Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
guardians

সম্পাদক সমীপেষু: ওদের কথা শুনতে হবে

একটি মেয়ে কিছু কথা লিখেছে এবং একটি বিশেষ গালি সে বার বার লিখে গিয়েছে। মেয়েটি পড়াশুনোয় মেধাবী, মাধ্যমিকে ভাল ফল করেছে।

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২২ ০৪:৩৪
Share: Save:

‘মাধ্যমিকের খাতায় কুকথার বন্যা, সর্বস্তরে বিস্ময়’ (৩০-৫) প্রতিবেদনটির প্রেক্ষিতে এই পত্র। দীর্ঘ চব্বিশ বছরেরও বেশি সময় স্কুলে শিক্ষকতার কাজে যুক্ত থাকায় কিশোর মনের ওঠা-নামার সঙ্গে গভীর ভাবে পরিচিত হয়েছি। তবুও ইদানীং যেন তাদের আচরণ অচেনা ঠেকে। এ বছর মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের খাতা দেখার সময় যদিও এ রকম কোনও অভিজ্ঞতা আমার হয়নি, তবে স্কুলে উচ্চমাধ্যমিক টেস্টের সময় বাংলা পরীক্ষার উত্তরপত্রে দেখি, একটি মেয়ে কিছু কথা লিখেছে এবং একটি বিশেষ গালি সে বার বার লিখে গিয়েছে। মেয়েটি পড়াশুনোয় মেধাবী, মাধ্যমিকে ভাল ফল করেছে। খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম।

মেয়েটি লিখেছে যে, বাড়িতে বিরিয়ানি রান্না হলেও তাকে দেওয়া হয় না বা সে যে ভাবে চায়, সে ভাবে দেওয়া হয় না। তার লেখার ছত্রে ছত্রে মায়ের প্রতি তীব্র ক্ষোভ। অবশেষে আমি এবং আমাদের বাংলার শিক্ষিকা ওর সঙ্গে কথা বললাম। বেরিয়ে এল ওর রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ। বাড়িতে ভাইকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। ওর কথার কোনও গুরুত্ব নেই। এমনকি ও বেশি ক্ষণ পড়াশোনা করুক, সেটাও ওর মা চায় না। ওর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এল কিশোরবেলার একাকিত্ব ও সামাজিক লিঙ্গবৈষম্যের চিত্র। মেয়েটি কাউকেই বলতে পারেনি সেই কথা। দীর্ঘ লকডাউনে তার মনে জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ, অভিমান— সবই প্রকাশ পেয়েছে প্রথম পরীক্ষার উত্তরপত্রেই।

কিশোরবেলার এই নরম মনগুলোকে রক্ষা করতে হবে। ওদের কথা শুনতে হবে ধৈর্য ধরে। অভিভাবকদের হতে হবে সজাগ। পাঠ্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনা থাকলে ওরা অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবে, যা গতানুগতিক পাঠ্যক্রম থেকে ওরা পায় না।

সিক্তা দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান

সার্বিক অবক্ষয়

‘মাধ্যমিকের খাতায় কুকথার বন্যা, সর্বস্তরে বিস্ময়’ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বলি, বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে নানা মত দিয়েছেন। আমি বিশেষজ্ঞ নই। তবে ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বুঝি, এই ঘটনা হল সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়। নগর পুড়লে যেমন দেবালয় বাঁচে না, তেমনই সমাজে অবক্ষয় শুরু হলে তার আঁচ শিক্ষাঙ্গনেও লাগে। অর্ধ শতাব্দী আগে মুর্শিদাবাদ জেলাতে জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী তাঁর প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলেছিলেন, “প্রার্থী বিচারে ভোট দিলে আপনারা ওঁকে ভোট দিন, কারণ প্রার্থী হিসেবে ও আমার থেকে যোগ্য।” আর আজ সেই মুর্শিদাবাদের পাশের জেলা বীরভূমে এক জন নেতা প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলছেন, “ওদের ঘরজ্বালিয়ে দিন। কোনও পুলিশ ওদের সমর্থন করলে সেই পুলিশকে বোম মারুন।”

আশির দশক অবধি যে সব ছাত্রছাত্রী নকল করতে গিয়ে ধরা পড়ত, তাদের মধ্যে লজ্জাবোধ ছিল। পরীক্ষা বাতিল না করার জন্য তারা পরিদর্শককে অনুনয়-বিনয় করত। আজ ছাত্রছাত্রীদের এক বিরাট অংশই নকল করার সঙ্গে যুক্ত। ধরা পড়লে তারা লজ্জিত হয় না বললেই চলে। কেউ কেউ পরিদর্শককে নকল ধরার জন্য রীতিমতো হুমকিও দেয়। অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে এদেরই দাদা-দিদিরা উপাচার্যকে ঘেরাও করছেন। গত বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের যে নিয়মনীতি ঘোষিত হয়েছিল, তাতে বেশ কিছু পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছিল। এমনটা হওয়ার কথা নয়। কারণ, মাধ্যমিক ও একাদশ শ্রেণির ফলাফলভিত্তিক ছিল উচ্চমাধ্যমিকের ফল। ওই দু’টি পরীক্ষায় পাশ করেই এক জন উচ্চমাধ্যমিকে বসার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। সুতরাং, ফলাফল ঘোষণার আগে সংসদকে আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। এ দিকে, অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীরা নিজ নিজ বিদ্যালয়ে ভাঙচুর শুরু করল। এবং এর কিছু দিন পরে সংসদ সবাইকে পাশ করিয়ে দিল। ফলে একটা বার্তা গেল ছাত্রছাত্রীদের কাছে যে, ফেল করলেই স্কুলে ভাঙচুর করো, তা হলেই পাশ করে যাবে। এ ভাবেই দিনের পর দিন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আজকের এই চূড়ান্ত অবক্ষয়ে এসে পৌঁছেছে শিক্ষাচিত্র। সুতরাং, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে গেলে সেটা হবে উটপাখির বালিতে মুখ গুঁজে থাকার মতো।

প্রদীপনারায়ণ রায়, শক্তিপুর, মুর্শিদাবাদ

বড়দের দায়িত্ব

এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষার কিছু খাতার পাতা গালিগালাজে ভরা— এ কথা জানাজানি হতেই সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। অনেকেই বলছেন, করোনার জন্য পড়াশোনার ক্ষতির কারণে পড়ুয়ারা হতাশাগ্রস্ত, অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। আর তারই ছাপ পড়েছে পরীক্ষার খাতায়। তাদের এই হতাশাগ্রস্ত, অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার জন্য করোনাকে দায়ী করে আমরা বড়রা কিন্তু দায়িত্ব এড়াতে পারি না। মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব ঠিক কথাই বলেছেন, ১৫-১৬ বছরের ছেলেমেয়েদের এই ধরনের কাজের জন্য হয়তো আমরা বড়রাই দায়ী। ঠিকই। বিদ্যালয়ে কোনও ঘটনা ঘটলেই, তা মিড-ডে মিল বিষয়ে হোক অথবা ছাত্রছাত্রীদের শাসন করার ব্যাপারেই হোক, এক শ্রেণির অভিভাবক রে রে করে বিদ্যালয়ে এসে ছাত্রছাত্রীদের সামনেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ তো করেনই, কখনও কখনও বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র ভাঙচুর ও শিক্ষকদের মারধরও করে থাকেন।

এ সব দেখে ছাত্রছাত্রীরা এটাই শিখছে যে, শিক্ষকদেরও মারধর করা যায়, তাঁদেরও গালিগালাজ করা যায়। আর পথেঘাটে কান পাতলে তো অতি সহজেই শোনা যায় বড়দের মুখে নানান কুকথা। এ ব্যাপারে আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও কম যান না। এমন অনেক রাজনীতিবিদ আছেন, যাঁদের মুখের ভাষা অত্যম্ত কুরুচিকর। এ সবও তো ছেলেমেয়েরা শুনছে। এটাও দেখছে যে, অন্যকে খারাপ কথা বললে কোনও শাস্তি হয় না। পরীক্ষার খাতায় কটু কথা লিখে ছাত্রছাত্রীরা যে অন্যায় করেছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। ভবিষ্যতে আর এমন অপকর্ম ছাত্রছাত্রীরা যাতে না করে, তার দায়িত্ব শুধু শিক্ষকদের উপর ছেড়ে দিলে চলবে না, অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে গুরুদায়িত্ব নিতে হবে। তবে কাজের কাজ তখনই হবে যখন, ‘আপনি আচরি ধর্ম, পরেরে শিখাও’— এই আদর্শ বড়রা পালন করতে সক্ষম হবেন।

সত্যকিঙ্কর প্রতিহার, যমুনা দেশড়া, বাঁকুড়া

দুর্বিনীত

‘কুকথামালা’ (২-৬) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি যথাযথ এবং যৌক্তিকতায় ঠাসা! ছাত্রবেলার অভিজ্ঞতায় বলছি, পাড়ার দু’এক জন মাস্টারমশায়ের কাছে থেকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখার সময় এমন ঘটনার কথা জানতে পেরেছি। বেশ মনে পড়ে, জীবনবিজ্ঞানের এক শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই জানিয়েছিলেন যে, সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার খাতায় কোনও এক ছাত্র লিখেছিল যে, “গত বার পাশ করতে পারিনি, এ বারে অন্তত পাশ মার্কস দেবেন!”

কিন্তু কুকথা-র দুর্গন্ধ সেখানে অনুভূত হয়নি। তবে একটু গভীর ভাবে অনুভব করলেই বোঝা যাবে যে, এক ধরনের অধঃপতিত সংস্কৃতি এর জন্য দায়ী! কত ধরনের কুকথা স্থান-কাল-পাত্রের তোয়াক্কা না করে অতি স্বাভাবিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তার হিসাব নেই! নানা ধরনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যে হারে কুকথার শিলাবৃষ্টি ঝরে পড়ে, তার প্রভাব অস্বীকার করার উপায় আছে কি?

অবশ্য অতিমারির কশাঘাতে তেমন ভাবে প্রশিক্ষণ না হওয়ার কারণেও এমন হতাশার সৃষ্টি হতে পারে। আরও একটা কথা, সমাজের তথাকথিত প্রভাবশালীদের লাগামছাড়া ঔদ্ধত্যের মারাত্মক বিষে আজ ছাত্রসমাজ আক্রান্ত! সম্পাদকীয়টিতে তাই যথার্থই বলা হয়েছে যে, সমাজে কুকথার বাড়বাড়ন্তের জন্য রাজনৈতিক নেতারা অনেকাংশে দায়ী! নৈতিকতার জলাঞ্জলির মন্ত্রে বাংলার আকাশবাতাস মুখরিত! আর কত কী দেখতে হবে, কে জানে!

বিশ্বজিৎ কর, কলকাতা-১০৩

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

guardians Students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE