‘আশ্বাস ও বিশ্বাস’ (১০-৪) সম্পাদকীয়টি এক কথায় অনবদ্য। যেমন বাস্তবানুগ তেমনই কঠিন কঠোর। এই প্রশাসন প্রায়ই বড় অপকীর্তিগুলোকে দু’-একটা ছোটখাটো ভুল বলে থাকে। কিন্তু ভুল আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা কি এক হল? কী আশ্চর্য কথা! সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রায় ছাব্বিশ হাজার চাকরি বাতিল হল। এ নিয়ে বছরের পর বছর আদালতে তোলপাড় চলল, বার বার এসএসসি-কে জানাতে বলা হল যে, ঠিক কারা অসদুপায়ে চাকরি পেয়েছে। কিন্তু কিছুতেই যোগ্য-অযোগ্যের আলাদা তালিকা প্রকাশ্যে এল না। এমন সুকৌশলে চালে কাঁকর মেশানো হয়েছে যে, তা আলাদা করা দুঃসাধ্য। সুপ্রিম কোর্টকে তাই বাধ্য হয়ে সমস্ত প্যানেলটাই বাতিল করতে হল। বিশাল সংখ্যক নির্দোষ মানুষ যাঁরা যোগ্য শিক্ষক, তাঁরা চাকরি হারালেন।
এ দায় কার? এখন প্রশাসনের তরফে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এ সব বিরোধীদের কীর্তি। কেন, কর্তাব্যক্তিরা কি এই ভেজাল মেশানোর বিষয়টা জানতেন না? আর জি কর কাণ্ডেও দায় এড়ানোর রাজনীতি দেখা গিয়েছে। আসলে যখনই কোনও বড়সড় দুর্নীতি দুর্বিপাক এসে পড়ে, সরকার বিরোধীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজে হাত ধুয়ে ফেলতে চেষ্টা করে।
প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে, তাবড় আইনজীবী দিয়ে রিভিউ পিটিশন করানো হবে এই রায়ের বিরুদ্ধে। তার ফল যে শূন্য সবাই জানে। কারণ, রায় দিয়েছে খোদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। আর প্রশাসনের তরফে শিক্ষকদের কাজ করে যেতে অনুরোধ করা হয়েছে। কেনই বা যোগ্য শিক্ষকেরা এমন প্রস্তাব মেনে নেবেন? এর পর শুরু হয়েছে দিকে দিকে বিক্ষোভ, শিক্ষকের উপর পুলিশি অত্যাচার, যা নিয়ে রাজ্য উত্তাল। তবে এ সব নিয়ে যতই আন্দোলন বিক্ষোভ হোক, ভোটে এর কোনও প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। অনুদানের রাজনীতির আড়ালে সব অভিযোগই যে চাপা পড়ে থাকে।
অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
সদিচ্ছা প্রয়োজন
সম্পাদকীয় ‘আশ্বাস ও বিশ্বাস’ খুবই প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের রায়ে প্রায় ছাব্বিশ হাজার চাকরি বাতিল হওয়ার ঘটনায় রাজ্য সরকারের ভূমিকা ও এই রায়ের তাৎক্ষণিক প্রভাব নিয়ে সারা বঙ্গসমাজ বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। তা ছাড়াও, দিনের পর দিন সরকারের বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, যে কোনও নিরপেক্ষ মানুষই এই বিষয়ে সহমত হবেন। অথচ এই বিষয়গুলোকে সে ভাবে গুরুত্ব না দিয়ে, চাকরি হারানোর ঘটনাকে লঘু করে দেখানো হচ্ছে, কিছু নির্দিষ্ট আইনজীবীর সমালোচনা করা হচ্ছে স্বয়ং শাসকের তরফে। তারই সঙ্গে আনা হচ্ছে নব্বইয়ের দশকের বামফ্রন্ট জমানার একটি সরকারি সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গ। তৎকালীন সরকারের শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা কমানো এবং বিষয়টিকে ঘিরে প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে লাঠিচার্জের কথা স্মরণ করিয়ে বর্তমান দুর্নীতির অভিমুখ থেকে প্রচারের আলোকে ঘুরিয়ে দেওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে সরকারের কিছু স্তাবকের পক্ষ থেকে।
অথচ প্রশাসনের তরফে কোনও শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি এক বারও সর্বসমক্ষে বলতে পারছেন না, অযোগ্য বলে চিহ্নিত যে সকল প্রার্থী অর্থের বিনিময়ে যোগ্যদের সারিতে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা নির্ভয়ে উৎকোচ গ্রহণকারীদের নাম সামনে আনলে, তা সেই ব্যক্তি যত প্রভাবশালীই হোন না কেন, সরকারের পক্ষ থেকে কড়া পদক্ষেপ করা হবে। এর ফলেই ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষক এবং সাধারণ মানুষের মনে ধারণা জন্মাচ্ছে, অন্তরালে প্রশাসন স্বয়ং অযোগ্যদের আড়াল করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। এ ছাড়া, চোখকান খোলা রাখলেই জানা যায়, ছোট ছোট কিছু ঘটনাও ঘটেছে, যা সরকারের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করেছে। অথচ সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই ধরনের সমস্ত অপরাধীকেই ধরা সম্ভব।
সম্পাদকীয়টিতে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পাশাপাশি সমান্তরাল ব্যবস্থা চালানোর যে কথা বলা হয়েছে, তা সরকারি কোষাগারের পক্ষে দিনের পর দিন কী রকম বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় যখন রাজ্য সরকারের কোটি কোটি টাকা ঋণের হিসাব সকলের সামনে আসে। কেন্দ্রের সঙ্গে বিবাদে বরাদ্দ না আসার ফলে বা কেন্দ্রীয় যোজনায় অসম্মতি প্রদর্শনের ফলে একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা, স্বাস্থ্যসাথী প্রভৃতি বিষয়গুলোতে রাজ্যের কোষাগার থেকেই অর্থ প্রদান চলছে, সেখানে অনেক সময় প্রাপকের যোগ্যতাও বিচার করা হয় না। আর এ ভাবেই মানুষকে শান্ত রাখার প্রয়াস জারি রয়েছে।
যোগ্য মানুষগুলির ন্যায্য বিক্ষোভকে সহানুভূতির সঙ্গেই প্রশমিত করা উচিত, দমন নয়। আর তাঁদের জন্য উপযুক্ত বিকল্প ব্যবস্থা ঘোষণার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে এত দেরি করে ফেলাও কাঙ্ক্ষিত নয়। তবু বলে রাখি, মনে হয় এখনও সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। মানুষ সব দেখছেন, সব জানছেন। চার পাশের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বললেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এমতাবস্থায় প্রশাসন নিজের ভুল স্বীকার না করলে বা নিজেদের সংশোধন না করলে, যে মানুষরা তাদের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, তাঁরাই এক দিন ভূমির ধুলার উপরে টেনে নামিয়ে আনতে দ্বিধাবোধ করবেন না।
অশোক দাস, রিষড়া, হুগলি
বিশ্বাসভঙ্গের পর
সম্পাদকীয় ‘আশ্বাস ও বিশ্বাস’ প্রসঙ্গে এই চিঠি। এই শব্দবন্ধটি অনিবার্য ভাবে যে কথাটি মনে করিয়ে দেয়, তা হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারততীর্থ’ কবিতার সেই অমোঘ পঙ্ক্তি। “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে...।” এর একটি অর্থ হতে পারে যে, দাতা আর গ্ৰহীতা দু’পক্ষই আশ্বাস প্রদান করবেন এবং বিশ্বাস গ্ৰহণ করবেন। ঠিক যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশের মানুষ দলপ্রধানের আশ্বাসকে বিশ্বাস করে শাসকদের ক্ষমতায় এনেছিলেন।
নানা বিষয়ে আশাভঙ্গ হলেও সেই অংশটি দু’টি নির্বাচনে ফের আশ্বাসের উপর বিশ্বাস রাখেন ও যথারীতি বিশ্বাসভঙ্গ হয়। কিন্তু তাঁদের টনক নড়েনি।
তপোময় ঘোষ, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান
সুপ্রস্তাব
তূর্য বাইনের ‘প্রতিশ্রুতি পূরণ কোন পথে’ (১০-৪) প্রবন্ধটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে কি না সেটা সময় বলবে। তবে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হল, যোগ্য চাকরিহারাদের জন্য বিকল্প কী ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যে যোগ্য-অযোগ্য তালিকা দু’বছর ধরে আদালতে পেশ করা গেল না, সেই তালিকা যে ভবিষ্যতেও তৈরি করা যাবে না, তা এখন স্পষ্ট। প্রশ্ন, তবে এঁদের নিয়োগ হবে কোন উপায়ে?
যোগ্য অযোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই আবার নতুন করে পরীক্ষায় বসতে চাইছেন না। এ কথা ঠিকই এই অগ্নিপরীক্ষা তাঁদের পক্ষে আবার দেওয়া খুবই কষ্টকর। কারণ প্রায় সাত-আট বছর ধরে এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার নিয়ম-কানুন বা সিলেবাস চর্চা ছাড়া মনে রাখা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। সব ভুলে যাওয়ারই কথা। তবে প্রবন্ধ রচয়িতা সুন্দর প্রস্তাব রেখেছেন। যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য কোনও বিশেষ ‘লিমিটেড’ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায় কি না, প্রস্তাবটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার খতিয়ে দেখতে পারে। সমাজে, জনমানসে, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মান-মর্যাদা গৌরব ধ্বস্ত হয়েছে বলে তাঁরা নিজেরাই মনে করছেন। আমাদের একান্ত ইচ্ছা, তাঁরা যেন আবার তাঁদের যোগ্য আসনটির দিকে এগিয়ে যেতে পারেন। তার জন্য সরকারকে উদ্যোগ করতেই হবে।
স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)