E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: বাঙালির নিরামিষ

বাংলার সুপ্রাচীন কালের ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে মোহন ভাগবতের এমন অভিমত কতটা সঙ্গতিপূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত?

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৩৭

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের ‘নিরামিষ সাম্রাজ্যবাদ’ (২৩-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে বাঙালির মাছ খাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি আরএসএস-এর সর্বাধিনায়ক মোহন ভাগবতের যৌক্তিক ব্যাখ্যাটি হল, এক সময় বাংলার জলমগ্ন মাটিতে ছোলা, অড়হর ও বিউলির মতো ডাল উৎপাদন হত না বলে শস্য থেকে প্রোটিনের কোনও উৎস ছিল না। সেই কারণেই তাঁদের মধ্যে মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে।

বাংলার সুপ্রাচীন কালের ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে মোহন ভাগবতের এমন অভিমত কতটা সঙ্গতিপূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত? এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ও গবেষক গোলাম মুরশিদ-এর হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বইয়ের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে ‘বাঙালির খাবার’ শীর্ষক বিশ্লেষণটি উল্লেখ্য। তিনি লিখেছেন— চর্যাপদের কয়েকশো বছর পরে লেখা মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে ডালের জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়।… চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের নায়ক কালকেতু সমাজের নীচের তলার মানুষ। তাঁকে জাউ আর ডাল খেয়ে পেট ভরাতে দেখে এটা মনে করাই স্বাভাবিক যে, গরিবদের একটা প্রধান খাদ্য ছিল ডাল। চণ্ডীমঙ্গল ছাড়া মধ্যযুগের সাহিত্যে বেশ কয়েক রকম ডালের উল্লেখ করা হয়েছে— বিশেষ করে ফুটকলাই, মুসুর, মাষ এবং মুগ ডাল। ছোলার ডালের কথাও আছে ।

বাংলার প্রাচীন আমলের খাদ্য সম্ভারে মাছের মতো আমিষ পদ ছাড়াও অন্য খাবারও কতটা পুষ্টিবর্ধক ও উন্নত মানের ছিল, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব গ্রন্থের ‘আহার বিহার’ পরিচ্ছেদে রয়েছে। যেমন— “প্রাকৃতপৈঙ্গল-গ্রন্থেও (চতুর্দশ শতকের শেষাশেষি?) প্রাকৃত বাঙালীর আহার্য দেখিতেছি কলাপাতায়, ‘ওগ্‌গরা ভত্তা গাইক ঘিত্তা’, গো-ঘৃত সহকারে সফেন গরম ভাত। নৈষধচরিতের বর্ণনা বিস্তৃততর: পরিবেশিত অন্ন হইতে ধূম উঠিতেছে, তাহার প্রত্যেকটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আর একটি বিচ্ছিন্ন (ঝর্‌ঝরে ভাত), সে-অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু ও শুভ্রবর্ণ, সরু এবং সৌরভময় (১৬।৬৮)। দুগ্ধ ও অন্নপক্ব পায়সও উচ্চকোটির লোকদের এবং সামাজিক ভোজে অন্যতম প্রিয় ভক্ষ্য ছিল (১৬।৭০)।” তিনি এই প্রামাণিক গ্রন্থের ‘কৃষি ও কৃষিজাত দ্রব্যাদি’ পরিচ্ছেদে সেই কালে বাংলার মাটিতে উৎকৃষ্ট ‘শালিধান্য’ এবং ‘সর্বত্রই প্রচুর ফলশষ্য’ খাদ্যসম্ভারের নিয়মিত উৎপাদনের বিষয়কেও তুলে ধরেছেন।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, নদীমাতৃক বাংলায় বহু যুগ আগে থেকে মাছ খাওয়ার বিশেষ প্রচলন থাকলেও বাঙালি একই সঙ্গে উন্নত মানের বা প্রোটিনযুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত নিরামিষ আহার, যেমন— ডাল, খাঁটি ঘি, দুধ, স্বাদু ফল— এ রকম নানাবিধ সুষম খাদ্যেও পরিপুষ্ট হয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে আরএসএস প্রধানের যুক্তি— অর্থাৎ খাদ্যে প্রোটিনের ঘাটতি পূরণের জন্যই বাঙালি প্রাচীন কাল থেকে মাছ খেতে বাধ্য হয়েছে— তার সারবত্তা কোথায়?

পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি

জরুরি

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের ‘নিরামিষ সাম্রাজ্যবাদ’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, প্রতিটি রাজ্যের বা অঞ্চলের মানুষদের নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস আছে। যে যুক্তিতে আরএসএস প্রধান আমিষের পরিবর্তে নিরামিষের কথা বলেছেন, তার মধ্যে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক মনোভাব পাওয়া যায়। খাদ্যরসিক মানুষদের খাদ্যাভ্যাসের নিয়ন্ত্রক কেবলমাত্র তাঁরা নিজেরাই হতে পারেন। মানুষ কী খাবেন, কেন খাবেন, কখন খাবেন— সেটা তাঁদের নিজস্ব ব্যাপার। খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে পরামর্শ শুধু চিকিৎসকরাই দিতে পারেন।

গর্ভবতী মহিলা এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের অধিক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্যের প্রয়োজন। প্রাণিজ খাবার দুধ, মাছ, ডিম ও মাংস এবং উদ্ভিদজাত ডালের মতো খাবারের মধ্যে প্রোটিন অধিক বর্তমান। এও বলা হচ্ছে, এগুলির মধ্যে সঠিক অনুপাতে অ্যামিনো অ্যাসিড ও প্রচুর পরিমাণে আয়রন আছে। অথচ এ দেশে মিড-ডে মিল থেকে প্রায়শই ডিম বাদ পড়ছে। খাদ্য থেকে আহৃত শক্তির শতকরা ১৪-১৫ ভাগ যে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার আসা উচিত, তা ভারতীয়দের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। তাঁদের নিয়মিত ডালের সঙ্গে মাছ, মাংস বা ডিম খাওয়া উচিত। বিভিন্ন প্রতিবেদন ও সমীক্ষা থেকে নেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মেয়েদের মধ্যে প্রায় ১৯ শতাংশই অপুষ্টিতে ভোগেন, রক্তাল্পতা দেখা যায় অর্ধেকেরও বেশি মেয়েদের মধ্যে। ভারতে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী মায়েদের অপুষ্টি। ডিম, মাছ বা মাংস থেকে যখন অধিক পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায়, তখন অবশ্যই সে খাদ্যের একান্ত প্রয়োজন। আজকের দুর্মূল্যের বাজারে গরিব মানুষের পাতে অন্তত সপ্তাহে এক বা দু’দিনের ডিম কিছুটা হলেও প্রোটিনের অভাব পূরণ করতে সক্ষম।

স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০

শুধুই উস্কানি

‘নিরামিষ সাম্রাজ্যবাদ’ শীর্ষক প্রবন্ধ সম্পর্কে কিছু কথা। সম্প্রতি আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন চাওয়ার যুক্তি আওড়েছেন। তিনি বলেন, ভারতের মতো এক দেশ থেকে কেন কোনও রকম মাংস রফতানি হবে, এই প্রশ্ন সরকারকে করে লাভ নেই। তিনি আরও বলেন, আমিষাশী হিন্দুরাও কিছু নিয়ম মানেন, যেমন মাংস তাঁরা শুধু বুধ ও রবিবারই খান। হিন্দুরা কেউ গোটা শ্রাবণ মাসে মাংস ছোঁন না, কিন্তু যে-হেতু নিয়মিত না হলেও মাংস তাঁরা খান, তাই ভাগবত বলেন আমাদের এই অভ্যাস শোধরাতে হবে। অর্থাৎ, আরএসএস বিজেপি নেতারা ঠিক করে দেবেন কারা কী খাবেন, কী খাবেন না। আরএসএস নেতা গোলওয়ালকর একদা বলেছিলেন— হিন্দুস্থানের সমস্ত অহিন্দু মানুষ হিন্দু ভাষা এবং সংস্কৃতি গ্রহণ করবেন হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা করবেন ও পবিত্র জ্ঞান করবেন। না হলে সম্পূর্ণ ভাবে এই দেশে হিন্দু জাতির অধীনস্থ হয়ে, কোনও দাবি ছাড়া, কোনও সুবিধা ছাড়া, কোনও রকম পক্ষপাতমূলক ব্যবহার ছাড়া, এমনকি নাগরিকত্বের অধিকার ছাড়া থাকতে হবে। (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড, মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর) যাঁরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী নন, তাঁদের হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু ভাষা মানে সংস্কৃতকে মান্য করতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। তাঁরা যদি না করেন তা হলে এ দেশে তাঁদের কোনও অধিকার থাকবে না।

শতপথ ব্রাহ্মণে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের অনুশাসন উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, গরুর মাংস যদি নরম হয় তা হলে তা খাওয়া যেতে পারে। বাল্মিকী রামায়ণে রয়েছে, বনাগমনের পথে রাম-সীতা-লক্ষ্মণ ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে উপস্থিত হলে মুনিবর বৃষ এবং ফলমূল দিয়ে তাঁদের ভোজনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন গোমাংস খাইয়ে অতিথি আপ্যায়ন হত। অর্থাৎ, প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের মধ্যে গোমাংসের প্রচলন ছিল। বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্ম আসার পর প্রাণী-হত্যা বন্ধ হয়ে যায়। তারও পরে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে গোমাংস বন্ধ হয়ে যায়। চাষবাস বা অন্যান্য ব্যবহারিক প্রয়োজনে গোহত্যা বন্ধ করা হয়েছিল। এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে এই সবই মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চাওয়ার চেষ্টা। বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বেহাল দশা নিয়ে কোনও কথা নেই, সমাধান নিয়ে ভাবনা নেই, শুধু উস্কানি বিভেদের, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বাজিমাত করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।

বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া

নামমাত্র

ইপিএফও পেনশন বাড়ানো হয়েছে ২০১৪ সালে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা কেউ পান এক হাজার টাকা, কেউ পান তেরোশো, চোদ্দোশো, বা উনিশশো টাকা। আজকের দিনে এই টাকায় কী হয়? প্রায় আশি লক্ষেরও বেশি মানুষ এই পেনশন পান। ট্রেড ইউনিয়নগুলি হাত গুটিয়ে বসে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

দেবাশিস দাশগুপ্ত, কলকাতা-৩৭

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mohan Bhagwat RSS

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy