Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: বিদ্বেষের চোরাবালি

জাতিবিদ্বেষের চোরাবালিতে কত মেধাবী দলিত তরুণের শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে, তার খবর আমাদের কাছে পৌঁছয় না।

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০০

সমাজ কি দ্রুত পিছনের দিকে ছুটে চলেছে? আমাদের সংবিধান পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী, জাতির মানুষদের শিক্ষা, চাকরি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুযোগ দিয়েছে, যাতে তাঁরাও জীবনের মূলস্রোতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। কিন্তু অবহেলা আজও অব্যাহত। আমরা ২০১৬ সালে দেখেছি দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার (ছবিতে) আত্মহত্যা। তাঁর ‘সুইসাইড নোট’ যেন তথাকথিত ‘ছোট জাত’-এর যন্ত্রণা ও অবিচারের জীবন্ত দলিল। গত বছর মহারাষ্ট্রের এক মেডিক্যাল কলেজের দলিত ছাত্রী পায়েল তাড়ভি আত্মহত্যা করেন। পায়েলকে পদে পদে হেনস্থা করা হয়েছিল শুধুমাত্র তাঁর দলিত পরিচয়ের জন্য। মনে হয়, অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মু, রোহিত ভেমুলা, পায়েল তাড়ভিরা একই সরলরেখায় অবস্থান করছেন, যেখানে সমাজে তাঁদের পরিচয় কেবল এই যে, তাঁরা নিচু জাতের। তাঁদের শিক্ষা, মেধা, পরিশ্রমকে সংরক্ষণের তুলাদণ্ডে মাপার চেষ্টা করে গিয়েছি, আর তাঁদের রক্তাক্ত করেছি সুযোগ বুঝে।

জাতিবিদ্বেষের চোরাবালিতে কত মেধাবী দলিত তরুণের শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে, তার খবর আমাদের কাছে পৌঁছয় না। যাঁরা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে শিক্ষিকার নিগ্রহকারীকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও হয়তো স্বীকার করবেন এই জাতিবিদ্বেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থার জন্য নয়, বরং জাতিবিদ্বেষের জন্যই এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা।

মহম্মদ মগদুম

কালিন্দি, পূর্ব মেদিনীপুর

কেন্দ্র ও প্রান্ত

ছাত্রছাত্রীদের জীবনের তুলনায় এক বছর নষ্ট হওয়ার ভাবনাটা নগণ্য মনে হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেরুনা মুর্মুর। তার প্রেক্ষিতে পারমিতা ঘোষ নামে বেথুন কলেজের এক ছাত্রী বললেন, এই মানসিকতা আসলে কোটা আর কোটা-বহির্ভূতদের তফাত। সমস্যাটা এক বছর বসে থাকার নয়। বরং ‘‘জাতের দৌলতে এগিয়ে আসা কিছু যোগ্যতাহীন অপদার্থর তুলনায় নিজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আজীবন পিছিয়ে যাওয়ার।’’ ওই ছাত্রী আরও লিখেছেন, অধ্যাপকেরা ঘরে বসে বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মতো অনেক ছাত্রের বাবা-মায়েরা রোজ বেরোতে বাধ্য হচ্ছেন, ভাত জোটানোর জন্য। প্রশ্ন তুলেছেন, অভিভাবকদের কিছু হলে এই সন্তানরা সুরক্ষিত থাকবেন তো?

অধ্যাপকের কথার প্রেক্ষিতে আদৌ কি এই বক্তব্য প্রাসঙ্গিক? এক শিক্ষক ছাত্রদের সুস্থ রাখার জন্য চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। এর মধ্যে অন্যায় খুঁজে বার করতে রীতিমতো ‘চেষ্টা’ করতে হয়! কিন্তু কথা উঠল তো। সকলে চিন্তিত হলেন। অধ্যাপক নিজের বন্ধু-সহকর্মী-শিক্ষকদের পাশে চাইলেন। পেলেনও অনেককেই। পাওয়ারই কথা। মেরুনা যে সুযোগ্য, তা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ বলে দেয়। তবু জাত-পরিচয়ের নিরিখে তাঁর প্রান্তিক অবস্থান মনে করিয়ে অসম্মান করা হল।

তবে ঘটনাটি কি সত্যি এটুকুই? পারমিতা ঘোষের মন্তব্যে শুধুই জাতবিদ্বেষ ধরা দিচ্ছে কি? ভাবা দরকার, এই ঘটনা শুধুই জাতভিত্তিক লড়াই দাবি করছে কি না। এই সমস্যার অনেকগুলো দিক রয়েছে। আসলে যে কোনও সমাজে অনেক ধরনের প্রান্তের ধারণা তৈরি হয়ে থাকে। কখনও জাত-ধর্ম-অর্থ, তো কখনও লিঙ্গ পরিচয়-যৌনতা কিংবা নাগরিকত্ব দিয়ে তৈরি হয় প্রান্তিকের পরিচয়। শিক্ষাগত যোগ্যতা, কলেজের নামের নিরিখেও কেন্দ্র বনাম প্রান্তের টানাপড়েন নির্মিত হয়। কোনও এক মাপকাঠির নিরিখে যে কেন্দ্রে, সে-ই আবার আর এক মাপকাঠিতে প্রান্তিক। কোনও ব্যক্তির পরিচয়ের ক্ষেত্রেই জাত বা ধর্ম একমাত্র নির্ধারক নয়। যেমন এই অধ্যাপকেরও নয়। জাত-পরিচয়ের দিক থেকে তিনি প্রান্তিক হলেও, শিক্ষাগত যোগ্যতা, শ্রেণিগত পরিচয় অস্বীকার করা চলে না। প্রেসিডেন্সি কলেজ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় লেখাপড়া তাঁর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এক আইপিএস অফিসারের কন্যা তিনি। উল্টো দিক থেকে এই ছাত্রীর মন্তব্য শুনে বোঝা যাচ্ছে, তিনি জাতের জায়গা থেকে কেন্দ্রেই থাকুন বা প্রান্তে, শিক্ষা ও বৌদ্ধিক অবস্থানে অবশ্যই প্রান্তিক। পাশাপাশি, তিনি বাবা-মায়ের কাজে বেরনো প্রসঙ্গে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তা-ও ভাববার। কারণ, সেই মন্তব্যে এটুকু পরিষ্কার যে, তিনি আর্থিক ভাবে সম্পূর্ণ সচ্ছল পরিবারের নন। ফলে যে সুবিধে কেন্দ্রে থাকা আর পাঁচ জন পান, তিনি হয়তো পান না।

খেয়াল করা দরকার, ওই ছাত্রীর উক্তি শুধু অধ্যাপকের জাতকে আক্রমণ করছে না। তিনি যখন বেতন নিয়ে কথা বললেন, সেটা অধ্যাপকের অর্থনৈতিক শ্রেণি-পরিচয়ও টেনে আনে। ফলে সেই উক্তির একপাক্ষিক প্রতিবাদ করতে গেলে সমস্যা আরও বাড়তে পারে, এবং বাড়ছেও। আমাদের দেশে জাত-পরিচয়ের নামে সামাজিক অবস্থানের পুরো বিষয়টিই গুলিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আছে। এই ছাত্রীও তা-ই করেছেন। তাঁর পাশে এসে যাঁরা দাঁড়াচ্ছেন, তাঁরাও সেই ভুলেরই শিকার। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে যাঁরা কেন্দ্রে, তাঁরা সেই ফাঁদে না পড়লেই বোধ হয় কিছু দূর এগোতে পারে সমাজ।

আকাশ সেনগুপ্তের নিবন্ধটি (‘ভিতরের সমস্যা মিটবে না’, ৯-৯) পড়ে মনে হচ্ছে, দেশ যতই এগোক, কেন্দ্র আর প্রান্তের যোগাযোগটা আসলে একই রকম থেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ভাবে কেন্দ্রে রয়েছেন অধ্যাপক মুর্মু। তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষাজগতে সুপ্রতিষ্ঠিতরা। তাঁদের সঙ্গে সমাজের উচ্চস্তরের লোকজন, সংবাদমাধ্যম সকলেরই যোগাযোগ যথেষ্ট। জাত নিয়ে কথা উঠলে যে তাঁর পাশেই দাঁড়ানোর কথা, তা মূলস্রোতের অনেকেই বোঝেন। তাই করেছেন। কিন্তু এই সংঘর্ষ, পুলিশের কাছে যাওয়া, কমিশনে অভিযোগ দায়ের করার মসৃণ ব্যবস্থা বোঝাচ্ছে, সমীকরণ বদলায়নি। আর যা-ই হোক, কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের কোনও সংলাপ স্থাপিত হল না এ ক্ষেত্রেও। বরং কেন্দ্র নিজের নিয়মে প্রান্তকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, প্রান্তের কথা বলার অধিকার নেই, কারণ মুখ খুললেই সে ‘অপরিশীলিত’ কথা বলে।

পারমিতা ঘোষের মন্তব্য একেবারেই অসাংবিধানিক। কিন্তু এমন মন্তব্যের পরেও যে ওই ছাত্রী এত নাগরিককে পাশে পেয়েছেন, তা বোঝায় যে ‘জাত’ এবং ‘কোটা’র সুবিধে নিয়ে বিদ্বেষ তাঁর একার নয়। তা থেকে দেশকে মুক্ত করতে গেলে, কেবল এক ব্যক্তির মন্তব্যকে ‘ভুল’ বলে দেগে দিলে হবে কি? সাম্প্রতিক সংঘর্ষের একটা সুবিধের দিক ছিল। এর দু’প্রান্তে এক শিক্ষক ও এক ছাত্রী। আলোচনা শুরু হওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ও প্রয়োজনীয় দুই গোষ্ঠী। পারলে তাঁরাই পারতেন। কিন্তু শিক্ষার কেন্দ্রীকরণ বুঝি আবারও বাধা হয়ে দাঁড়াল।

সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা-৫৫

সবার নিমন্ত্রণ

আকাশ সেনগুপ্তের নিবন্ধে ভারতের চিরকালীন এক সমস্যা উঠে এল। রামায়ণ (শম্বুক কাহিনি) বা মহাভারতের (একলব্য কাহিনি) সময় থেকে দেখা গিয়েছে, নিম্নবর্ণ যখনই কোনও ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছে, তখনই উচ্চবর্ণ রে রে করে উঠেছে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। মেরুনা মুর্মুর ঘটনাটিও সেই কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিল। উচ্চবর্ণ চির কাল ভুলে থাকবে, ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ’। সবার অধিকারই সমান। উচ্চবর্ণরা সংবিধান পরিবর্তন করতে কেন একজোট হয়ে আন্দোলনে নামে না? ভোট বয়কট করে না?

ইরানী মণ্ডল (রায়চৌধুরী)

কলকাতা-৩৪

Rohith Vemula Dalits Minorities
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy