E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ত্রিমাত্রিক শিল্প যেন

সলিল চৌধুরীর গানের রূপায়ণ কখনওই সহজ ছিল না। স্বরের বিন্যাস এবং অপ্রত্যাশিত ওঠানামা তাঁর সুরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি সচেতন ভাবে সুর-আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৩

দেবজ্যোতি মিশ্রের লেখা ‘তিনি নিজেই একটি ঘরানা’ (১৬-১১) পড়ে ঋদ্ধ হলাম। অত্যন্ত প্রিয় সুরকারের বিষয়ে অনেক নতুন তথ্য জানলাম। জীবন শিল্পী সলিল চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ শেষ হতে চলল। কিন্তু বাংলা গানে নতুন যুগের অগ্ৰদূত এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর উত্তরাধিকারের ধারা শতাব্দী পেরিয়েও সমভাবে প্রবহমান। সলিল চৌধুরী বাংলা গানের এক অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী সুরস্রষ্টা। ভারতীয় রাগসঙ্গীত এবং পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি বাংলা গানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর গানে পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে মোৎজ়ার্ট, বেঠোফেন, এবং বাখ-এর মতো সুরস্রষ্টার স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। তবে তিনি এই সুরের কাঠামোকে ভারতীয় ‘মেলোডি’ এবং ‘মডিউলেশন’-এর সঙ্গে এমন ভাবে মিশিয়ে দিতেন যে, সৃষ্টিটি সম্পূর্ণ ভাবে ভারতীয় হয়ে উঠত। সলিল চৌধুরীর সুরে লতা মঙ্গেশকর ও তালাত মেহমুদের গাওয়া হিন্দি গান ‘ইতনা না মুঝসে তু পেয়ার...’ (ছায়া) মোৎজ়ার্টের সিম্ফনির উপর ভিত্তি করে সুরারোপিত।

সলিল চৌধুরীর গানের রূপায়ণ কখনওই সহজ ছিল না। স্বরের বিন্যাস এবং অপ্রত্যাশিত ওঠানামা তাঁর সুরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি সচেতন ভাবে সুর-আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’ অথবা ‘গাঁয়ের বধূ’ গানগুলিতে তাল-ফেরতার অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার রয়েছে, যা গানের আবেগ ও কাহিনির প্রয়োজনে আনা হয়েছে। চিরাচরিত প্রেম বা বিরহের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি বাংলা গানে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথা, যন্ত্রণা ও সামাজিক সচেতনতা তুলে ধরেন। তাঁর গান শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত চেতনাকেও ধারণ করেছিল। তিনি গণসঙ্গীতের প্রণেতা হিসাবে চিরস্মরণীয়। কৃষক আন্দোলনের সময় লিখেছেন, ‘হেই সামালো’। ‘ঢেউ উঠেছে, কারা টুটেছে’, নৌবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে লেখা গান। তাঁর ‘পথে এ বার নামো সাথী’, গানটি শুনলে এখনও মানুষের রক্ত গরম হয়ে যায়। গানটি অনন্তকাল ধরে মানুষকে প্রতিবাদের সাহস জোগাবে। ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটি বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে। এ ছাড়া, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা অবলম্বনে সুরারোপিত ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’ গানগুলি তাঁর গণচেতনা ও সমাজমুখী গানের উজ্জ্বল উদাহরণ। সুরকার হিসাবে তিনি যত বড়, গীতিকার হিসাবেও তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। গণনাট্যের গানগুলি বাদ দিলেও, তাঁর আধুনিক গানের কথায় রবীন্দ্রনাথের ভাষার প্রভাব ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। তাঁর গানে কখনও-কখনও রাজনীতি, বুভুক্ষা, বঞ্চনা ও দারিদ্রের নিকষ অন্ধকার ফুটে উঠেছে। সলিল চৌধুরীর গান তাই কেবল সুরের বাঁধন নয়, তা এক পূর্ণাঙ্গ কম্পোজ়িশন, যেখানে কথা, সুর এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এক ত্রিমাত্রিক শিল্প সৃষ্টি করেছে।

গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

চিরকালের গান

দেবজ্যোতি মিশ্রের লেখা ‘তিনি নিজেই একটি ঘরানা’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। লেখক জানিয়েছেন, “একটি তারার মৃত্যু হয়েছে অনেক আগে...”, প্রসঙ্গত বলি, তবে এমন অনেক তারাই এক সময়ে বাঙালি হয়েও সমগ্ৰ ভারতকে আলো দেখাতেন। সে ধারার অংশ সলিল চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের পর স্বতন্ত্র ঘরনা তৈরি করতে যাঁরা সফল, যেমন হিমাংশু বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র, আব্বাসউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ, তাঁদের সারিতে উজ্জ্বল সলিল চৌধুরী।

তাঁর গানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ছোঁয়া, লোকসঙ্গীতের ও শাস্ত্রীয় ও আধুনিকতার সুর-তান মিলেমিশে মনকে মোহিত করে। গানের প্রতিটি বাঁক ও সুরের নকশা, কথার গভীরতা, সুরের মেলবন্ধন সলিল চৌধুরীর নিজস্ব। বাংলা গানে এক নতুন ধারার প্রবর্তক সলিল চৌধুরী। প্রতিবাদের আগুন তাঁর গানে। ‘গাঁয়ের বধু’ গান বাংলা গানের জগতে একটা বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। সেই বাঁকে একে-একে মেলে রানার, পাল্কির গান, অবাক পৃথিবী, ‘ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’ প্রভৃতি। ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ গানটি যেন আজও ভরদুপুরে সন্ধ্যা-কণ্ঠে ভর করে এক মন-কেমন-করা ছবি মনের ক্যানভাসে জাগিয়ে তোলে। দার্শনিক মন যেন গানের মণিমুক্তো খুজে পায় যখন কানে ভেসে আসে ‘আহা, ওই আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদূরে, কোন হরিণী করুণ তার তান তুলেছে...।’ মনে চিরস্থায়ী হয়ে যায় ‘পাগল হাওয়া কি আমারও মতন তুমিও হারিয়ে গেলে...’ এই গান কিন্তু হারাবার নয়। এ গান চিরদিনের, চিরকালের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ধার করে বলি, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।

রাজীব ঘোষ, কুসুমদিঘি, বাঁকুড়া

সঙ্গীতের ঢেউ

দেবজ্যোতি মিশ্রের ‘তিনি নিজেই একটি ঘরানা’ প্রবন্ধ সলিল চৌধুরীকে নিয়ে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণধর্মী অসাধারণ এক রচনা। নিঃসন্দেহে বাংলা গানে পাশ্চাত্য রীতির ব্যবহারে সলিল চৌধুরী ছিলেন অন্যতম যুগপুরুষ। বীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পর এমন নানামুখী ও বিচিত্রকর্মা সঙ্গীতপ্রতিভা আমরা বিশেষ পাইনি। সলিল চৌধুরী ছিলেন সত্যিই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি অসামান্য গীতিকার, অনন্য সুরকার, সিনেমার অনবদ্য আবহসঙ্গীত স্রষ্টা। সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে অনবদ্য গল্পকার, কবিও। বাঁশি-সহ হারমোনিয়াম, পিয়ানো, সরোদ, তবলা সব কিছুই তাঁর আঙুলের ছোঁয়ায় প্রাণ পেত। কোরাস গায়ন পদ্ধতি নিয়ে তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।

চল্লিশ দশকের অশান্ত সময়ে সলিল কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন, জড়িয়ে পড়েন দলের শাখা সংগঠন আইপিটিএ-র সঙ্গে। কৃষক আন্দোলন সামলানো, গণসঙ্গীত রচনা তাঁর নৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়। তৈরি করেন যুবজাগরণের গান, দেশমুক্তির গান, বন্দিমুক্তির গান, মাঝিমাল্লার গান। সলিলের তৈরি ঢেউ আছড়ে পড়ে গাঁয়ে-গঞ্জে, শহরের অলিতে গলিতে— ‘যাক যা গেছে তা যাক’। দেশভাগের অন্ধকারেও আশার প্রদীপটুকু জ্বালিয়ে তিনি গাইছেন ‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না।’ তিনি সাম্যের স্বপ্ন বুকে নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সুরারোপ করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়াচ্ছেন রানার, অবাক পৃথিবীর মতো কালজয়ী গান।

গান লেখার পাশাপাশি সলিল চৌধুরী ছোট গল্পও লেখেন। তাঁর ‘রিক্সাওয়ালা’ গল্প ভিত্তি করে বিমল রায় তৈরি করেন তাঁর অন্যতম সেরা ছবি দো বিঘা জ়মিন। যাকে ভারতীয় সিনেমায় মাইলফলক বলে মনে করেন অনেকে। এ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান সলিল। মধুমতী-র ‘আজা রে পরদেশি’ তো ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। আজও তা প্রায় সমান জনপ্রিয়।

সুদেব মাল, তিসা, হুগলি

অমৃতধারা

দেবজ্যোতি মিশ্র তাঁর লেখা ‘তিনি নিজেই একটি ঘরানা’য় সলিল চৌধুরীর সুচারু ভাব ও ভঙ্গিমায় মূল্যায়নে পাঠককে সমৃদ্ধ করলেন। প্রবন্ধকারের বক্তব্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে স্বীকার করতে হয়, সলিল চৌধুরী এক জন স্বতন্ত্র ঘরানার ব্যক্তিত্ব। আমাদের মতো সাদামাঠা মানুষও সঙ্গীতের খুঁটিনাটি বিষয়ে অজ্ঞ থাকলেও তাঁর সুরের প্রতি যারপরনাই আকৃষ্ট হয়ে পড়ি, কারণ তা হৃদয়, মন ছুঁয়ে যায়। এক জন শিল্পীর পক্ষে এটাই বোধ হয় সাধনার প্রকৃত মোক্ষ। সলিল চৌধুরীর সে অমৃতধারা আজও বয়ে চলেছে আমাদের হৃদয়ের গভীরে।

সলিলবাবু সংগ্রামী মানুষ। অন্যের হৃদয়ের যন্ত্রণা বহন করে আমাদের ভাবিয়েছেন। আবার, সঙ্গীত সুধায় বিনোদনের রসদ জুগিয়েছেন এবং আজও জুগিয়ে চলেছেন অবিরত ধারায়। পরবর্তী প্রজন্মে কিন্তু সলিল চৌধুরীর যোগ্য উত্তরসূরি সৃষ্টি হতে পারত, কিন্তু যদি শিল্পসাধনা কেবলই বাণিজ্যিক হয়ে না উঠত, তবেই। নতুন প্রজন্মে প্রতিভার অভাব নেই। অভাব শুধু কঠোর সাধনার।

বাবুলাল দাস, ইছাপুর উত্তর ২৪ পরগনা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Salil Chowdhury Music Composer lyricist Music Director Bengali Music

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy