অশোক কুমার লাহিড়ীর “দুর্নীতি কেন ‘স্বাভাবিক’ হল” (২৪-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে উঠে এসেছে দুর্নীতি কী ভাবে ধীরে ধীরে মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেল। মনে পড়ছে ভারাভারা রাও-এর কবিতার কয়েকটি চরণ— “নিয়ম-কানুন যখন সব লোপাট/ আর সময়ের ঢেউ-তোলা কালো মেঘের দল/ ফাঁস লাগাচ্ছে গলায়/ চুইয়ে পড়ছে না কোনও রক্ত/ কোনও চোখের জলও নয়/ ঘূর্ণিপাকে বিদ্যুৎ হয়ে উঠছে বাজ/ ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও হয়ে উঠছে প্রলয়ঝড়, আর,...”। এ রাজ্যে পরিস্থিতি একই। প্রবন্ধ অনুযায়ী শাসক দলের এক প্রবীণ নেতার অভিব্যক্তি— “এখন রাজনীতি করলেই লোকে চোর ভাবে।” কিন্তু আমরা জানি সবাই চোর নয়, যদিও চোরের সংখ্যাটাও কম নয়। তবুও ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে তৃণমূলের আসনসংখ্যা বেড়েছে। বিরোধীরা ‘চোরদের রাজত্ব’ বলে গলা ফাটালেও চোরেরা কেন জয়ী হয়ে আসছে, সে কথা প্রবন্ধে ধরা পড়েছে। তবে, আমার সমীক্ষা অন্য কথা বলে। আজ ভারতের ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও এত দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা-মন্ত্রীর হাজতবাসের ঘটনা মিলবে না। অথচ, বাম আমলে দুর্নীতি থাকলেও কাউকে জেলে যেতে হয়নি। গুরুত্বের বিচারে জ্যোতিবাবুর পরেই ছিলেন বিনয় চৌধুরী। তিনি এক সময়ে অনুভব করেছিলেন ‘সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত’। ২০১১ সালের ক্ষমতাচ্যুত বুদ্ধবাবুর অভিব্যক্তি ছিল “আমাদের দলের সঙ্গে জড়িত কিছু লোক দলকে পয়সা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মানুষ আমাদের পরাজিত করে তার জন্য শাস্তি দিয়েছেন।” তা হলে কি সেই আমলে ক্যাডারদের চাকরি হয়নি? হয়েছে, তবে অর্থের বিনিময়ে নয়, বুথ কমিটি, লোকাল কমিটি থেকে নানান কমিটির হাত ঘুরে জেলা কমিটির অনুমোদনের পরে তা সম্ভব হয়েছে। সবটাই ছিল সময়সাপেক্ষ। আর আজ বিভিন্ন এলাকায় বসিয়ে রাখা কয়েক জন ব্যক্তির সাহায্যে অর্থের বিনিময়ে সব কাজ হয়ে যাবে নিমেষেই। গণতন্ত্রের দিক থেকে এ সবই নিন্দনীয়। তা-ও বঙ্গ রাজনীতিতে আমজনতা মেনে নিচ্ছেন কেন? কারণ, দীর্ঘমেয়াদি দুর্নীতি আজ সাধারণ মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে।
তবে প্রবন্ধকারের সঙ্গে সহমত পোষণ করেও ভিন্নধর্মী কিছু মত প্রকাশ করতে চাই। প্রথমত, বর্তমান সরকার মানুষকে নানান পদ্ধতিতে আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ করেছে। যেমন, গৃহ, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার-সহ নানা দিক থেকে একটি পরিবারের হাতে মাসের শেষে কাজ না করেও যদি ৫-৬ হাজার বা তারও বেশি টাকা আসে, তা হলে সেই শাসক তাদের কাছে হয়ে ওঠে কল্পতরু। দ্বিতীয়ত, ভোট হয় না। ‘ভোট করাতে হয়’। এই প্রয়োগতত্ত্ব বাম আমলের, তৃণমূলের কৃতিত্ব নয়। তবে তারা সেই দুর্নীতিকে আরও পরিশীলিত করে তুলেছে। তৃতীয়ত, এলাকা দখলের জন্য রাজনীতিতে শাসকদের কিছু পেশিশক্তির প্রয়োজন হয়। শাসকরা অর্ধশিক্ষিত কিছু যুবসম্প্রদায়কে জায়গা দিয়ে রাখেন। সম্ভব হলে মাসোহারার ব্যবস্থাও। বর্তমান সরকার সে দিক থেকে অনেক বেশি এগিয়ে। চতুর্থত, মাসের পর মাস নানান স্থানে নিরন্ন মানুষদের জন্য ডিম-ভাতের ব্যবস্থা চালু রাখা। না খেতে পাওয়া মানুষ নীতিকথা বোঝেন না। তাঁদের দাবি, “আমরা তো সামান্য লোক/ আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক” (জয় গোস্বামী)। সেই ব্যবস্থাই চালু রেখেছেন শাসক। ফলে তাঁদের বৈতরণি পেরিয়ে যায়। শাসককে সরাতে হলে এর থেকে বিরোধীদের শিক্ষা নিতে হবে।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
অন্ধকারাচ্ছন্ন
পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতিতে নিমজ্জমান রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের অবস্থা অনেকটা— এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। তবে এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শাসক দলের লোকজনই আছেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন, “দল চালানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন।” তিনি নিজেও একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। তাঁদের দলও চালাতে অর্থের প্রয়োজন হয় নিশ্চয়ই। কী করে বোঝা যাবে যে, সেই অর্থ সবটাই সৎ পথে উপার্জন করে রাজনৈতিক প্রয়োজনে খরচ হয়েছে? আমরা যারা যৌবনকালে কিঞ্চিৎ রাজনীতি করেছি, তারা জানি, সেই সময় সদস্য সংগ্রহ, পার্টির ক্লাস, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে যা সংগৃহীত হত, তাই দিয়েই নির্বাচন থেকে রাজনৈতিক সভা— সবটাই সামাল দিতে হত। সে দিন গিয়েছে। এ কালে নির্বাচনে লড়তে গেলে ‘হেভিওয়েট নেতা’দের সভা এবং বক্তৃতা চাই, রোড-শো চাই, কর্মী-সমর্থকদের ঝকমকে টি-শার্ট চাই, সর্বোপরি নির্বাচনের দিন ভরপেট আহার আছে। এত সবের সংস্থান কি সে কালের সদস্য সংগ্রহ আর জনসংযোগের দ্বারা সম্ভব?
প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ৪৫.৮% ভোট পেয়েছে। এর অর্থ ৫০%-এর বেশি মানুষ তৃণমূলে আস্থা রাখেনি। অতএব প্রবন্ধটি স্ববিরোধিতায় ভরা এবং তৃণমূল দলটির প্রতি কটাক্ষ করতেই তিনি লিখেছেন। এখন প্রশ্ন হল, সেই বাম আমল থেকেই যদি এই রাজ্যটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়ে থাকে, তা হলে কি এই রাজ্যের অধিবাসী সকলেই নির্বোধ? না কি তাঁর আরাধ্য দলটির প্রতি আস্থা না জানানো মানুষেরা নির্বোধ? চাকরি দুর্নীতি থেকে শুরু করে কাটমানি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে এই রাজ্যের একাধিক জননেতা অভিযুক্ত হয়েছেন, কেউ কেউ জেলবন্দিও রয়েছেন। তা হলে কি, বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতেই শুধু ন্যায়ের বাতাবরণ? সেই সব রাজ্যের রাজনীতিতে দুষ্কর্মের ছিটেফোঁটাও নেই?
তবে, রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য আজকাল দেশদ্রোহিতা বলেও গণ্য হতে শুরু করেছে, গণতন্ত্রের এমন অবনমন, নাকি উত্তরণ দেখে আমাদের মতো অগণিত প্রান্তিক কলমচিও ভীতসন্ত্রস্ত। প্রবন্ধটির উপজীব্য ছিল দুর্নীতি। আমিও মনপ্রাণে এই দুর্নীতির বিরোধী এবং চাই প্রত্যেক জনগণের জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ শাসনব্যবস্থা কায়েম হোক। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আশঙ্কায় জর্জরিত হয়ে পড়ি এটা ভেবে যে, এই ভারতেই তো সাম্প্রতিক অতীতে ‘সর্বভারতীয় নিট’ পরীক্ষার পাহাড়-প্রমাণ দুর্নীতি সামনে এসেছে। এই দুর্নীতির বটবৃক্ষের শিকড় কতটা গভীরে নিমজ্জিত, এটা অজানা রেখেই শত সহস্র আগামী প্রজন্মের মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে সেই পরীক্ষাতেই বসতে হচ্ছে। ভবিষ্যৎ পড়ুয়াদের যে মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠার জালে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই ধোঁয়াশা থেকেই বা বেরিয়ে আসার পথ কোথায়? এমন হলে কাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করব আমরা?
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
ভাঙা-গড়া
বাংলার সমাজে যে মানুষ সমাজ নিয়ে ভাবে, সে আসলে রাজনীতি নিয়ে ভাবে। আর যে মানুষ রাজনীতি নিয়ে ভাবে সে রাজনৈতিক দল নিয়ে ভাবে। কোনও জনবাদী আন্দোলন স্রেফ কিছু দাবির উপর ভিত্তি করে হয় না। আজ যেটা হচ্ছে তা একটি ঘটনাকে সামনে রেখে, লিঙ্গবৈষম্যের বিরোধিতা যার ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পুরুষতন্ত্রের অবৈধ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এটা শুভ। অবশ্যই সংগ্রামে বড় প্রাপ্তি। প্রশ্ন তুলেছে, আমার শরীরের উপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শুধুমাত্র আমার। এই সবই সমাজের প্রগতিশীল ভাবনার জগতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। কিন্তু কোনও জনবাদী আন্দোলন একটা সদর্থক দিশা ছাড়া স্রেফ ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বললেই হবে না। এখনও আন্দোলন আশা জাগাচ্ছে যে, একটা নতুন কিছু হবে। ‘রাত দখল’ আর ‘ভোর দখল’ কর্মসূচি হিসাবেও আকর্ষণীয়। কিন্তু কাউকে ক্ষমতাচ্যুত করা বা ক্ষমতাসীন করার জন্য রাজনীতি প্রয়োজন। নয়তো সমাজ বদলের সম্ভাবনা সুদূর। রাত দখলের কর্মসূচিতে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও, তা ভাঙনের হাতিয়ার হবে, নির্মাণের ইতিহাস হবে না।
নব দত্ত, কলকাতা-৩৯
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy