‘পার্ক বাড়ছে, কমছে মাঠ’ (২৮-৫) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রবন্ধকার প্রসেনজিৎ সরখেল আমাকে ষাটের দশকে পৌঁছে দিয়েছেন। এখনও মনে পড়ে সেই সদ্য কৈশোর পেরোনো সময়ের কথা। বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে অনেক সময় আমরা কয়েক জন বন্ধু শ্রীরামপুর-আদালত প্রাঙ্গণের মাঠে স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলার পর, পাশেই ১৭৮৬ সালে দিনেমার প্রশাসক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পুকুরের শান-বাঁধানো ঘাটে নেমে, ঢেউ খেলানো জলে হাত-পা ধুয়ে ঘরমুখো হতাম। ১ মে ১৯৮৫-তে, পুকুরটিকে সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিলান্যাস করেছিলেন সেই সময় রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী। পুকুরপাড়ে বাঁধানো শ্বেতফলকটি এখনও আছে। এখন সেই পুকুরের বাঁধানো ঘাট আর টলটলে জল আগাছায় মুখ ঢেকেছে। কারণ, ঘরে-ঘরে নলবাহিত জলের প্রাচুর্যের জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকার খেটেখাওয়া মানুষদের কাছে এই পুকুরের আর প্রয়োজন নেই। আর আদালত প্রাঙ্গণের সেই মাঠ এখন প্রতি বর্ষায় আগাছায় ভরে যায় ও জমা জলে সদ্য জন্মানো মশককুল সেই আগাছার ফাঁকে ফাঁকে লাফালাফি করে।
সেই সময় পড়ন্ত রোদের বিকেলে পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলার পর, সেই বল পাড়ার যে কোনও পুকুরের টলটলে জলে ছুড়ে দিয়ে আমরা ঝাঁপাই জুড়তাম। প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন, কয়েক দশক আগেও পাড়ার মাঠগুলি ছিল কমবয়সিদের সামাজিক মেলামেশার অবাধ ক্ষেত্র। বড় মাঠ মানেই ফুটবল বা ক্রিকেট, আর ছোট জায়গায় চলত গাদি, হাডুডু-র মতো দেশীয় খেলা, যা আজকের গ্যাজেটমুখী স্বল্পবাক প্রজন্মের কাছে কল্পনারও অতীত।
এমন সময় তাই নতুন প্রজন্মকে কৃত্রিম উপায়ে শারীরিক সৌষ্ঠব বজায় রাখার মোহতে আবিষ্ট করিয়ে, শহরে খেলার মাঠ কমিয়ে, বিলাসিতার ছোঁয়া লাগানো পার্কের সংখ্যা বাড়িয়ে আমরা এক অদ্ভুত বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিচ্ছি বইকি। গত কয়েক দশক ধরেই শহরতলির অসংখ্য খেলার মাঠ ও পুকুর দখল করে গড়ে উঠছে আবাসন। এর শেষ কোথায়, কে তা বলতে পারে!
প্রসন্নকুমার কোলে, শ্রীরামপুর, হুগলি
ব্যবসাসর্বস্ব
প্রসেনজিৎ সরখেলের ‘পার্ক বাড়ছে, কমছে মাঠ’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। প্রবন্ধকার এখানে খেলার মাঠের কথা বলেছেন। খোলা জায়গা, প্রান্তর ও মাঠ, যেখানে ছেলেমেয়েরা খেলে, অন্যরা ইচ্ছেমতো বসেন, গল্পগুজব করেন, তাস বা অন্য কিছু খেলেন— সে ধরনের মাঠ শহরের আশেপাশে কিছু আছে। তবে সংখ্যা বড়ই কম। গ্রামে হয়তো কিছু বেশি।
বারাসতে কাছারি মাঠের এক পাশে রেলিং আর চেয়ার পেতে একটু পার্কমতো করা হয়েছে। সাধারণ সময়ে সকালে ও বিকালে কিছু স্বাস্থ্যসন্ধানী ছেলেমেয়ে ও প্রবীণরা আসেন। মাঠটি এখন অদৃশ্য কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত। বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন খেলা বা কার্যক্রম চলে। যেমন— এক পাশে জিমন্যাস্টিক্স করার সামান্য ব্যবস্থা আছে। কিছু মানুষ ওই সরঞ্জামগুলি ব্যবহার করেন। মাঠের লাগোয়া রাস্তার দু’পাশে বাজার বসে। ক্রেতা-বিক্রেতারাও মাঠে যাওয়া-আসা করেন। মাঠের এক পাশে মুক্ত টয়লেট।
শেঠপুকুর মাঠ এখন পার্কে পরিণত। উঁচু রেলিং ও তালাচাবিতে রুদ্ধ। সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়। পায়োনিয়ার মাঠ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সেখানে খেলা হয়। তবে এই মাঠ মূলত ব্যবসা করার স্থান— সার্কাস, মেলা, রথযাত্রা উৎসব, কালীপুজোর উৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। মাঠের এক পাশে এখন সিমেন্ট পিচে ক্রিকেট-শিক্ষার ব্যবসা শুরু হয়েছে। কালীপুজোর সময় রেলস্টেশন যাওয়ার রাস্তা প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে যায়। পার্কের মাঠ আর খেলার মাঠ নয়। অধিকাংশ সময়ে বিয়ের শামিয়ানা, পুজোর প্যান্ডেল বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকে। উৎসবের সময় স্থানীয় লোকজনের অশেষ দুর্গতি হয়। বাড়ি ঢুকতে বেরোতে যেন পাসপোর্ট-ভিসা লাগে। এ ধরনের মাঠ আরও বেশ কয়েকটি আছে। কিন্তু প্যান্ডেলের পেরেক, তার, অবাঞ্ছিত কাপড়, পলিমার, রং, কার্ডবোর্ডে সেই মাঠের মাটি-ঘাস প্রায় উধাও। সাদা বালির প্রলেপ দিয়ে ঢাকা।
নেতাজি অ্যাথলেটিক ক্লাব প্রাঙ্গণে এক সময় প্রচুর খেলা হত। এখন কেউ আর খেলে না। কিছু ছেলে মাঝেমধ্যে ক্রিকেট খেলে। মাঠে প্রতি বছর চার দিন ধরে নাট্যগোষ্ঠীর আয়োজনে বিরাট নাটক উৎসব হত। আমরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম। আর হয় না। মাঠ এখন রেলিং ঘেরা পার্ক। এক পাশে রায়বাড়ির প্রায় মৃত পুকুর। পুকুর বোঝাই করা চলছে প্লাস্টিকের আবর্জনায়। পার্কে মানুষ নেই। সুভাষ মাঠ সরকারপোষিত মাঠ। সারা বছর ক্রিকেট আর কিছুটা ফুটবল খেলা হয়। আলো জ্বেলে, শব্দদূষণ করে রিয়ালিটি গেম শো-ও হয়। টাকার বিনিময়ে খেলা-শিক্ষা উপলব্ধ। সকালে কিছু ক্ষণ স্থানীয় ক্ষমতাবান মানুষদের দেহচর্চার সুযোগ মেলে। সর্বসাধারণের মাঠ নয়।
প্রভাতী সঙ্ঘ-এর একচিলতে খেলার মাঠ এখন জঞ্জালে আচ্ছাদিত গাড়ি পার্কিং-এর জায়গা। এক পাশে একটা ছেঁড়া দোলনা, স্লিপ। আর এক পাশে উঁচু পুজোর মঞ্চ আর দ্বিতলে ব্যায়ামের ব্যবস্থা। সত্যভারতী বিদ্যাপীঠ, শিশুতীর্থ ও সত্যভারতী বাণীনিকেতন সংলগ্ন মাঠটি এখনও খেলার মাঠ। বারাসতের অনেক প্রাক্তন খেলোয়াড়, অ্যাথলিট রোজ ওই মাঠে সকালে মিলিত হন। ছেলেমেয়েরা রোজ খেলে। মাঠপাড়ায় বিস্তীর্ণ মাঠ এখন ঘনবসতিপূর্ণ পাড়া। মাঝে একটি ছোট কবরস্থান সুন্দর পার্কে পরিণত হয়েছে, তবে ওতে শিশু, বুড়ো কারও প্রবেশাধিকার নেই, কারণ প্রচণ্ড মশার উৎপাত।
আমাদের আশেপাশে অনেক মাঠই এখন আর মুক্ত নয়, ছেলেমেয়ের হইহই করে খেলার জায়গা নয়। বরং রেলিং ঘেরা ব্যবসা করার স্থান। খোলা মাঠের সত্যিই বড় অভাব।
অসীম বসাক, কলকাতা-১২৬
মূল্যহীন
কিংশুক সরকারের ‘নয়া বিধি, পুরনো নীতি’ (১৯-৫) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, বর্তমানে দেশের কর্মসংস্থানের যা হাল তাতে মনে হয় অদূর ভবিষ্যতে স্থায়ী চাকরির সংজ্ঞাটি প্রায় মুছে যাবে। চাকরির বাজারে সর্বত্রই শুধু অস্থায়ী কর্মীদের আবাহন আর সুযোগমতো হাতে কিছু নগদ ধরিয়ে কর্মী নিয়োগের নীতি ও বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দরজা দেখানো। আগেকার দিনে শ্রম বিধি অনুযায়ী কুড়ির অধিক কর্মী হয়ে গেলে কর্মীদের ভবিষ্যনিধির (প্রভিডেন্ট ফান্ড) আওতাভুক্ত করা আবশ্যক ছিল। কিন্তু বেশ কিছু দুরভিসন্ধিযুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক সব সময় অনধিক কুড়ির মধ্যে স্থায়ী কর্মী রেখে বাকিদের খাতায়-কলমে ক্যাজুয়াল দেখিয়ে ভাউচারের মাধ্যমে তাঁদের শ্রমের বিনিময়ে সামান্য অর্থ প্রদান করতেন ও অন্যান্য সমস্ত প্রাপ্ত সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখতেন, এবং যখন তখন ছাঁটাই করে দিতেন। কর্মচারী ভবিষ্যনিধি দফতরের ইনস্পেক্টররা যখন বছরে এক বার খাতাপত্র পরীক্ষা করতে আসতেন, এই সমস্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যোগ্য হিসাবরক্ষকরা তখন তাঁদের চা-শিঙাড়ায় আপ্যায়িত করে হাতে খাম ধরিয়ে হাসিমুখে বিদায় দিতেন। ফলে দেখা যেত বহু শ্রমিক, যাঁরা হয়তো দশ বছরের অধিক সেই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন ও ভাউচারের মাধ্যমে বেতন পাচ্ছিলেন, তাঁরা বঞ্চনার শিকার হয়ে চলেছেন বছরের পর বছর। এঁদের দেখার কেউ ছিল না।
অবসরের পর এঁরা পেনশন তো দূর অস্ত্, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্র্যাচুইটির অর্থ কোনও কিছুই পেতেন না। বাম সরকারের দৌলতে শ্রম বিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে কিছু কঠিন পদক্ষেপ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে তৃণমূল সরকারের জমানায় এই সব অযাচিত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। কারণ, এই কর্মীরা সংখ্যায় কম, ফলে ভোটব্যাঙ্কেও মূল্যহীন।
সুব্রত সেন গুপ্ত, কলকাতা-১০৪
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)