‘বিদ্বেষের মূলে’ (২-৭) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। সম্প্রতি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি বা বাংলাভাষীদের উপর চরম আক্রমণ নেমে আসছে। প্রশাসন বাঙালিদের বাড়ি-ঘর ভেঙে দিচ্ছে, আটক করে থানায় নিয়ে যাচ্ছে। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড থাকা সত্ত্বেও গরিব বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রচুর হিন্দিভাষী মানুষ বংশপরম্পরায় বাংলায় বসবাস করলেও, তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভাবটি হয়তো অনুপস্থিত থেকে গিয়েছে। যে কারণে কেন্দ্রীয় শাসক দলের আইটি সেল-এর প্রচারের কল্যাণে এক বিকৃত বাংলা বিদ্বেষ জন্ম নিতে দেখা যাচ্ছে। এ ভাবে চললে, অদূর ভবিষ্যতে এই অভ্যাসটি যে আরও বৃহত্তর এবং গভীরতর বাঙালি-বিদ্বেষের জন্ম দেবে, এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মনে হচ্ছে, দেশ জুড়ে বাঙালিদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ তকমা লাগিয়ে দেওয়াই আসল লক্ষ্য, হিন্দুত্ববাদী শক্তির বাংলা দখল করা। তাঁরা ভাবছেন, বাঙালির মধ্যে হিন্দু-মুসলমান জিগির তুলেও যে বিভেদ আনা সম্ভব হচ্ছে না, অনুপ্রবেশকারী আতঙ্ক ছড়িয়ে সেটা হয়তো হতে পারে। তবে এই হিন্দুত্ববাদী নেতারা কি এক বারও ভেবেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে ভিন রাজ্যের অসংখ্য মানুষ বাণিজ্য ও কাজের প্রয়োজনে বসবাস করলেও, বাঙালি কখনও তাঁদের হেনস্থা করেনি?
এক সময় পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, অসম, ত্রিপুরা ছাড়া বিহারের কিছু অংশে বাংলা ভাষা সংস্কৃতির প্রচলন ছিল। কলকাতা ছিল বাংলা ভাষার প্রাণকেন্দ্র। অথচ, বাংলার এমন অবনতির সময়ে রাজ্যবাসীর তেমন হেলদোল নেই। কিছু রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে প্রতিবাদ করলেও, ভিন রাজ্যে বাঙালিদের হেনস্থা নিয়ে এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ মোটেই ভাবিত নন। এমনিতেই মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালিরা কেবল অনীহাই নয়, প্রায় অশ্রদ্ধার মনোভাব দেখিয়ে এসেছে। সেই ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ কি আদৌ নিজেদের পরিচয় নিয়ে আন্দোলনে ব্রতী হবে?
রবীন রায়, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
বাংলার হাল
‘রাজনীতির মার’ (১৮-৭) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া বাঙালি শ্রমিকদের নানা প্রকারের নির্যাতন সইতে হচ্ছে। যার অন্যতম উদাহরণ— দিল্লিতে ছ’জনের পরিবার সমেত একটি দলকে জোর করে বিএসএফ-এর সাহায্যে পুলিশের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া। কী তাঁদের অপরাধ? বাংলা ভাষায় তাঁরা কথা বলেন। এক শ্রেণির মানুষের কাছে এঁরা নাকি ‘বাংলাদেশি’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’। বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক। দেখতে গেলে, বিজেপিশাসিত রাজ্যেই এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। তা হলে কি ধরে নিতে হবে এক সময়ের অসমের ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের স্মৃতি গোটা দেশে ফিরিয়ে আনতে একটা শ্রেণি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে? অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা তো পরিষ্কার বলে দিয়েছেন— অসমে কেউ যদি বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তা হলে তাকে ‘বাংলাদেশি’ হিসাবেই ধরে নিতে হবে। ইতিমধ্যে ওই রাজ্যে নাকি বাঙালি দেখলেই এনআরসি নোটিস পাঠানো শুরু হয়েছে। তিনি এক অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন— জনগণনার সময় কেউ যদি বাংলা ভাষার কথা উল্লেখ করেন, তাতে বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা নির্ধারণ করা সহজ হবে।
ভারতে এমন অনেক ভাষা আছে, যেটা পাকিস্তানেও চলে। যেমন পঞ্জাবি, সিন্ধি, উর্দু ইত্যাদি। তা হলে ভারতে বাস করে এই সব ভাষায় কেউ যদি কথা বলেন, তা হলে তাঁকে কি সেই দেশের অধিবাসী বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে? ইংরেজি ভাষাভাষীর মানুষ হলে তাঁকে কি ব্রিটেন কিংবা আমেরিকার নাগরিক বলা হবে? বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কিছু মানুষের এই ধরনের মানসিকতা শুধু অন্যায় নয়, সভ্যতার সীমা বহির্ভূত আচরণও বটে।
রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
লক্ষ্যভ্রষ্ট
‘রণক্ষেত্র প্রস্তুত’ (২৩-৭) সম্পাদকীয়তে সঠিক ভাবেই বলা হয়েছে যে, বাঙালি পরিচিতির বিষয়ে অ-বাঙালি, বিশেষত কেন্দ্রীয় বিজেপির ধারণা নিতান্তই অস্পষ্ট। আর এই ধারণা অস্পষ্ট বলেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর দুর্গাপুরের সভায় তাঁদের রাজনীতির প্রতীকে পরিণত হওয়া ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান সরিয়ে রেখে ‘জয় মা দুর্গা’, ‘জয় মা কালী’ উচ্চারণ করে ভাবলেন বোধ হয় বিজেপি রাজনীতির বাঙালিকরণ ঘটে গেল। বাস্তবে বিজেপি নেতারা কখনও বাঙালি পরিচিতিকে বোঝার চেষ্টা করেননি। রাজ্যের নেতারাও স্বাধীন চিন্তা বিসর্জন দিয়ে সব সময় দিল্লির নেতাদের বেঁধে দেওয়া রাজনৈতিক বুলিই আওড়ে গেছেন। তাঁদের মনে এই ভাবনাই দৃঢ়, যে অস্ত্রে তাঁরা উত্তর ভারত জয় করেছেন, সেই একই অস্ত্রে বাংলাও জয় করবেন। তা সে রাজ্যে বিরোধী দলনেতার ‘হিন্দু ঐক্য’র স্লোগানই হোক, কিংবা রামনবমীতে সশস্ত্র মিছিলে রাজ্য সরগরম করে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এই সব অস্ত্রে যে বাংলা জয় সম্ভব নয়, হয়তো প্রধানমন্ত্রী এবং দলের অন্য নেতারা কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কিন্তু তাতেও যে মূল চিত্রটি বদলায়নি, তা প্রধানমন্ত্রীর ‘জয় মা দুর্গা’, ‘জয় মা কালী’ উচ্চারণেই স্পষ্ট।
বাস্তবে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার সামাজিক সংস্কৃতির ফারাক ঠিক কোন জায়গায়, তা বিজেপি নেতারা বুঝতে পারবেন না, কারণ তাঁদের গায়ে উগ্র হিন্দুত্বের পোশাকটি জড়ানো রয়েছে। তাঁরা যদি বাংলা জয়ে ঝাঁপানোর আগে বাংলার সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করতেন, তবে দেখতে পেতেন, এ রাজ্যের এক কালের ব্রিটিশ রাজধানীকে কেন্দ্র করে এক দিকে পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষা এবং অন্য দিকে ব্রিটিশ-বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ বিশিষ্ট চিন্তাবিদ যেমন বাংলার সমাজে নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছিলেন, তেমনই সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুলের মতো প্রণম্য ব্যক্তিত্ব বাঙালির নতুন মনন গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। এই ধারাতেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এসেছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। রাজনীতির ক্ষেত্রে সশস্ত্র বিপ্লবী ধারার পাশাপাশি অহিংস ধারাতেও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মতো নেতারা এসেছেন, যাঁরা সর্বভারতীয় স্তরের অন্য নেতাদের থেকে চিন্তায়-ভাবনায় ছিলেন অনেকটাই পৃথক। বাংলার মন আজও এঁদের ভাবনায় জারিত। অথচ, বিজেপি নেতারা এই ধারাটিকে কখনও তাঁদের ধারা হিসাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তার কারণ, শুরু থেকেই এই মূল ধারার পাশাপাশি ক্ষীণ হলেও যে হিন্দুত্বের ধারাটি বর্তমান ছিল, আজকের বিজেপি সেই ধারারই ফসল। তাই বিদ্যাসাগরকে গ্রহণ করা দূরে থাক, তাঁর মূর্তি ভাঙতে তাঁদের হাত এতটুকু কাঁপে না। তাঁরা ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ থেকে ধুলো ঝেড়ে বার করে আনেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। অথচ, এ রাজ্যে তিনি এক সাম্প্রদায়িক নেতার বেশি গুরুত্ব কোনও দিনই পাননি। হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতার হীনম্মন্যতাও বোধ হয় বিজেপি নেতাদের এখনও তাড়া করে ফেরে। স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালি কিন্তু কখনও এই সংগঠনগুলির স্বাধীনতা আন্দোলন-বিরোধী ভূমিকাকে ভাল চোখে দেখেনি। বর্তমান বিজেপি নেতৃত্ব মনেপ্রাণে সেই পুরনো ধারারই ফসল। স্বাভাবিক ভাবেই এই সব অ-বাঙালি নেতার বাঙালি পরিচয়ের চেষ্টা যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত, তেমনই অন্ধের হস্তিদর্শনের মতোই খণ্ডিত। বাস্তবে বাঙালি সংস্কৃতিকে বুঝতে গেলে বিজেপি নেতাদের অনেক কিছু ছাড়তে হবে। তা কি তাঁরা পারবেন?
সমর মিত্র, কলকাতা-১৩
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)