সেবন্তী ঘোষের ‘নিরীশ্বর বাঙালির ঈশ্বর’ (রবিবাসরীয়, ১১-৫) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। তিনি সাধক, আবার প্রেমিকও। বাঙালির প্রতিক্ষণের পাংশু যাপনে তাঁর সৃষ্টি আজও শুশ্রূষার মতো, তা দেখায় স্বপ্ন ও উজ্জীবনের আলো। আজকের সামাজিক সঙ্কট, যুদ্ধ, বিপ্লবে তাঁর রচনা অকম্প, অনির্বাণ। নিষ্কম্প বাণীর মতো তাঁর গান ও কবিতা। তিনি অপরিহার্য। তিনি মানবপ্রেমিক, মানবজাতি বিষয়ে অশেষ তাঁর হিতৈষণা।
আজও আমাদের উৎসবে, আনন্দে, সমন্বয়ে, সঙ্কটে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গ এক সুন্দরের অনিবার্য বন্দনা। আজকের বিপন্ন সংশয়ী সংহতির দিনে তাঁর রচিত জাতীয় সঙ্গীতের পঙ্ক্তি জাতীয় সংহতিবোধকে জাগিয়ে তোলে। “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটি আদর্শবাদী দেশপ্রেমিকের আত্মোৎসর্জনের আবেগকে স্মরণ করায়। ইদানীং বড্ড মনে পড়ে “কেন চেয়ে আছ, গো মা...” গানটির কথা। আধুনিক ভিন্ন সময়ে দাঁড়িয়েও মনে হয় এ গান কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক! স্বদেশের অমানবিক সমাজ-পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আজও বিদ্রোহের বাণ নিক্ষেপ করে তাঁর লেখা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। সেই সঙ্গে তাঁর স্বাদেশিক অনুভবে ব্যক্ত “আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না। এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা?”-র আবেদনও অম্লান চিরন্তন।
রবীন্দ্রনাথ প্রবহমান সমাজে চলমান মানবজীবনের মধ্যেই ইতিহাসের প্রাণস্পন্দন খুঁজে বেড়িয়েছিলেন। সেখানে রাজা বাদশা নয়, সাধারণ মানুষের জীবনই ইতিহাসের অমূল্য উপকরণ হিসাবে ধরা দিয়েছে। দারিদ্র-লাঞ্ছিত শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, “ওরা কাজ করে/ দেশে দেশান্তরে,/ অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে,/ পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে।/ গুরুগুরু গর্জন গুন্গুন্ স্বর/ দিনরাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর।”
আসলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বজনের স্বতঃপ্রাপ্ত আশ্রয়। রক্তমাংসের মানুষকে তিনি ভোলেননি। তাই তো তাঁর সৃষ্টিও সব অসাধারণ, প্রাণোচ্ছল। তাঁর ছিন্নপত্র একই সঙ্গে ব্যক্তিগত, আবার সার্বিক। তিনি চিরনূতন, অফুরন্ত রূপে আজও পাঠযোগ্য। তাঁর সোনার তরী-র সোনার ধানে আজও আমাদের পুষ্টি, আজও আমাদের কল্যাণ। আবার নারীমুক্তিতে আজও পথ দেখায় মৃণাল (‘স্ত্রীর পত্র’)। ব্যক্তিত্বে স্বকীয়, সদা উচ্চশির চারুলতা (‘নষ্টনীড়’), কুমুদিনী (‘দৃষ্টিদান’)। ধনঞ্জয় বৈরাগী (‘মুক্তধারা’) ও বিশুপাগল (‘রক্তকরবী’) আজও মানুষকে মুক্তির পথে এগিয়ে দেন। আর ধনবাদী সভ্যতার প্রতীক, মানবসভ্যতার কণ্ঠরোধকারী সঞ্চয়প্রবণ অর্থ গৃধ্নু রাজা (‘রক্তকরবী’) যেন চিরদিনই ধিক্কৃত হয়েই রইলেন।
রবীন্দ্রনাথ আজও আত্মসঙ্কটে পথ দেখান। তাঁর নানা রচনায় উঠে আসা হিংসাত্মক জাতীয়তার বিরুদ্ধে ঘোষিত প্রতিবাদ আজও আমাদের ভাবায়। তাঁর সৃষ্ট গোরা, চতুরঙ্গ আজও আমাদের অনেকেরই দিশা ও আশ্রয়স্থল। বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ রচনায় ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন, “বাংলা সাহিত্যে আদিগন্ত ব্যাপ্ত হ’য়ে আছেন তিনি, বাংলা ভাষার রক্তে-মাংসে মিশে আছেন ;... রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা, ব্যবহার্যতা ক্রমশই বিস্তৃত হ’য়ে, বিচিত্র হ’য়ে প্রকাশ পাবে বাংলা সাহিত্যে।”
সুদেব মাল, তিসা, হুগলি
জীবনদেবতা
সেবন্তী ঘোষের লেখা ‘নিরীশ্বর বাঙালির ঈশ্বর’ পড়ে মুগ্ধ হলাম। কবিগুরুর সাধের শান্তিনিকেতনে পড়তে আসা একটি মেয়ে চলার পথে বাঁকে বাঁকে পেয়েছে তাঁর সান্নিধ্য— গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের মাধ্যমে। তিনি তো সমস্যা জর্জরিত জীবনের আলোকবর্তিকা। বাঙালি জীবনের সকল খেলায় সবার অলক্ষ্যে তিনি খেলা করে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের সময় আমি বাংলা পড়তে বা লিখতে জানতাম না। এক দাদার মুখে ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আবৃত্তি করতে গিয়ে মনে মনে মায়ের সঙ্গে চলে যেতাম অনেক দূরে— “আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে/ টগ্বগিয়ে তোমার পাশে পাশে।”
অজানতেই শিশুমন ভাবতে শুরু করত আমি প্রচণ্ড শক্তিশালী, মায়ের প্রহরী। অস্ত্র হাতে ডাকাতদলকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছি। কিন্তু তাঁর ‘ঠাকুর’ পদবি শোনার পর মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি ঠাকুরের সিংহাসনে নেই কেন! মা তখন ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, “তিনি যে রবীন্দ্রনাথ!” আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, কিন্তু মহামানব। বড় হয়ে তাঁর কথা যত জেনেছি, তাঁর লেখা যত পড়েছি, তাঁর গান যত শুনেছি তত মনে হয়েছে তিনি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও চেতনার অবিভাজ্য অংশ, বিশ্বমানবতার আত্মার আত্মীয়। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, উৎসবে-অনুষ্ঠানে বাঙালির রবীন্দ্রনাথ ছাড়া গতি নেই। তিনি কালজয়ী, তিনি চিরনতুন। তাঁর জীবনের মৃত্যুশোক, অজস্র অপমান, দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট, সমালোচনা কিছুই তাঁর জীবনসূর্যকে অবনমিত করতে পারেনি। তাঁর কলমকে থামিয়ে দিতে পারেনি। বরং এগুলো তাঁর লেখনীকে শাণিত করেছে। এই বৈশিষ্ট্য শুধু আমার জীবনের প্রেরণা নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রেরণা। এই মহান পুরুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাম্য ও মানবতার মূর্ত প্রতীক।
গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে যখন ধর্মীয় মেরুকরণ মাথাচাড়া দেয়, তখন তিনি বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের গোরা কুসংস্কার, জাতিভেদ, ধর্মানুশাসনে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে, কঠিন দুঃখের মধ্য দিয়ে এক দিন পরম সত্যকে আবিষ্কার করেছিল। বাঁধ ভেঙে সে ভাসতে পেরেছিল ভারতীয়ত্ব তথা বিশ্বমানবতার প্লাবনে। কবির দেখানো পথের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন জাগে, কবে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে ঠিক ভাবে জানবে! তবেই তো অকারণ হিংসা-বিদ্বেষ মুছে গিয়ে সকলের পরিচয় হবে, ভারতীয়।
চোখের সামনে অন্যায় হতে দেখেও যাঁরা মুখ ঘুরিয়ে চলে যান, তাঁদের উদ্দেশে কবির সতর্কবাণী— “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।” এই বাণী আমাকে অন্যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে সাহস জোগায়। কোনও কাজে অন্যকে পাশে না পেয়ে যখন হতাশ হই, তখন রবীন্দ্রনাথের গান “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে”-ই হয়ে ওঠে আমার এগিয়ে চলার মন্ত্র। তাঁর কালজয়ী অবিস্মরণীয় গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ আমাদের জীবন ডায়েরির ছত্রে ছত্রে আনন্দের ঢেউ তোলে। রাজ্যে ঘটে চলা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্নীতিতে যখন মানুষের শান্তি বিঘ্নিত, তখন রবীন্দ্রনাথই আমাদের আশ্রয়। তিনি চিরদিন আছেন আমাদের হৃদয়ে, আমাদের চেতনায়। তিনি বিশ্বমানবতার প্রতীক।
বিশ্বে যখন এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধ চলছে এবং সেই যুদ্ধে নিরপরাধ মানুষ, নারী, শিশু মারা যাচ্ছে, গৃহহারা হচ্ছে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পাচ্ছে, কাশ্মীরে যখন জঙ্গিদের ধর্ম চিহ্নিতকরণ করে হত্যা ভারতকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, রাজ্য যে ভাবে এখনও নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে জটিল ও বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে, সব ক্ষেত্রে আমাদের সামনে আবারও জেগে ওঠে তাঁর লেখনী। “বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি/ শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে/ ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।” এই গানটি বর্তমান বিশ্ব তথা দেশ তথা রাজ্যের পরিস্থিতির পক্ষে বড্ড প্রাসঙ্গিক। ঠিক যেমন সর্বার্থে প্রাসঙ্গিক তার স্রষ্টা।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
বড় ভরসা
সম্পাদকীয় ‘খোলাখুলি’ (১৪-৪) প্রসঙ্গে কিছু কথা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিচারপতিদের সম্পত্তির হিসাব প্রকাশ্যে আসবে। এই ব্যবস্থাকে জনগণ মুক্তকণ্ঠে প্রশংসায় ভরিয়ে তুলেছে। এই পদাসীন ব্যক্তিরা সর্বার্থে সর্বজনমান্য, তাঁদের নিষ্কলঙ্ক ভাবমূর্তি গণতন্ত্রের প্রতি ভরসা জোগায়।
মানিক কুমার বসু, কলকাতা-১০৮
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)