Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদকীয় সমীপেষু: রোহিঙ্গাদের পাশে

ত্রাস এমন আকার নেয় যে সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করেন, এরা বুঝি কোনও পৌরাণিক নরখাদক। 

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

আলি হোসেন খান-এর ‘তার বেলা?’ (১৬-৯) শীর্ষক চিঠি প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ভারতে আসার অব্যবহিত পরেই কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি ও তাদের ধারক বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সন্ত্রাসবাদী, সমাজবিরোধী এবং দেশের নিরাপত্তার পরিপন্থী তকমা দেন। কেন্দ্রের মদতে পুষ্ট এই ‘post truth’ প্রচার এতই শক্তিশালী হয় যে রোহিঙ্গা বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন স্তরে আলোচনাও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। ত্রাস এমন আকার নেয় যে সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করেন, এরা বুঝি কোনও পৌরাণিক নরখাদক।

খুব সামান্য হলেও আমার সুযোগ হয়েছে অল্প কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে আলাপ করার। হ্যাঁ, আমি নিজের উদ্যোগে ‘দেশ বাঁচাও সামাজিক কমিটি’র শরণার্থী শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গা মানুষদের সঙ্গে দেখা করি, কথা বলি, সময় কাটাই। সেখানে স্বল্প সংস্থানে হুসেন গাজি মহাশয় ও তাঁর সংগঠনের সহকর্মীরা অল্প কিছু পীড়িত, স্ব-দেশ বিতাড়িত মানুষদের মাথার ওপর ছাদ আর পেটে দু’মুঠো ভাত দিতে পেরেছেন। ওঁদের এই অসামান্য মানবিক উদ্যোগকে প্রশ্ন করার অধিকার পত্রলেখক কোথা থেকে পেলেন? কোন সংস্থা কোন বিষয়ে কাজ করবে, তা ঠিক করার আপনি কে? তা হলে তো শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থাকে প্রশ্ন করতে হয়, তাঁরা বৃদ্ধদের নিয়ে কাজ করেন না কেন? কোনও পরিবেশ কর্মীকে কখনও জিজ্ঞেস করেছেন তিনি মানবাধিকার কর্মী নন কেন?

এক কথায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে আজ ‘বিদেশি’ বলে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন নিজের নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বসে, একটুও মানবিক মূল্যবোধ থাকলে পিছন ফিরে দেখতেন, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জনজাতির ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে উদ্বাস্তু মানুষের পুড়ে যাওয়া মনের দগদগে ক্ষত। নিজের জন্মভূমি, কর্মভূমি, নিজের ঘর ছেড়ে রোহিঙ্গারা বেড়াতে বেরোননি ২০১৭ সালে। খোঁজ নিন ওঁরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন কেন? কী তাঁদের অপরাধ? কেন রোহিঙ্গা নিপীড়নকে রাষ্ট্রপুঞ্জ সভ্যতার অন্যতম জঘন্য গণহত্যার তকমা দিয়েছে? মায়ানমার সরকারকে কেন সারা বিশ্ব ধিক্কার জানাচ্ছে, রোহিঙ্গা গণহত্যাকে তুলনা করা হচ্ছে হলোকস্ট-এর সঙ্গে?

রোহিঙ্গা সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমস্যা। লক্ষ লক্ষ মানুষ, অধিকাংশই নারী ও শিশু, মূলত বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশে আশ্রিত। রোহিঙ্গারা আজ ভীত, সন্ত্রস্ত। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের এক শিশুর ভাষায়, “আমার পাড়ার বন্ধুরা কোথায় সব হারিয়ে গিয়েছে। এখানে অনেক আমার বয়েসের বাচ্চা আছে। বন্ধু হয়নি। আমরা খেলতে পারি না তো। কাউকেই বিশ্বাস হয় না। খুব ভয় করে। আমি কি আর কখনও খেলব না?” রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের কাছে বলা কথাগুলি আরও এক বার প্রমাণ করে, যে কোনও রকম বিপর্যয়ে, প্রাকৃতিক হোক বা রাজনৈতিক, শিশুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সব থেকে বেশি। বিনষ্ট হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

এই বিপর্যয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ, বাংলাদেশ-সহ আশ্রয় প্রদানকারী দেশ সমূহ, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অসরকারি সংস্থা তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে আর এই সমস্যা মোকাবিলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠান শুধু জীবনধারণ ও রক্ষার দায়িত্ব নিতে পারে। সংশ্লিষ্ট দেশের সমাজ যদি এই ভীত সন্ত্রস্ত মানুষদের আত্মীকরণ না করে, শুধুই যদি তাদের বহিরাগত বা আশ্রিত মনে করে, তবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষদের, বিশেষত শিশুদের কখনওই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবে না।

গ্লোবাল ইকনমির দাপটে আমরা বিদেশি পণ্যে অভ্যস্ত হচ্ছি অথচ অন্য দেশের পীড়িত, বিতাড়িত মানুষকে পড়শি করে নিতে পারছি না। আসলে আমরা সবাই স্বার্থপর। নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে আঘাত লাগলেই খেপে উঠি। আজ যাদের ভালবাসা দিলে কাল আপনার সঙ্গী হতে পারত, আপনার সঙ্কীর্ণতা, সন্দিগ্ধ চিত্ত ও ঘৃণা তাদের ঠেলে দিতে পারে বিপন্নতার অন্ধকারে।

হতাশ ও বিপন্ন মানুষ যদি তখন হাতে তুলে নেয় প্রতিহিংসার অস্ত্র, তারা সন্ত্রাসবাদী? নিপীড়িত মানুষের হাহাকার, করুণ আকুতি যখন ক্ষমতার প্রাচীর টলাতে ব্যর্থ হয়, তখনই শুরু হয় অধিকার কেড়ে নেওয়ার লড়াই। তখন তারা উগ্রপন্থী? মাথা নুইয়ে ভিক্ষে চাইলে আপনি খুশি। চোখ তুলে তাকালেই ওরা সমাজবিরোধী? ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে এ রকম সব বিপর্যয়েই শকুনের চোখ নিয়ে অপেক্ষা করে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মৌলবাদীরা। ঘৃণার আগুনে জারিয়ে নিয়ে এরা এই বিপন্ন মানুষগুলির মনে সঞ্চার করে প্রতিহিংসার লালসা। অধিকার রক্ষার লড়াইও অনেক সময় উল্টো পথে গমন করে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে হেরে গিয়ে।

অথচ ভেবে দেখলে এই সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিলাম আমি, আপনি উভয়ে মিলে। একটু সহানুভূতি— অর্থ নয়— এদের স্বাভাবিক জীবন দিতে পারত। জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত মানুষ মাত্রেই ফিরে যেতে চায় তার ফেলে আসা ভিটেয়। কে চায় আশ্রিতের জীবন? পরিচিতিহীনতার জীবন? হয়তো কোনও এক নীল ভোরবেলা রোহিঙ্গারাও তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবে। তাদের শস্যশ্যামলা দেশ তাদের নিভৃত আরাম দেবে। তবু তার আগে আসুন ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো, পড়শির মতো মিশি। ওদের মিশিয়ে নিই আমাদের জনজীবনে।

শমীক

কলকাতা-১৪৯

হ্যাঁ, সহমর্মী


আলি হোসেন সাহেব চিঠির শেষ অংশে প্রশ্ন তুলেছেন ‘‘যাঁরা সহমর্মী হয়ে রোহিঙ্গাদের সেবা করছেন তাঁদের কাছে জানতে চাই, তাঁরা অভাবের তাড়নায় জীর্ণ ভূমিপুত্রদের জন্য কতটা করছেন?’’ উত্তরে বলব, আমরা অনেকটাই করছি। নিজের দেশের মানুষের জন্য, তাঁদের কঠিন অবস্থায় পাশে দাঁড়ানোর জন্যে দেশে অসংখ্য কমিটি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা এনজিও রয়েছে। এটা না জানাটা ওঁর অজ্ঞতার পরিচয়। এক দিকে যেমন রয়েছে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ বা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, অন্য দিকে রয়েছে এপিডিআর-এর মতো মানবাধিকার সংগঠন বা প্রতীচী ট্রাস্ট-এর মতো শিক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠন। অভাবী, দুঃস্থ, আশ্রয়হীন বা নিরন্ন মানুষের সেবায় গ্রামেগঞ্জে বা শহরগুলোতে প্রচুর সংগঠন কাজ করছে। আমরা অনেকেই ওই সব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। যেমন সাম্প্রতিক কেরল বন্যায় রাষ্ট্রের পাশাপাশি প্রচুর সংগঠন, এনজিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক মুসলিম সংগঠনও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে কাজ করছে। বরং দেশের জাতীয়তাবাদের ঠিকা নেওয়া আরএসএস-এর মতো সংগঠনের কোনও ভূমিকা চোখে পড়ে না। পক্ষান্তরে ওদের অনেক নেতাকেই বলতে শুনেছি এটা তাদের কুকুর হত্যা বা গোমাংস খাওয়ার ফল।
রোহিঙ্গারা নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, এটা আন্তর্জাতিক ভাবে প্রমাণিত। অসহায়, নিঃস্ব, অত্যাচারিত ও স্বজনহারা রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো মানুষ হিসেবে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের মানবিক দায়িত্ব। অবশ্য এ দায়িত্ব পালন করা যে কোনও মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ বাধ্য করতে পারে না। দেশের বা দেশের বাইরের সব মানুষের বিপদে পাশে থাকাটা মানুষ হিসেবে আমাদের নৈতিক কর্তব্য। এখানে ধর্ম, জাতপাত খোঁজা ঠিক নয়।
এ বার ক্ষুধার তাড়নায় অনেক রোহিঙ্গা হয়তো চুরির আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে, সেটা যেমন অবশ্যই অপরাধ, তেমন দু’একটা ঘটনা শুনে সমগ্র রোহিঙ্গাদের উপর
দোষ চাপিয়ে দেওয়াটাও অপরাধ। আর চাহিদা মতো টাকা বা সাহায্য
না পেলে আমাদের এলাকাতেও অনেক ভিক্ষুক গালিগালাজ বা কটূক্তি করে চলে যায়। আমরা তখন কিছুটা রেগে গেলেও, তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখি।


মোঃ আবুসাঈদ
ভাবতা, মুর্শিদাবাদ

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rohingya Politics International Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE