Advertisement
১২ অক্টোবর ২০২৪
Rogue State

সম্পাদক সমীপেষু: দুর্বৃত্তের কবলে

আসলে ক্ষমতায় থাকার জন্য নাগরিকদের উপর যখন নির্ভর করা যায় না, তখন দুর্বৃত্ত বাহিনীর উপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়।

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:২৬
Share: Save:

স্বাতী ভট্টাচার্য তাঁর ‘আগে নাগরিক, পিছে নেতা’ (২৬-৮) প্রবন্ধে ঠিকই বলেছেন, আমাদের কর্মক্ষেত্র আজ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কবলে। তবে আমাদের মনে হয়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কবলে আজ সব কিছু— শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, সংস্কৃতি। তাই বলা ভাল, আগে নাগরিক, পিছে দুর্বৃত্ত। আসলে ধর্ষণ-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আর্থিক দুর্নীতি, আইন ভেঙে অনৈতিক কাজকর্ম করা, এবং নাগরিকের প্রতিবাদকে দমিয়ে রাখার জন্য ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিছু নেতা-নেত্রী ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে এই জঘন্য ঘটনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, এমন ধারণা প্রবল হচ্ছে। যাঁরা প্রতি দিন টিভি চ্যানেলগুলিতে বসে প্রকারান্তরে দুর্বৃত্তদের সমর্থন করে যাচ্ছেন, তাঁদের দেখে আমরা স্তম্ভিত ও লজ্জিত। বর্তমানে রাজ্যে যে ভাবে নানা ঘটনায় সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, শাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে, তা লজ্জার ও ভয়ের।

আসলে ক্ষমতায় থাকার জন্য নাগরিকদের উপর যখন নির্ভর করা যায় না, তখন দুর্বৃত্ত বাহিনীর উপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়। সে রকম পরিস্থিতিতে কোনও সরকারের পক্ষে দুর্বৃত্তদের দমন করা খুবই কঠিন হয়। কিন্তু যখন গণতন্ত্রের নামে ভোট লুট হয় এবং তার ভিত্তিতে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন দায়বদ্ধতা এসে পড়ে জনগণের প্রতি নয়, লুণ্ঠনকারীদের প্রতি। ফলে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়, শাসক স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। তখনই নেমে আসে চরম সন্ত্রাস, সর্বত্র দুর্বৃত্তদের দাপাদাপি।

তবে বাঘের পিঠে সওয়ার হলে পতন অনিবার্য। শুধু নারী-স্বাধীনতা ও নারীদের মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নই নয়, সামগ্রিক ভাবে সাধারণ নাগরিকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রকে রক্ষা করার আন্দোলনও খুব জরুরি। দীর্ঘ দিন ধরে সেই আন্দোলন স্তিমিত। প্রশাসনিক সন্ত্রাসের কবলে নাগরিক সমাজ ভীত। অনেকে প্রতিবাদী হয়েছেন, অনেকে বিবেকের দংশনে মর্মাহত। সমাজে সৎ নাগরিকরা যখন পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেন, তখন অনাচার বাড়তে বাধ্য। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি যদি মূল্যবোধহীন হয়ে পড়ে, এবং রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা যদি নৈতিকতা বর্জিত হয়ে পড়েন, তা হলে নাগরিক সমাজের দুঃখের অবধি থাকে না।

সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি

সংস্কৃতি নির্মাণ

স্বাতী ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন, ‘সংস্কৃতি সমাজজীবনের গাইড বই’। সংস্কৃতি-মনস্ক, পরিশীলিত বাঙালির কত শতাংশ ‘ধর্ষণ-সংস্কৃতি’ শব্দটা গ্রহণ করতে প্রস্তুত? ধর্ষণের মতো একটা ঘৃণ্য অপরাধ কেমন করে ‘সংস্কৃতি’ শব্দের সঙ্গে সংযোজিত হতে পারে, সেই প্রশ্ন প্রাথমিক ভাবে মনে ঝটকা দিতে পারে। তা কাটিয়ে উঠে ভেবে দেখা দরকার যে, সংস্কৃতির আলো ও অন্ধকার দুই-ই রয়েছে। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধ দিয়ে তৈরি। আমাদের জীবনের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্বন্ধের সূত্র খোঁজা জরুরি। সংস্কৃতির জন্যে জীবন, না কি জীবনের জন্য সংস্কৃতি? কর্তা কে? কোনও সংস্কৃতি যদি সমাজের অর্ধেক মানুষের জীবন, যাপন প্রক্রিয়াকে অবদমিত করতে চায়, তা হলে সেই সংস্কৃতির কর্তৃত্ব কি সমাজ-বান্ধব?

একটা প্রচার আছে, জীবন গড়তে হবে সংস্কৃতি দিয়ে মুড়ে। কিন্তু সংস্কৃতি যদি লিঙ্গবৈষম্যমূলক হয়? সেই অন্ধকার সংস্কৃতি তো আধিপত্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চলতে থাকা প্রথাকে ‘অপরিবর্তনীয়’ বলে দেখাতে চাইবে, পুরুষের আধিপত্য নিশ্চিত করতে চাইবে। সংস্কৃতির নামে আধিপত্যবাদ একটি পরিকল্পিত সমাজ-প্রকল্প। চেতনার এত গভীরে ভাবনাগুলো সঞ্চার করে দেওয়া হয় যে, পুরুষ ও নারী উভয়ের চোখে বৈষম্যটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। মেয়েরাও তখন বলেন, “মেয়েদের একটু মানিয়ে নিতে হয়!”

আন্তোনিয়ো গ্রামশির তত্ত্বে আছে, ক্ষমতার সমকেন্দ্রিক বৃত্তগুলোর মধ্যে, কেন্দ্র থেকে অনেক দূরবর্তী কোনও একটা বৃত্তেও যদি মানুষকে ঢুকিয়ে দিতে পারা যায়, তা হলে অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশ করে, বৃত্তের খোপেই ঘুরতে থাকবে। গ্রামশির তত্ত্বে ‘হেজিমনি’ (আধিপত্য) আর ‘ডমিনেশন’ (কর্তৃত্ব), এই দু’টির মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা আছে। ‘হেজিমনি’-র মাধ্যমে জনগণের সম্মতি সুনিশ্চিত হয়, আর ‘ডমিনেশন’ মানে দাপট দেখিয়ে বশ করা। পুরুষতন্ত্র দুটো কাজই করে সুচারু ভাবে। ছোটবেলা থেকে মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয় নারী-পুরুষের প্রভেদ। বুঝিয়ে দেওয়া হয়, নারী ‘ঘরোয়া’! স্বঘোষিত সমাজ-সংসার রক্ষাকর্তা পুরুষ লিখে চলে ‘লক্ষ্মী মেয়ের পাঁচালি’, নারীর নীতিশিক্ষার জন্য। জেলখানার ঘেরাটোপকে নিরাপত্তা বলে মনে হয়। এমনকি অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও অনেক মেয়ের জীবনকে ‘এয়োস্ত্রী’র বশ্যতার চিহ্ন-লাঞ্ছিত জীবন থেকে মুক্তি দেয় না। বিবাহিত পুরুষের চিহ্ন কিছু আছে কি? কদাচিৎ কোনও প্রতিবাদী এ সব নিয়ে প্রশ্ন তুললে, প্রয়োগ হয় ‘ডমিনেশন’, যা ধর্ষণ-সংস্কৃতি থেকে জন্ম নেয় ।

অ্যারিস্টটলের ‘অর্গ্যানন’-এ বর্ণিত হয়েছে দশটি বিভাগ বা ‘ক্যাটেগরি’। অনেক দার্শনিকই মনে করেন, অ্যারিস্টটলের এই ক্যাটেগরিগুলি সমাজ বোঝার একটি প্রকৃষ্ট উপায়। দশটি ক্যাটেগরির মধ্যে ‘দশা’ ক্যাটেগরিটিকে অ্যারিস্টটলীয় দর্শনে এবং আধুনিককালে সমাজতত্ত্ববিদ মার্সেল মুস-র তত্ত্বে ‘অভ্যাস’ (হ্যাবিটাস) বলা হয়। ‘অভ্যাস’ কী, তা বোঝাতে মুস সংস্কৃতির সেই দিকটিকে নির্দেশ করেছেন যা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ এবং জাতির মননে, এবং তাদের যাপনের দৈনন্দিন অনুশীলনে লক্ষ করা যায়। অভ্যাসের প্রভাবে দৈনন্দিন যাপন প্রতর্কহীন জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে ‘না বলতেই বোঝা’-র পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ‘বলা বাহুল্য’ বা ‘বলার অপেক্ষা রাখে না’ যে আচার-আচরণগুলি, সেগুলি বিনা আলোচনায়, বিনা তর্কে মানুষের চেতনার উপরে চাপিয়ে দেওয়া যায়। এ ভাবে পারিপার্শ্বিক বিশ্বকে অনুভব করার, এবং প্রতিক্রিয়া দেখানোর, একটি নির্দিষ্ট পটভূমি বা ধাঁচা প্রস্তুত করে দেওয়া হয়। এটাই ‘সংস্কৃতি’-র নির্মাণ। ব্যক্তি ও সমাজ সেই সংস্কৃতিতে জারিত হয়ে চাপিয়ে-দেওয়া ভাবনাটাকে ‘নিজের ভাবনা’ বলে বিশ্বাস করতে থাকে।

ঠিক যেমন, মেয়েদের পোশাক, চলাফেরার উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখাটাই আমাদের ‘সংস্কৃতি’। মেয়েদের পক্ষে কী কী ‘স্বাভাবিক’ তার রূপরেখা আমরা বানিয়ে ফেলেছি। রূপরেখা মেনে চলার পরেও যদি সে যৌন হেনস্থার শিকার হয়, তা হলে পরিবারের পক্ষে ‘স্বাভাবিক’ সেটা ধামাচাপা দেওয়া! আবার বিপরীত দিকে পৌরুষের একটা ছবিও আঁকা আছে আমাদের ‘সংস্কৃতি’তে। ছবিটা এতই শক্তপোক্ত যে, অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত কোনও মেয়ে তার বাবা-মায়ের প্রতি সমস্ত কর্তব্য সফল ভাবে পালন করলে, অনেক সময়েই বাবা-মায়ের প্রশংসা বাক্য হয়, “ও তো আমাদের মেয়ে নয়, ও আমাদের ছেলে।” ধর্ষণ-সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে সমাজ-নির্ধারিত বৈষম্যমূলক নীতি নৈতিকতাগুলিকে সচেতন ভাবে একটা একটা করে চিহ্নিত করে বর্জন করা ছাড়া উপায় নেই— “আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে/ ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।”

অনিরুদ্ধ রাহা, কলকাতা-১০

সর্ষের ভূত

‘আগে নাগরিক, পিছে নেতা’ প্রবন্ধের সূত্র ধরে বলা যায়, আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, দেশে ‘জাস্টিস’ অর্থাৎ ন্যায়বিচার বলে আর অবশিষ্ট কিছু নেই। সুস্থ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে নারী-পুরুষের অবদান যেমন আছে, তেমনই রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেও তো অভিযোগ কম নয়— প্রায় ৩০ শতাংশ সাংসদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী-নির্যাতন ছাড়াও বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আছে। অথচ আশ্চর্য এটাই, এঁরাই দেশ চালাচ্ছেন, আইন বানাচ্ছেন, বিল পেশ করছেন সেই বিল আবার সংসদে পাশ হচ্ছে। সত্যিই কী বিচিত্র দেশ আমাদের!

রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE