প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘স্বমহিমায় বিরাজমান’ (২৯-৫) শীর্ষক প্রবন্ধ সম্পর্কে কিছু কথা। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেনি। ফলে তারা কিছুটা হলেও শরিক দলের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল এবং বিরোধীরা পায়ের তলায় জমি খুঁজে পাওয়ার ফলে সেই সময় তাঁদেরও অনেকটাই সঙ্ঘবদ্ধ মনে হচ্ছিল। ফলে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধীদের আক্রমণের ঢেউ নেমে আসছিল কেন্দ্রীয় সরকারের উপর, এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের শরিকরাও বেসুরো বাজছিল। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়লাভের ফলে বিরোধীদের ছন্নছাড়া দশা আবার যেমন প্রকট হয়েছে, তেমনই বৃদ্ধি পেয়েছে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস। দেখা যাচ্ছে নামেই ‘ইন্ডিয়া’ জোট, কিন্তু এদের মধ্যে প্রতিটা আঞ্চলিক দলই জাতীয় রাজনীতির চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় নিজের রাজ্যে ক্ষমতা করায়ত্ত রাখার বিষয়ে। আবার অনেকেই কংগ্রেসকেও প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবেই বিবেচনা করে, তা যেমন বিরোধী রাজনীতির পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক, তেমনই বিজেপির পক্ষেও অত্যন্ত সহায়ক বলে মনে করা হচ্ছে। নানা ক্ষেত্রে তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই মিলছে।
বিজেপির হিন্দুত্বের মোকাবিলায় অধিকাংশ বিরোধীর নরম হিন্দুত্ব এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ানোর নামে তাঁদের কেবল ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করার প্রবণতা রয়েছে। এই নীতি সাধারণ মানুষের চোখে অনেকটাই এগিয়ে রাখে বিজেপিকে। এই সুযোগে সমগ্র দেশেই উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ব চাপিয়ে দেওয়ার দিকে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় শাসকরা, যা ইদানীং পশ্চিমবঙ্গেও বেশ ভাল ভাবেই অনুভব করা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বার বার চাপা পড়েছে কাশ্মীরের মতো স্পর্শকাতর স্থানে নিরীহ পর্যটকদের রক্ষা না করতে পারার দায়, দু’মাস কেটে যাওয়ার পরেও পহেলগাম কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত এবং তাদের সহযোগীদের ধরতে না পারা ও তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে ধোঁয়াশা থেকে যাওয়াকেও কেন্দ্রের ব্যর্থতা বলেই মনে করা উচিত। নানা রকম খবর উঠে এলেও কী চলছে, ঠিক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
সমস্ত ঘটনাতেই সাম্প্রদায়িকতার মোড়ক সাজিয়ে মানুষের মনে বিষ ঢেলে দিয়ে রাজনীতিতে সুবিধা তোলার অভ্যাসকে চিনিয়ে দেওয়া উচিত। বিভেদ ভুলে দেশের স্বার্থে বিরোধীদের স্বর এক হওয়া এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
বিষাদের বাক্স
‘লাল টুকটুকে ডাকবাক্সেরা’ (২৪-৫) শিরোনামে প্রকাশিত ‘কলকাতার কড়চা’য় সচিত্র সংবাদকণাটি হৃদয়গ্রাহী। সত্যিই, ‘চিঠি লেখার সেই দিন’ গিয়েছে। তার জায়গা নিয়েছে বর্তমানের বৈদ্যুতিন যোগাযোগ ব্যবস্থা। এক সময় দুপুরে, বিকালে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে দেখা যেত ক্যাম্বিসের ব্যাগ কাঁধে, হাতে একতাড়া চিঠিপত্র নিয়ে ডাকপিয়নকে। ‘চিঠি আছে’ বলে সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে এই ডাকবাবু গ্রামে ঢুকলে সকলে ভিড় জমাতেন। ভিনদেশবাসী আপনজনের কুশল সংবাদ পেত তাঁর কাছে। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর কেউই লেখা থেকে ডাকবাবুকে সরিয়ে রাখতে পারেননি।
আজ মোবাইল এসে খবর আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে ডাকঘরের কাজ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। খাম, পোস্টকার্ডের কোনও প্রয়োজনই মানুষ এখন তেমন বোধ করেন না। এক সময়ে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমই ছিল ডাকঘর। তাই খাম, পোস্টকার্ড, ডাকটিকিটের প্রয়োজন ছিল, কদরও ছিল। ডাকের মাসুল অনুযায়ী ধার্য মূল্যের ডাকটিকিট সাঁটতে হত চিঠির খামে। চিঠির তাৎক্ষণিক উত্তর পেতে ছিল ‘রিপ্লাই পোস্ট কার্ড’-এর ব্যবস্থা। অর্থাৎ, দু’টি পোস্টকার্ড সেখানে এক সঙ্গে আঁটা থাকত।
কীর্তিমান মানুষ বা মনীষীদের স্মরণে রাখতে তাঁদের ছবি মুদ্রিত করে ডাকবিভাগ বিভিন্ন মূল্যের ডাকটিকিট প্রকাশ করত। এখনও ওই ধারা হয়তো আছে, তবে সেই সময়ের মতো এর জনপ্রিয়তা, চাহিদা আর উপযোগিতা তেমন নেই। স্কুলবেলায় আমরা ডাকটিকিট সংগ্রহ করে সেগুলো বড় খাতায় এবং পরবর্তী সময়ে অ্যালবামে এঁটে রাখতাম। দেশ ও বিদেশের ডাকটিকিটে খাতার পাতা ভরে থাকত। একই ধরনের টিকিট একাধিক হয়ে গেলে বন্ধুরা সেগুলো বদলাবদলি করে নিতাম।
আজ সরাসরি কথা বলার সুযোগ থাকায় চিঠি পাঠানোর কোনও দরকারই হয় না। কুশল জানতে, নববর্ষে ও বিজয়ায় শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানাতে আপনজনের কাছে আর চিঠি পাঠানো হয় না। প্রযুক্তিবিদ্যায় শিক্ষিত মোবাইলটি এসে মানুষের কাছ থেকে খাম, পোস্টকার্ড আর ডাকটিকিট নামক জিনিসগুলিকে কেড়ে নিয়েছে। আজ সেই ডাকবাক্সগুলি অবহেলায় পড়ে থাকে, বাক্সের ভিতর শুধু বিষাদের বাতাস ভরে থাকে।
অমলকুমার মজুমদার, শিবপুর, হাওড়া
অগ্নিবীণা
পিনাকী গঙ্গোপাধ্যায়ের “বাস্তবের ‘অগ্নীশ্বর’” (রবিবাসরীয়, ১৮-৫) শীর্ষক প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। পেশায় চিকিৎসক বনবিহারী মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন একাল-এর মতো সামাজিক নাটক এবং শক্তিশালী কিছু কবিতাও, যা নড়িয়ে দিয়েছিল সামাজিক অন্যায় ও অসাম্যের ভিত। লেখা ও ছবির অদ্ভুত সামঞ্জস্যপূর্ণ কবিতায় বনবিহারী বৈজ্ঞানিক তারুণ্যের পক্ষে আমাদের সমাজের প্রাচীনতার বিরুদ্ধে হেনেছিলেন তীব্র কশাঘাত। লিখেছিলেন— জেনেছি আত্মা অবিনশ্বর, জেনেছি মিথ্যা দুনিয়া।—/ তাই আমাদের নাহি ভয় কানা-কৌড়ি;/ তাই পথ চলি দিনক্ষণ বেছে, খনার বচন শুনিয়া,/ সাহেব এড়াই সেলাম করি’ বা দৌড়ি’;/ কারণ আমরা আধ্যাত্মিক জাতি!
বঙ্গবাণী ও শনিবারের চিঠির নিয়মিত লেখক বনবিহারী মুখোপাধ্যায় সামাজিক বহুবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন বিজ্ঞানসম্মত সাহিত্যিক আন্দোলন। ‘নরকের কীট’, যোগভ্রষ্ট, দশচক্র-এর মতো গল্প-উপন্যাস ছাড়াও কবিতায় এনেছিলেন কালাপাহাড়ি সুর। তরুণদের তিনি নাড়া দিতে পেরেছিলেন। তাঁর দেশ ও সমাজসমস্যা বিষয়ক কবিতাগুলি আত্মসমালোচনামূলক হওয়ায় অনেকের প্রশংসা পেয়েছিল। সচিত্র পত্রিকার পাতায় পাতায় অতি নির্ভয়ে তুলে ধরেছিলেন বিপ্লব ও বিদ্রোহের সুর। বাঙালি জাতির তৎকালীন চরিত্র-শৈথিল্য এবং শিল্প-সাহিত্য ও জীবনে তার প্রকাশ সম্বন্ধে তাঁর তীব্র শ্লেষ আজও স্মরণযোগ্য।
সুদেব মালতিসা, হুগলি
আমাদের অজ্ঞতা
শতাব্দী দাশের ‘এক ক্ষত, একই প্রতিরোধ’ (৩১-৫) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। বানু মুশতাক শুধু কর্নাটকের নয়, ভারতেরও গর্ব। লেখিকা, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী বানু মুশতাক কর্নাটক সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৯৯) এবং ‘পেন ইংলিশ ট্রান্সলেশন অ্যাওয়ার্ড’ (২০২৪) পেয়েছেন। তিনি ১৯৭৭ সালে সাংবাদিকতা ও মানবাধিকার কর্মিরূপে কাজ শুরু করেন, পরে আইনজীবীর পেশা বেছে নেন। হার্ট ল্যাম্প বইটিতে দক্ষিণ ভারতের প্রান্তিক, দলিত, ও সাধারণ মুসলিম মহিলাদের জীবনের খুঁটিনাটি সমস্যার কথা সাদামাঠা ঢঙে তুলে ধরেছেন। গল্পগুলো তিনি ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত লিখেছেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরের বৈষম্য ওঁকে ভীষণ প্রভাবিত করে। সেই সব কথাই সাহিত্যে তুলে ধরেন। নিপীড়িত মুসলিম নারীদের কাহিনি লিপিবদ্ধ করতে করতে তিনি অজানতেই ভারতীয় নারীর প্রকৃত গল্প বুনে ফেলেছেন। আশ্চর্যের বিষয়, দেশের এমন শক্তিশালী লেখিকার সঙ্গে পরিচিত হতে আমাদের নির্ভর করতে হল আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের স্বীকৃতির উপরে!
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)