Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: খুঁজে ফিরি স্নেহস্পর্শ

মনের জোর অপরিসীম বেড়ে যেত এই সব কথায়। পরীক্ষার পর প্রশ্নপত্রের পাশে উত্তর লিখে এনে বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতাম ঠিক হয়েছে কি না।

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:৪৮
Share
Save

‘শাসন করা তারেই সাজে’ (২২-১) প্রবন্ধের মাধ্যমে লেখিকা ঈশা দাশগুপ্ত পুরনো দিনে ফিরিয়ে দিলেন। ছোটবেলায় অঙ্কের মাস্টারমশাই যে ভাবে অঙ্ক করাতেন সেই অঙ্ক আমরা অনেকেই বুঝতে পারতাম না। ভয়ে অঙ্কের ক্লাস না করার ফন্দি-ফিকির বার করতাম। এক দিন অঙ্কের মাস্টারমশাই ডেকে পাঠালেন টিচার’স রুমে। দুরুদুরু বুকে গিয়ে দাঁড়ালাম। অত্যন্ত স্নেহের সুরে বললেন, “কাজটি কি ভাল হচ্ছে, বাবা? পরীক্ষায় তো ফেল করবে।” মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “ছুটির পর এক ঘণ্টা করে আমার কাছে অঙ্ক শিখবে।” এই ভালবাসা আর কোথায় পাব? এক বার পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান দখল করেছিলাম। ভয়ে কাঁদছি... বাড়িতে বলেছিলাম প্রথম হব। মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে ইতিহাসের মাস্টারমশাই বলছেন, “আগামী পরীক্ষায় হয়ে যাবে। আমরা তো আছি।”

মনের জোর অপরিসীম বেড়ে যেত এই সব কথায়। পরীক্ষার পর প্রশ্নপত্রের পাশে উত্তর লিখে এনে বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতাম ঠিক হয়েছে কি না। আমার স্কুলের এক মাস্টারমশাই বলেছিলেন, যে পরীক্ষায় উত্তর লেখা শেষ হয়ে গিয়েছে, তার ঠিক-ভুল নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আগামী পরীক্ষা যাতে আজকের পরীক্ষার চেয়ে আরও ভাল হয় তার চেষ্টা করো। এই সব মনে পড়লে এখন বুঝতে পারি তখন শিক্ষকদের এই স্নেহের মধ্যেই লুকিয়ে থাকত অভিভাবকত্ব, শাসনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতেন আগামী দিনে ঠিক পথে চলার দিশা।

চারিদিকে এক নৈরাজ্যের বাতাবরণ। শিক্ষা আজ পণ্য, বিভিন্ন মূল্যে বিক্রি হয়। তাই বুঝি আজ তাঁদের কথা বড় বেশি মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে, কেন এক অন্য পৃথিবী দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম ধীরে ধীরে? কোথায় গেল সেই সোনার সময় আর মানুষেরা?

তমাল মুখোপাধ্যায়, ডানকুনি, হুগলি

আত্মীয়-বন্ধন

ঈশা দাশগুপ্তের লেখা ‘শাসন করা তারেই সাজে’ প্রবন্ধটি এই সময়ের প্রতিযোগিতামূলক সমাজের সম্পর্কগুলিকে মানবিক দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষণ করল। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য পথ হবে অযান্ত্রিক, অনুভূতিশীল। এই সময়ের শিক্ষার্থীদের উপর সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য অস্বাভাবিক ভাবে মানসিক চাপ বাড়ছে। আমাদের স্নেহের পরশই হবে ওদের এগিয়ে চলার প্রেরণা।

প্রসঙ্গত, আমার শিক্ষকজীবন আড়াই দশক পেরিয়েছে। আমি মনে করি, আমার ছাত্রদের সঙ্গে এক অন্য রকম আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছি। কারণ ক্লাসরুমের সীমা ছাড়িয়ে উন্নত জীবনের পথের রাস্তা আমরা ভাগ করে নিয়েছিলাম। মহাবিদ্যালয়ের সেই ছাত্রটি আমাকে আজও মনে রেখেছে যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে পরীক্ষার জন্য ধার্য অর্থ মকুবের ব্যবস্থায় উদ্যোগী হয়েছিলাম।

লেখক কর্পোরেট সংস্কৃতির মাঝে যে মানবিকতার অনুশীলনের কথা বলেছেন, তাই আমাদের ব্যবহারিক ভাবে শিখিয়ে গিয়েছেন সারদা মা, লালন ফকির। এত আধুনিকতার ঔজ্জ্বল্যের মধ্যেও আজ প্রকট মানসিক দর্শনের অন্ধকার। তার কারণ, মানবিক মূল্যবোধগুলিকে ঠিক ব্যবহার না করার অন্যায়। এই শুভবোধের বিতরণ কিন্তু খুবই ইতিবাচক ও সুদূরপ্রসারী হতে পারে। তার উদাহরণে একটি ঘটনা জানাই। এক দিন অজানা নম্বর থেকে ফোন এল। অন্য বিভাগের ছাত্র আমার কাছে তার প্রয়োজনীতা জানাল, কারণ জানতে চাইলে এক অসাধারণ উত্তর এল, “স্যর, মনে হল কথাগুলো আপনাকেই বলা যায়।”

এ ভাবেই মনের ডানা বিস্তার করতে পারলে তো শুধু পথের সন্ধানই মেলে না, কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় অতি সহজে।

আব্দুল জামান নাসের, চন্দননগর, হুগলি

স্বচ্ছ ধারণা

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেল প্রথা চালু হবে। সেখানে বলা হয়েছে কোনও পড়ুয়া যদি পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে অকৃতকার্য হয় তা হলে সে দু’মাস পর আবার এক বার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে এবং তার পরেও যদি সে উত্তীর্ণ না হতে পারে তা হলে তাকে সেই ক্লাসেই রাখা হবে। এই সিদ্ধান্তের পর শিক্ষকসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে।

যদিও একটিমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সারা বছরের পরিশ্রমের মূল্যায়ন করা যায় না, তবুও তার প্রস্তুতির একটা ছবি নিশ্চয়ই ফুটে ওঠে। তা ছাড়া, এই নিয়মে এও বোঝা যায়, আগামী দিনগুলির জন্য শিক্ষার্থীকে কতটা প্রস্তুত করে তোলা প্রয়োজন। এ কথা অনস্বীকার্য, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য অবশ্য শুধুমাত্র পরের ক্লাসে ওঠাই নয়, কিন্তু এই প্রক্রিয়া যদি সহজ থেকে সহজতর হয়ে যেতে থাকে, তা হলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে জ্ঞান অর্জন এবং শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ, তাও নিশ্চয় অধরাই থেকে যাবে।

২০০৯ সালে ভারতে ‘নো ডিটেনশন পলিসি’ চালু হয়েছিল। তার ফলে শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অকৃতকার্য হলেও নতুন শ্রেণিতে উঠে যেতে পারত। কিন্তু ২০১৯ সাল নাগাদ সংশোধিত আইন দ্বারা পাশ-ফেল ফিরবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাজ্যগুলিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। নিয়মগুলিকে শিথিল করা হয়েছিল প্রধানত স্কুলছুট কমানোর জন্য। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষাব্যবস্থাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার একগুচ্ছ প্রকল্প নেয়। কিন্তু বিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেখা গিয়েছে, অনেক শিক্ষার্থীই সেই সব প্রকল্পের সুযোগ নিলেও বিদ্যালয়ে তাদের উপস্থিতি বা ক্লাসরুমে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল অতি বিরল। ফলে তা চিন্তার কারণ। অতিমারির পর একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোনের প্রতি আকর্ষণ একটু বেশিই বেড়েছে এবং এই বয়সে শিক্ষার্থীরা তার ইতিবাচক ব্যবহারের তুলনায় নেতিবাচক ব্যবহারই বেশি করছে। তাই আজ নবম বা দশম শ্রেণির পড়ুয়া নতুন শ্রেণিতে এসে আগের শ্রেণিতে পড়া বিষয় এবং ধারণার সঙ্গে সংযোগস্থাপন করতে পারছে না, যা কখনওই কাম্য নয়। যদিও পাশ-ফেল না থাকায় সেই বিষয়গুলিকে না পড়েও সহজেই সে পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে গিয়েছে।

শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বিষয়কে তখনই সহজে অনুধাবন করতে পারে যখন তারা সেই বিষয়টিকে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে একটি সামগ্রিক ধারণা তৈরি করতে পারে এবং বিষয়টিকে বাস্তব জীবনের সঙ্গে জুড়তে পারে। ফলে শিক্ষার্থীর মানসপটে সমগ্র বিষয়ের এক সুস্পষ্ট চিত্র তৈরি হয়। পাঠ্য বিষয় আর কঠিন মনে হয় না বরং আগ্রহের কারণ হয়ে ওঠে। এটা কিন্তু তখনই সম্ভব যখন সেই শিক্ষার্থীর কাছে আগের ক্লাসে পড়ে আসা সমস্ত বিষয়ের প্রতি স্বচ্ছ এবং সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। কিন্তু পাশ-ফেলের বালাই না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবশত অষ্টম শ্রেণি অবধি গুরুত্ব দিয়ে পড়াশোনা করে না।

তাই এই নতুন নীতি চালু করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিষয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। এক জন অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে দু’মাসের মধ্যে পাশ করাতে গেলে তাকে কিছুটা বিশেষ সময় দেওয়ার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকার এত অভাব যে, এমনিতেই প্রায় সমস্ত শিক্ষককেই অতিরিক্ত পরিমাণে ক্লাস নিতে হয়। ফলে দু’মাসের মধ্যে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে পাশ করানোর জন্য কতটুকু অতিরিক্ত সময় তাঁদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব, সেই বিষয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়।

তাই শিক্ষার সার্বিক বিকাশ ঘটাতে মূল্যায়নের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এনে সকল শিক্ষার্থীর বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি মৌলিক ধারণা এবং জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তা হলে সমস্ত শিক্ষার্থী উঁচু ক্লাসে উঠে এর সুফল পাবে।

সৌম্যজিৎ দত্ত, সিউড়ি, বীরভূম

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}