর আসে ২৯ ফেব্রুয়ারি। সংখ্যাটা বেড়ে চলল ক্রমশ। ডাবলিন তথা আয়ারল্যান্ডবাসী তবু স্বস্তিতে ছিল। কারণ পৃথিবীর মৃত্যু মিছিলের তুলনায় তাদের আক্রান্তের সংখ্যা নগণ্য।

প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকার তৎপরতার সঙ্গে ১৩ই মার্চ আংশিক লকডাউন ঘোষণা করেন। ছুটি হয়ে যায় স্কুল, কলেজ, অফিস। একসঙ্গে মেলামেশা, জটলা— সব বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষা থেকে রাজনীতি, গান থেকে ব্যবসা— বিভিন্ন আলাপ-আলোচনার পীঠস্থান ছিল শতাব্দীপ্রাচীন পাবগুলি। সেখানেও নেমে আসে স্তব্ধতা। কোলাহল মুখর ‘নাইটলাইফ’ যেন থমকে যায় এক ধাক্কায়, চুপ হয়ে যায় মানুষের হতাশা–আনন্দ-উচ্ছ্বাস। প্রশাসন কিন্তু নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েনি কখনও। লকডাউনের জেরে কাজ হারানো মানুষদের কমপক্ষে ৩৫০ ইউরো সাপ্তাহিক ভাতার ব্যবস্থা, তাদের বাড়ি ভাড়ায় ছাড়, গৃহহীনদের জন্য আইসোলেশনের ব্যবস্থা করে দেওয়া ছাড়াও আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে এখানকার সরকার।

আরও পড়ুন: আটকে রয়েছি, আমাদের উদ্ধার করুন

আমার স্বামী ডাবলিনে পোস্টডক্টরাল গবেষক। লকডাউনের জেরে বন্ধ হয়ে যায় গবেষণার কাজও। নিত্যসামগ্রী কীভাবে পাওয়া যাবে তা ভেবে আতঙ্কিত ছিলাম আমিও। কিন্তু সুপারমার্কেট গুলো নিয়মিত স্টক আপডেট করে প্রত্যেকের প্রয়োজন মিটিয়েছে। বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে নিজেরা নিজেদের আইসোলেশনে রেখেছি আমরা। মাসে দুই বার ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোইনি। এই গৃহবন্দী অবস্থায় শিখেছি অনেক কিছু। দেখেছি বাড়ির সামনের গাছটায় কচি পাতার সমারোহ কেমন ঘন হয়ে উঠেছে, নীল আকাশ আর চার পাশের পরিবেশ কতটা সুন্দর— যা আগে ভাবিনি। শিখেছি সঞ্চয়ের মূল্য, সম্পর্ককে আরও আঁকড়ে রাখতে হয় কী ভাবে, কী ভাবে স্বল্পে মেলে বিস্তরের আনন্দ। ছোট্ট ঘরের মধ্যে যে এত ছোট্ট-ছোট্ট অমুল্য মুহূর্ত আছে আগে কখনও ভেবে দেখার সুযোগ মেলেনি। অবসরের জীবন আর প্রকৃতি কী অনবদ্য আনন্দ আনতে পারে আগে বুঝিনি এমন করে। মনে পড়ে গেল আমার শান্তিনিকেতন জীবনের কথা। সেখানেও প্রকৃতি আর মানুষের নির্বিঘ্ন সহবাস।

২৪ মার্চ থেকে লকডাউন জোরাল হল। ওষুধের দোকান, সুপারমার্কেট নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে খোলা যাবে, শরীরচর্চাকে জরুরি পরিষেবার আওতায় রেখে ঠিকানার দুই কিমি পরিধির মধ্যে জীবনযাত্রাকে মেপে দেওয়া হল সুরক্ষার তাগিদে। সেন্ট প্যাট্রিক্স ডে, ঈস্টার ডে-র মতো আবেগের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। বর্তমানে আয়ারল্যান্ডের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯ লক্ষ জনসংখ্যার দেশে ভয়াবহ বলাই যায়। তবে অবাক হতে হয় মানুষের নিয়মানুবর্তিতা দেখে। সরকারের নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এখানকার মানুষ সত্যি সচেতনতার প্রমাণ দিচ্ছে।

আরও পড়ুন: তালাবন্দি জীবনে ঘুমিয়েওছি গ্লাভস-মাস্ক পরে!​

এখানকার গারডা (পুলিশ) একদিকে বয়স্কদের বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে প্রয়োজনীয় সামগ্রী, অন্যদিকে ঘরবন্দি শিশুদের মনোরঞ্জনের দায়িত্বও খুশি মনে পালন করছে মানবিকতার তাগিদে। সরকার আর সাধারণের যৌথ উদ্যোগে এই সমাজ মানবিকতার এক আদর্শ রূপ দেখাল আমায়। আয়ারল্যান্ড সরকারের তত্ত্বাবধানে প্রতি সপ্তাহে দশ হাজারের বেশি টেস্ট হচ্ছে, বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অস্থায়ী টেস্ট সেন্টার খুলেছে, ছাত্র-ছাত্রীরা স্বেচ্ছায় মানুষের সেবায় এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে লকডাউনের সুফল মিলেছে, করোনার দুর্বার গতি রোধ করা গেছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী ভাইরাস এর ‘গ্রোথ রেট’ ৩৩% থেকে কমে ০.৫ ও ০.৮% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা গিয়েছে।

ভাল হয়ে উঠছে এই ছোট্ট দেশ। কেমন আছে আমার দেশ? গণমাধ্যমে দেখি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কর্মকাণ্ড। আর অবাক হয়ে দেখি ডাক্তার, নার্স সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরলস পরিশ্রম। দেখি পুলিশ প্রশাসনের এক অন্য মানবতাবাদী রূপ। মানুষকে বাঁচাতে মানুষের অভ্যাসে কঠিন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যাঁরা তাঁদের ভরসায় আছে আমার প্রিয় মানুষরা।

আয়ারল্যান্ডে বসন্ত এসে গিয়েছে। করোনা যুদ্ধ শেষে এক নতুন জীবনকে উপভোগ করতে এখন সকলে ১৮ই মে তারিখে লক ডাউন উঠে যাওয়ার অপেক্ষায় অধীর। এর পর ধীরে ধীরে প্রয়োজন অনুযায়ী আবার সব স্বাভাবিক হবে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অধিকার পাবে মানুষ। রৌদ্রস্নাত সবুজ প্রাঙ্গণ আর দিগন্ত প্রসারিত নীল ঢেউ যেন শুচি-শুদ্ধ মানুষকে আপন করে নিতে ডাকছে। সে ডাক উপেক্ষা করে কার সাধ্য! আমার দেশেও স্বস্তি ফিরুক, আবার ভিড় জমুক বাজারে, ফুটপাথে। মেঠো ফুটবলে মেতে উঠুক পাড়ার ছেলেগুলো। দশটা-পাঁচটায় বাঁধা পড়ে দম নিক মৃত্যু-ভয় জয় করা মানুষগুলো। নতুন জীবন পাক আমার দেশ আর সবার দেশে নামুক নির্ভীক জীবনযাপনের অবাধ অবসর।

সায়ণী মুখোপাধ্যায়, ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Coronavirus Lockdown Ireland Dublin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE