Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ডাক্তার ও নৈতিকতা

চেম্বারের চাকচিক্য, অপেক্ষমাণ রোগীর ভিড় দেখে বোঝার উপায় নেই ডাক্তারের প্রকৃত বিদ্যার দৌড়। প্রথমেই হাতে চলে আসে লম্বা টেস্টের প্রেসক্রিপশন, পড়িমরি লাইন দিই নির্দেশিত ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকে।

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৮ ০০:২৪

ডাক্তার নির্মাণের কারখানা ও কুশীলবদের নিয়ে তিন কিস্তির প্রতিবেদন (‘একই অঙ্গে এত রোগ’, ৯, ১০, ১১-৯) পাঠ করে আঁতকে উঠতে হয়। লম্বাচওড়া ডিগ্রি দেখে আমরা ডাক্তারদের হাতে রোগযন্ত্রণা লাঘবের ভার সঁপে দিই। চেম্বারের চাকচিক্য, অপেক্ষমাণ রোগীর ভিড় দেখে বোঝার উপায় নেই ডাক্তারের প্রকৃত বিদ্যার দৌড়। প্রথমেই হাতে চলে আসে লম্বা টেস্টের প্রেসক্রিপশন, পড়িমরি লাইন দিই নির্দেশিত ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকে। ‘পর্দে কে পিছে’ লেনদেনের সব বৃত্তান্ত জেনেই হাঁ-মুখের খাদ্য হিসেবে অসহায় আত্মসমর্পণ। রোগীর সেবার বদলে পকেটের সেবা। সরকারি ব্যবস্থায় চেনাশোনা না থাকলে ঠাঁই নেই। চূড়ান্ত অবহেলা, বিশৃঙ্খলা। ও দিকে অসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার জাঁকালো হাতছানি। রোগীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে মার্কেটিং অফিসার। ডাক্তারদের উপর ক্রমবর্ধমান টার্গেটের চাপ। অনেক রোগীই পাড়ি জমাচ্ছেন দক্ষিণে। সামর্থ্য আছে যাঁদের, যাচ্ছেন বিদেশে। প্রতিবেদনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার (অ)-ব্যবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ডিগ্রি অর্জনের বদলে ডিগ্রি ক্রয়।

অবধারিত ভাবে আসবে এই বাজারে প্রবেশের বৃত্তান্তটিও। মেধাবী ও সেবাব্রতী ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময় বিপুল অর্থের কথা ভেবে পিছিয়ে যাচ্ছেন। সেই সুযোগ বেশি অর্থের বিনিময়ে নিয়ে নিচ্ছে অন্য মানুষ। অতি সাধারণ ছাত্রটিও আর্থিক যোগ্যতামানে উত্তীর্ণ। তাই প্রথম থেকেই তার মাথায় ঢুকে থাকে বিনিয়োগ করা অর্থ পুনরুদ্ধারের ভাবনা। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পায়ের তলার মাটি কোথায়?

বিশ্বনাথ পাকড়াশি

শ্রীরামপুর, হুগলি

অগ্নীশ্বর

‘একই অঙ্গে এত রোগ’ সময়োপযোগী ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। গত ২০ অগস্ট তারিখে আমাদের ছ’বছর বয়সের বাচ্চার জ্বর এল। তার সামান্য জ্বর-জ্বালায় আমাদের বরাবর সহায় হোমিয়োপ্যাথি প্র্যাকটিস করা এক ডাক্তারকাকু। এ বারও তাই। দু’দিনেও জ্বর না কমায় ২৫০ প্যারাসিটামল। তিন দিনের দিন আমাদের গুণধর পুত্র এক কাণ্ড ঘটাল, ঘন ঘন জ্বর মাপার জন্য বালিশের পাশে রাখা ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারটি আপন খেয়ালে চিবিয়ে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব আমরা তাকে তড়িঘড়ি ঝাড়গ্রাম সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলে, এক তরুণ চিকিৎসক বাচ্চার স্টমাক ওয়াশ করে মেদিনীপুর মেডিক্যালে রেফার করেন। তাঁর কথামতো চার ঘণ্টা স্টমাকে থাকার পর মার্কারি রক্তে মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা। ইতিমধ্যে ‘ব্যাল’ নামক ওষুধ প্রয়োগ করলে তা আটকানো সম্ভব। তাঁর বর্ণনায় যেটুকু বুঝলাম উক্ত ওষুধটি ‘বিষের বিষ’, তার সঠিক প্রয়োগ না হলে বাচ্চার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। ভয়ানক ভয়কে সঙ্গী করে আত্মীয়-বান্ধবদের সহযোগিতায় ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মেদিনীপুর মেডিক্যালে পৌঁছনো গেল। সেখানে ইমার্জেন্সিতে গিয়ে দেখি কুম্ভমেলার ভিড়। তারই মধ্যে বাচ্চার অ্যাডমিশন হল, শুরু হল স্যালাইন, ইঞ্জেকশন। তত ক্ষণে বাচ্চার মার্কারি গিলে ফেলার খবর রটে গিয়েছে। জুনিয়র চিকিৎসকদের অনেকেই মোবাইলে তার এক্স-রে প্লেটের ছবি নিলেন, অন্য ওয়ার্ড থেকে দু’এক জন ইন্টার্ন ওই প্রবল ভিড় ঠেলে পারদ খেয়ে-ফেলা বাচ্চাকে দেখে গেলেন। প্রায় প্রত্যেকের কাছে এই কাণ্ডের সম্ভাব্য পরিণতি জানতে চাইলে, দো-আঁশলা উত্তর মিলল। শুধু সিনিয়র চিকিৎসক আশ্বস্ত করলেন, মার্কারি সহজপাচ্য নয়, তাই স্বাভাবিক ভাবেই তা মলমূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে পড়বে। তবুও পরের দিন রক্তে মার্কারি সংক্রমণ সংক্রান্ত কয়েকটি টেস্ট হল, জ্বর থাকার কারণে টেস্ট হল ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েডেরও— যদিও কোনও সংক্রমণের চিহ্ন মিলল না। ইউএসজি-তেও দেখা গেল, কোনও অর্গানেই মার্কারির প্রভাব পড়েনি। এর পর শুরু হল জ্বরের চিকিৎসা, দু’দিন পর জ্বর কিছুটা কমতে বাড়ি ফিরলাম, তারও দু’দিন পর বাচ্চার মামাবাড়ি বাঁকুড়া এলাম। বাচ্চার কাছে ‘মামাবাড়ি ভারী মজা’, আর প্রয়োজনে বাঁকুড়া সদরে চিকিৎসকের প্রতুলতাও আছে। ইতিমধ্যে জ্বরের প্রাবল্য কমলেও তা পিছু ছাড়েনি। তাই পরের দিন দু’জন ডাক্তারকে দেখালাম, তাঁরা দীর্ঘ দিন জ্বর না ছাড়ার কারণে হয় বাঁকুড়া মেডিক্যাল, নয়তো কোনও নার্সিংহোমে ভর্তি করার কথা বলেই দায় সারলেন। সে দিন সন্ধেবেলাতেই বাঁকুড়া সেবাসদন নার্সিংহোমে ভর্তি করালাম। সেবাসদনে পাঁচ দিন যে ‘সেবা’ মিলল তা হল— নিরন্তর স্যালাইন, আর দু’বেলা অজস্র ওষুধ-ইঞ্জেকশন। তাতে জ্বরের ধুম আরও বাড়ল। যে ডাক্তারবাবুর অধীনে চিকিৎসা চলছিল, তিনি তাঁর মেডিক্যালে চাকরি আর চেম্বার সামলে নার্সিংহোমে আসার সময় পান না বললেই চলে। তাঁর প্রতি দিন রুটিন চেক-আপ পাঁচ থেকে সাত মিনিট। এক্সট্রা কল করা যায় এক্সট্রা ফি-র বিনিময়ে। পাঁচ দিন পর যখন মাননীয় এমডি পেডিয়াট্রিক্স, মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অন্ধকারে সুচ খোঁজার ধরনে আরও এক প্রস্থ ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, এবং অ্যান্টিবায়োটিক চেঞ্জের পথে দ্বিতীয় ইনিংসের প্রস্তুতি নিলেন, তখন অধৈর্য আমরাই ‘ডিসচার্জ’ চাইলাম। ডিসচার্জ লেটার দেওয়া হল, সঙ্গে দেওয়া হল প্রায় ত্রিশ হাজারের একটি বিল এবং প্রতি পাঁচ ঘণ্টা অন্তর জ্বর এলে ‘স্পঞ্জিং’ এবং ২৫০ প্যারাসিটামল খাওয়ানোর ‘মহামূল্যবান’ নিদান। সে দিনই অ্যাম্বুল্যান্সে পৌঁছলাম কলকাতার পার্ক সার্কাস ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেল্থ-এ। প্রথমেই যেটা আমাদের অভিভূত করল তা হল ডাক্তারবাবুদের দেখার ধরন। অ্যাডমিশনের পর যথারীতি চ্যানেল হল, ব্লাড টেস্টের জন্য ব্লাড নেওয়া হল, কিন্তু সবটাই নিপুণ হাতে। স্মাইলিং মুডে, বাচ্চার সঙ্গে গল্পের ছলে। অ্যাডমিশনের পর দিন থেকে জ্বরও গায়েব হল, মার্কারি সংক্রান্ত যাবতীয় দুশ্চিন্তা থেকেও তাঁরা মুক্ত করলেন। প্রতি দু’বেলা ‘পেশেন্ট পার্টি মিট’-এ ডাক্তারবাবুরা অজস্র রোগীর আত্মীয়দের জানাচ্ছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে কী সমস্যা পেয়েছেন, কী চিকিৎসা চলছে, এমনকি সম্ভাব্য আরও কোন কোন দিক তাঁরা দেখবেন বলে ভাবছেন। তখন এক বার স্মরণে এল আগের বারের ফাইলবন্দি চিকিৎসা, জানতে চাইলে আরএমও-র নির্বিকার উত্তর, ‘ডাক্তারবাবু তো দেখছেন, এত অধৈর্য হলে হয়?’ জিজ্ঞাসার উত্তরে আর এক জিজ্ঞাসা। অথচ দ্বিতীয় বারের ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুকে যখন যা জিজ্ঞাসা করেছি, তার সহাস্য উত্তর মিলেছে। এক জন সিনিয়র ডাক্তারবাবুর পরামর্শে একাধিক ডাক্তার মিলে, খুব সামান্য ওষুধ, আর প্রায় সর্বজনবিদিত এক অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারেই সতেরো-আঠারো দিনের জ্বর
ছুটি নিল। আমরাও ছুটি নিয়ে বাড়িতে ফিরলাম।

বাড়ি ফিরে ভাবলাম, ‘সেবাসদন’ থেকে ডিসচার্জ-মুহূর্তে অনেক আত্মীয় পরামর্শ দিয়েছিলেন অ্যাপোলো-চেন্নাই যাওয়ার। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় সায়ও দিয়েছিলাম। কিন্তু মনে মনে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, খুব বিপন্ন অসহায় লাগছিল, চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের বাংলার ডাক্তারবাবুরা এতখানি পিছিয়ে! সামান্য জ্বরেও আমরা আমাদের রাজধানীর ডাক্তারবাবুদের বিশ্বাস করতে পারব না, সামান্য রোগ নিরাময়েও দক্ষিণই ভরসা? নার্সিংহোম থেকে ‘ফিট সার্টিফিকেট’ না মেলায়, উড়ে যাওয়া হয়নি চেন্নাই। অভিজ্ঞতা অর্জন হল, কলকাতা শহরেই এমন চিকিৎসক আছেন, যাঁদের সুষ্ঠু চিকিৎসায়, আর সুন্দর ব্যবহারে রোগী বা রোগীর আত্মীয়দের হারানো বিশ্বাস কিছুটা হলেও ফিরে পাওয়া যায়। পাঁচ দিনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখলাম কত ক্রিটিকাল রোগের নিরাময় ঘটান তাঁরা, জটিল রোগে আক্রান্ত শিশুদের সুস্থ করে হাসি ফোটান পরিবারের মুখে। উত্তম চিকিৎসকরা এখনও আছেন, এখনও ‘অগ্নীশ্বর’রা তা হলে হারিয়ে যাননি।

আবীর কর

রঘুনাথপুর, ঝাড়গ্রাম

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

Morality Doctor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy