অলক রায়চৌধুরী ‘আর নতুন গানের চরণধ্বনি?’ শীর্ষক প্রবন্ধে (২৮-২) এই প্রজন্মের নবীন কণ্ঠশিল্পীদের নতুন গান, সৃষ্টিমূলক গান তেমন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না বলে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা যথার্থ। বস্তুত এই প্রজন্মের শিল্পীদের কণ্ঠমাধুর্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও টিভি চ্যানেলে তাঁরা যে ভাবে পুরনো দিনের গানগুলিকেই আঁকড়ে ধরে তাৎক্ষণিক বাজিমাত করতে চাইছেন, সে বিষয়ে তাঁর নিদারুণ খেদও ঝরে পড়েছে রচনাটিতে। বর্তমানে সঙ্গীতপ্রেমীরাও নিতান্ত নিরুপায় হয়ে নতুনের গলায় পুরনো গান শুনেই তৃপ্ত থাকতেবাধ্য হচ্ছেন।
অথচ, এমন একটা সময় ছিল যখন শিল্পীদের নতুন গান শোনার জন্য শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে থাকতেন। বিশেষত শারদোৎসবের প্রাক্কালে প্রকাশিত নতুন গান শোনার জন্য শ্রোতাদের মধ্যে যে উন্মাদনা ছিল, তা আজ আর নেই। হেমন্ত গাইলেন, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ তো মান্না দে গাইলেন, ‘ললিতা গো, ওকে আজ চলে যেতে বল না’। প্রতি বছর এইচএমভি থেকে নতুন গানের রেকর্ড বার হত বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। সেই গান শোনার জন্য দমদমে এইচএমভি-র গেটে ভিড় লেগে থাকত দিনভর। আর এখন? গীতিকার ও সুরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা নতুন কোনও গান শোনাই যায় না। বিভিন্ন চ্যানেলে বিচারকের সামনে সাজগোজ করে এসে তাৎক্ষণিক বাহবা কুড়ানোর জন্য প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন তরুণ শিল্পীরা পরিবেশন করছেন এমন সব গান, কথা ও সুরের অপরূপ মেলবন্ধনে যে গানগুলি এক সময় সঙ্গীতপ্রেমীদের মুখে মুখে ফিরত। সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলে মূলত গণসঙ্গীত গেয়ে প্রভূত প্রশংসা অর্জন করেছেন এক তরুণী শিল্পী। তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু তাঁর মতো শিল্পীরা সৃষ্টিমূলক নতুন গান শ্রোতাদের উপহার দেবেন না কেন? কেন শুধুমাত্র তাঁরা পুরনোকেই আঁকড়ে পড়ে থাকবেন?
এতে ফল হচ্ছে এই যে, শিল্পীরা অর্থ, যশ, খ্যাতি অর্জন করছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে বাংলার সঙ্গীতজগৎ বিন্দুমাত্র সমৃদ্ধ হচ্ছে না। তবে আশায় বাঁচি আমরা। সোনালি দিনের বাংলা গানগুলি আমাদের অমূল্য ও অক্ষয় সম্পদ। সে এক উজ্জ্বল রত্নভান্ডার। অতীতের সেই মায়াময়, প্রাণ ভরানো গানগুলি গেয়ে প্রশংসা ও আনন্দ লাভ চলুক। কিন্তু পাশাপাশি নবীন শিল্পীদের কাছে সঙ্গীতপ্রেমীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ রাখছি, নতুন নতুন গানে আপনারা বাংলা গানের ভান্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সমীর কুমার ঘোষ, কলকাতা-৬৫
শুধুই রাজনীতি
হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে মৃদুমন্দ হিম। একটি ক্লাবের মুক্তমঞ্চ-অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক বিতর্কসভায় দর্শকাসন ভিড়ে ঠাসা। প্রবীণ নবীন বহু মানুষের মাথার সামনে বিরাট সাদা স্ক্রিনে নিয়ন আলোয় জ্বলছে বিতর্কের বিষয়— ‘উন্নয়ন পরম ধর্ম’। দর্শকাসনে উপস্থিত ছিলাম। এই বিতর্কসভায় আলোচনা শোনা অবশ্যই প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তিই মনে করিয়ে দিল আরণ্যক উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবনার স্বীকারোক্তিটি। তিনি লিখছেন, “জগতের যে পথে সভ্য মানুষের চলাচল কম, কত অদ্ভুত জীবনধারার স্রোত আপনমনে উপলবিকীর্ণ অজানা নদীখাত দিয়া ঝিরঝির করিয়া বহিয়া চলে সে পথে, তাহাদের সহিত পরিচয়ের স্মৃতি আজও ভুলিতে পারি নাই।... কিন্তু আমার এ স্মৃতি আনন্দের নয়, দুঃখের। এই স্বচ্ছন্দ প্রকৃতির লীলাভূমি আমার হাতেই বিনষ্ট হইয়াছিল, বনের দেবতারা সেজন্য আমায় কখনো ক্ষমা করিবেননা জানি।”
আমার মনে হয়েছিল বিতর্কসভার বিষয়টিই যেন আলোচিত হয়ে গেল এই কয়েকটি লাইনে। মনে মনে আওড়ালাম একটি প্রশ্ন, “উন্নয়নই কি পরম ধর্ম?” উন্নয়নের আভিধানিক অর্থ ইতিবাচক পরিবর্তন বা বিকাশ। এই বিকাশ আর্থিক, পরিবেশগত, পরিকাঠামোগত অথবা সামাজিক। আবার ‘ধর্ম’ শব্দটির অর্থ ধারণ করা। উন্নয়ন বলতে যে পরিকাঠামোগত পরিবর্তন আমরা বুঝি, তার মধ্যে নাগরিক সুবিধা ও নগরায়ণ শব্দগুলোও জুড়ে যায়। ‘উন্নয়ন’ শব্দটির সঙ্গে ‘উচ্ছেদ’ শব্দটিও আবহমান কাল ধরে সংযুক্ত। খাণ্ডববন দহন পর্ব ভারতের ইতিহাসে অথবা কেবলমাত্র মহাকাব্যেই বর্ণিত শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যের নগর সভ্যতায় রূপান্তর হওয়ার প্রথম আখ্যান।
এই আখ্যানে যে উন্নয়নের কাহিনি পাই, তা কিন্তু অরণ্যের অধিবাসীদের বিকাশের কাহিনি নয়। বরং একটি আঞ্চলিক অধিবাসীদের করুণ নিধনকাহিনি। আজও উন্নয়ন বলতে পরিকাঠামোগত নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে জনজীবনকে উন্নত করার প্রচেষ্টাই বুঝি। এই বিতর্কসভায় সেই প্রচেষ্টাগুলোকেই ধর্ম বলে অভিহিত করবেন মঞ্চে উপস্থিত বক্তারা? এমন প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল। তবে সভার পক্ষে ও বিপক্ষে কেবলমাত্র শাসকগোষ্ঠীর অবদান ও অবহেলা নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকল। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি থেকে আর জি কর কাণ্ডের দ্রোহ, শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির খতিয়ান, বিরোধী নির্যাতন— এই ছিল বিপক্ষ আলোচনার একমাত্র আলোচ্য বিষয়। সঙ্গে যুক্ত ছিল, লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী ইত্যাদি প্রকল্পগুলোকে ভিক্ষা কেন বলব না, কারণ তা সাধারণ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রতিপালিত প্রকল্প। অপর পক্ষে অর্থাৎ ‘উন্নয়ন পরম ধর্ম’-এর সমর্থনে আলোচিত হল ট্যুরিজ়ম, ডেয়ারি ও বিভিন্ন ভান্ডার প্রকল্পে মুখ্যমন্ত্রীর অবদান। দর্শকাসন থেকে যে প্রশ্নগুলো ভেসে এল তাও একই কেন্দ্রে ঘুরপাক খেয়ে ফিরে গেল।
দেশ পত্রিকার এই উদ্যোগ আয়োজন অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে আমাদের সমাজের ভাবনাশূন্যতা ও মঞ্চ পেলেই শাসকের নিন্দা অথবা স্তুতি অর্থাৎ শাসককেন্দ্রিক সমস্ত আলোচনা— এও কি অবক্ষয় নয়? উন্নয়ন বলতে কেবল রাজ্যের পরিসংখ্যান ও ক্ষমতাবানের কাছ থেকে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব?
উন্নয়নের সুফল তো আজকের মোবাইল পরিষেবাও। আমাদের সন্তানরা সেই পরিষেবার ‘জঞ্জাল’ কি বহন করে চলেছে? এই আলোচনাও তো মঞ্চেই উচ্চারিত হওয়ার কথা ছিল। কেন আজকের সন্তানরা মোবাইলের বাইরের পৃথিবীর দিকে এক বার তাকিয়ে দেখে না? কেন আমরাই বা ঝলমলে আকাশটাকে দেখে হঠাৎ অকারণ আনন্দ পাই না?
খুব বলতে ইচ্ছে করে উন্নয়ন-এর আলোচনায় মানুষ কোথায়? আগামী প্রজন্মের কথা কোথায়? উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত উচ্ছেদ, পরিবেশ, মানুষ। আমাদের মতো নাগরিক মানুষ থেকে প্রান্তিক মানুষ, অরণ্যের অধিবাসী সকলেই জড়িত এবং সঙ্গে জড়িত রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি। ধর্ম শব্দটাও কি আজকের সমাজে পূজা, অর্চনা, নামাজ, প্রার্থনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? এই সভায় উন্নয়ন বা ধর্মের সেই দ্যোতনা নিয়ে তো কথা বললেন না বক্তারা! হিম সন্ধ্যায় আমরা ফিরে আসছি ঘরে। সেখানে আগামী প্রজন্ম স্মার্টফোনে ব্যস্ত। উন্নয়ন আমাদের ঘরের ভিতর। উন্নয়ন খবরের পাতায় শাহি কুম্ভ স্নানের বিজ্ঞাপনের পাশে ধর্মপ্রাণ আবেগী মৃত মানুষের পরিসংখ্যানে!
আমাদের মন এখন ভাবনাশূন্য। শাসক নামক অলৌকিক ক্ষমতার দোষ-গুণের প্রদর্শনীতে ব্যাপ্ত।
রিমি মুৎসুদ্দি, কলকাতা-১৪৯
সম্বোধন নিয়ে
বয়স্ক মানুষদের ‘দাদু’, ‘দিদা’ বলে অনেকেই ডাকেন। এই রেওয়াজ দেখা যায় বিভিন্ন হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ঝাঁ-চকচকে বেসরকারি হাসপাতালেও। সম্প্রতি এমনই এক বেসরকারি হাসপাতালে তরুণ স্বাস্থ্যসেবক, সহায়ক প্রমুখ ‘দাদু’ সম্বোধন করায় ঈষৎ অস্বস্তিতে রোগী। তাঁর স্বগতোক্তি, ‘আঙ্কল’, ‘আন্টি’ বললেই হয়! এতে বয়স কমবে কি না, সে প্রশ্ন থাক। কারণ, সেই ইচ্ছা হলে কাকু, জেঠু ডাকার দাবিও তুলতে পারতেন মানুষটি। প্রশ্ন হল, ইংরেজি ভাষা, সংস্কৃতির উপর এই টান কি যাওয়ার নয়?
সুস্মিতা রায়, কলকাতা-১০৭
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)