E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: যান্ত্রিক শিক্ষা

‘বিদ্যাবস্তু’ আজ নগদ মূল্যে কিনতে হয়। কাজেই শিক্ষাদান নামক ব্যবসায়িক ব্যবস্থায় স্নেহ-শ্রদ্ধা-নিষ্ঠা আজ নেই। তবে আশার কথা, সবটাই এখনও বিকিয়ে যায়নি।

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৪১

ঈশা দাশগুপ্তের ‘নগদ মূল্যে কিনে আনা শিক্ষা’ (১-৭) শীর্ষক প্রবন্ধটি বড় দুঃখের। এই শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ গড়ার কাজটি হয় না। এ বড় প্রাণহীন, যান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। পরীক্ষাকেন্দ্রিক এই শিক্ষায় নিরাসক্ত মন নিয়েও পড়া মুখস্থ করে ১০০ শতাংশে পৌঁছনোর জীবনপণ লড়াই চলে। এরা ছাপার অক্ষরেই সম্পূর্ণ ডুবে থাকে, বাইরের প্রত্যক্ষ জগতের প্রতি এদের আকর্ষণ থাকে না। শিক্ষাঙ্গনের দেওয়ালের বাইরে, এদের মনে লাগে না বিশ্বপ্রাণের স্পন্দন। এ তো মানসিক শক্তিহ্রাসকারী নিরানন্দময় শিক্ষা। এখানে রয়েছে কোর্স-শেষে বিরাট প্যাকেজের চাকরির হাতছানি, যদিও সেই ক্ষেত্রটিও সীমিত! কাজেই, অসম্ভব প্রতিযোগিতার দৌড়ে এই একমাত্র ‘মোক্ষ’ লাভে বঞ্চিত হলে আসে তীব্র হতাশা, হাহাকার। অতি সামান্য শতাংশ বিজয়ীর পাশে হেরে যাওয়া শিক্ষার্থীরা হারিয়ে যায় অন্ধকারের চোরাবালিতে। অসম্ভব প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয় অনির্দিষ্টকাল ধরে। আজ নিরপরাধ শিক্ষার্থীর কাছে এ ধরনের ‘বিদ্যাগার’ পেয়েছে ‘কারাগার’-এর আকৃতি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোচিং ক্লাসে থেকে এরা আহরণ করে ‘বিদ্যাবস্তু’। হয় না তার যথার্থ ব্যবহার। যথাযথ বিকাশ ঘটে না শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তা ও কল্পনাশক্তির।

প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন, ‘বিদ্যাবস্তু’ আজ নগদ মূল্যে কিনতে হয়। কাজেই শিক্ষাদান নামক ব্যবসায়িক ব্যবস্থায় স্নেহ-শ্রদ্ধা-নিষ্ঠা আজ নেই। তবে আশার কথা, সবটাই এখনও বিকিয়ে যায়নি। এখনও সরকারি বা সরকারপোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা জীবনের অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের মেলে ধরছে। সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভাল ‘র‌্যাঙ্ক’ করে তথাকথিত ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ করে নিচ্ছে, বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে পোস্ট ডক্টরেট করতে। সামান্য বেতনের বিনিময়ে বি টেক বা এম টেক ডিগ্রি অর্জন করে বিরাট প্যাকেজের চাকরি নিয়ে দেশ-বিদেশের নামীদামি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে। মেধা ও পরিশ্রমের সবটুকু আজ বিক্রি হয়ে যায়নি। তবে সমস্যাও অনেক। ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীর তুলনায় আজ চাকরিতে নিয়োগ অপ্রতুল। রয়েছে দুর্বৃত্তায়নের নানা ফন্দিফিকির, ছলনাই যেখানে অধিক। প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থী বাধ্য হচ্ছে স্বল্প মাইনের চুক্তিভিত্তিক কাজ করতে। বাবা-মায়ের আক্ষেপ আজ এটাই, হয়তো অপরাধবোধও।

সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি

সমৃদ্ধি

তরুণকান্তি নস্করের ‘বিকল্প শিক্ষানীতির নির্মাণ’ (১১-৭) শীর্ষক প্রবন্ধটির সম্পর্কে কিছু কথা। এ কথা মানতে হবে, ভারতের মতো একটি বৃহৎ দেশে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কখনও সর্বসম্মত কোনও শিক্ষানীতি প্রণীত হবে না। অবশ্যই বর্তমানের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে নানা সমালোচনা আছে। কিন্তু প্রবন্ধকার যে বিকল্প নীতির কথা তুলে ধরেছেন, সেটির রূপকার ‘সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটি’। এই কমিটি যে শিক্ষানীতির কথা বলেছে, তার বাস্তবায়নে সারা দেশের শিক্ষার জন্য মোট বাজেট বরাদ্দের কমপক্ষে ১০ শতাংশ করার দাবি করা হয়েছে। এই দাবিকে যথার্থ বলেই মনে করি।

কিন্তু শিক্ষাকে কেবলমাত্র রাজ্য তালিকাভুক্ত করার যে দাবি সেভ এডুকেশন কমিটি করছে, তার কোনও সারবত্তা নেই। বর্তমানে শিক্ষা যুগ্ম তালিকাভুক্ত। এতেই দেখা যাচ্ছে শিক্ষা নিয়ে রাজ্যগুলি ইচ্ছামতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে মূল শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিকেই নষ্ট করছে। আমাদের রাজ্যে বাম আমলে প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি ভাষা তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে এই সেভ এডুকেশন কমিটি দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চালিয়েছিল। যুগ্ম তালিকার মধ্যে থেকেই রাজ্যে শিক্ষার যা বেহাল দশা, তার গঙ্গাপ্রাপ্তি হবে যদি শিক্ষাকে রাজ্য তালিকাভুক্ত করা হয়। আসলে যখন যে রাজনৈতিক দল রাজ্যে বা কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকে, তারা তাদের মতাদর্শকেই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে চাপিয়ে দিতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ও তার ব্যতিক্রম নয়।

প্রবন্ধকার স্কুল স্তরে সিমেস্টার পদ্ধতি প্রয়োগের প্রসঙ্গে যে যুক্তি দিয়েছেন, সেটি সঠিক বলেই মনে করি। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক বছর ধরে স্কুল স্তরে অনেকগুলি পর্বভিত্তিক পরীক্ষা এবং বর্তমানে সিমেস্টার ব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের স্পৃহাকে নষ্ট করে দিয়েছে। বর্তমানে একাদশ দ্বাদশ শ্রেণিতে সিমেস্টার পদ্ধতির জন্য বিভিন্ন বিষয়ের যে সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে, তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে বলে জানা নেই। এর ফলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা কোনও ভাবেই অর্জন করতে সক্ষম হবে না।

পিইপি মডেল প্রণেতারা ভারতীয় জ্ঞানব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মনে হয়েছে যে, ভারতীয় জ্ঞানব্যবস্থা মানে শিক্ষার গৈরিকীকরণ। ‘গৈরিকীকরণ’, ‘সাম্প্রদায়িকীকরণ’, ‘কেন্দ্রীকরণ’ প্রভৃতি গালভরা শব্দ বর্তমানে চার দিকে হামেশাই শোনা যাচ্ছে। অথচ, প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্ঞানচর্চা এবং শিক্ষাপদ্ধতি যে কতটা উন্নত ছিল, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। নালন্দা, তক্ষশীলা প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার জ্ঞানপিপাসু ছাত্র বিদেশ থেকে ভারতে এসে সমৃদ্ধ হয়ে ফিরে গিয়েছেন নিজ দেশে। ভারতীয় শিক্ষার আদর্শ কখনও একটি সীমিত গণ্ডির মধ্যে মানুষকে আবদ্ধ করতে শেখায়নি।

বর্তমানে রাজ্য সরকারগুলি যে নীতি গ্রহণ করেছে জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে সেটি হল— জাতীয় শিক্ষানীতিকে মেনে নিয়েও প্রতিটি রাজ্য কর্তৃক তাদের রাজ্যের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন বিষয়ে সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া। বিভিন্ন রাজ্য থেকে যে প্রস্তাবগুলি সংশোধনের জন্য দেওয়া হয়েছে, এই মুহূর্তে প্রয়োজন সেগুলির বিচার বিশ্লেষণ করে সহমতের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষানীতিকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা। ভারতীয় দর্শন, ভারতীয় শিক্ষার আদর্শ, ভারতীয় মনীষীদের চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করেই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে এবং অবশ্যই বিদেশের ভালটিকেও গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এর বিপরীতটা না হওয়াই কাম্য।

সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি

শিক্ষার পরিবেশ

সাম্প্রতিক কালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির যা অবস্থা, তাতে বলা চলে— শুধুমাত্র খাতায় কলমে নয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত এবং ধারাবাহিক ভাবে অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটির পর্যালোচনা মিটিং করতে হবে। কমিটির মধ্যে যে-হেতু সংশ্লিষ্ট কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ইনচার্জ, অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধি থাকেন, তাই মিটিংগুলি নিয়মিত সংগঠিত হলে বর্তমান পরিস্থিতির বিচার, এবং দলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তা সহায়ক হয়ে উঠবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্রছাত্রীরা প্রাক্তন এবং বহিরাগত, দলীয় রাজনীতির আনুগত্য দ্বারা প্রভাবিত কিছু অবাঞ্ছিত ব্যক্তির দাদাগিরি, ভয় দেখানো এবং র‌্যাগিং-এর শিকার হয়েও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। পরিবারের কাছেও অনেক সময় নিজেদের নিরাপত্তা হারানোর ভয়ে ঘটনাগুলি চেপে যায়, পাছে ইউনিয়নের দাদাদের চোখরাঙানি আরও বেড়ে যায়।

রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে আমরা আতঙ্কিত। এ ধরনের ঘটনা কি চলতে দেওয়া যায়? আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা যাতে সুস্থ পরিবেশে পড়াশোনা চালাতে পারে তার সুনিশ্চিত ব্যবস্থা করা‌ কি সংশ্লিষ্ট কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন সমিতি কিংবা অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? দীর্ঘ দিন ধরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়াও একটা সমস্যা। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন করা অবশ্যই প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বোপরি উচ্চ শিক্ষা দফতরের পক্ষ থেকে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

‌ মুস্তাক আলি মণ্ডল, আমতা, হাওড়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education system Educaton

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy