প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘পুরনো খেলা, নতুন নিয়ম’ (১২-৬) শীর্ষক প্রবন্ধটি নিয়ে কিছু বক্তব্য। এ রাজ্যের আগামী বিধানসভা ভোটে বিজেপি ‘হিন্দু তাস’ বেশি করে খেলবে নিশ্চিত। ধর্ম নিয়ে এই দল বরাবরই খেলে, এ বারেও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সাম্প্রতিক পহেলগাম কাণ্ড ও বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে বিজেপি সর্বত্র নানা ভাবে চড়া গলায় প্রচার করে যাচ্ছে।
আসল যে ব্যাপারটা প্রবন্ধকার কিছু উল্লেখই করলেন না তা হল, বিজেপির ৪০ শতাংশ ভোট ৪৪ শতাংশ করতে গেলে অন্য বিরোধীদের কিছু ভোট তাদের দিকে টানা দরকার। এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারকে উৎখাত করতে চাইলে সব বিরোধীদের প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে এককাট্টা হয়ে ভোটে লড়া খুবই প্রয়োজন। আগে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জয়প্রকাশ নারায়ণ যা করেছিলেন। তা হলেই প্রমাদ গুনবে তৃণমূল। কিন্তু এ রাজ্যের বিরোধীদের যা রাজনৈতিক বিন্যাস, তাতে তেমন জোট হওয়া কার্যত অসম্ভব। ফলে, সিপিএম নির্বাচনে বিরোধী ভোট কেটে বার বার তৃণমূলকে সাহায্য করে যাচ্ছে।
দুঃখের কথা এই যে, এ রাজ্যে বিজেপির সংগঠন মজবুত নয়। তারা পুরোপুরি ভরসা করে ‘মোদী ম্যাজিক’-এর উপরে। সেই ‘ম্যাজিক’-এর সঙ্গে আরএসএস যদি তলে তলে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তবে কিছু হলেও হতে পারে। আর এ দিকে, তৃণমূলের ভরসা সংখ্যালঘু ভোট, নানা অনুদান আর সিপিএম-এর কাটা ভোট। তবে, তৃণমূলের লোকবল, পেশিবল, অর্থবলও নেহাত কম নয়। হাজার দুর্নীতি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হলেও আমজনতার ভোটে তার বিশেষ প্রভাব পড়ে না, কারণ ক্ষমতাসীন-বিরোধী মনোভাবের বড় অভাব এ রাজ্যে।
অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
ভোট রাজনীতি
প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ২০২৬-এ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে জয়ের জন্য এ রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে, তা কারও অজানা নয়। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ‘উনিশে হাফ, একুশে সাফ’ স্লোগান তেমন কার্যকর না হলেও ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে ভোটের ব্যবধান খুব বেশি ছিল না। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৫.৭৬ শতাংশ আর বিজেপির ৩৮.৭৩ শতাংশ। ওই নির্বাচনে বহু আসনে বামপন্থী প্রার্থী ও কংগ্রেস প্রার্থীরা যে ভোট পেয়েছেন, তাতে ভোট কমেছে মূলত বিজেপির। এমতাবস্থায় হিন্দু ভোট ৬-৭ শতাংশ বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ধর্মের ভিত্তিতে ভোটের অঙ্ক কষা ছাড়া, আর কোনও পথ বিজেপি দলের কাছে আছে কি? অনেকেরই অনুমান, তা নেই বলেই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এ রাজ্যে এত দিন পর্যন্ত যে সামাজিক সখ্য বজায় ছিল, তাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়ে ভোট যুদ্ধে জয়লাভের একটা প্রচেষ্টা প্রকাশ্যে আসছে। সিঁদুর, তুলসী গাছ ইত্যাদি নিয়ে মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ করে হিন্দুদের মন জয় করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।
অন্য দিকে, এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চুপ করে বসে নেই। তিনিও তাঁর মতো করে হিন্দু ভোটারদের আবেগ উস্কে দিতে দিঘাতে জগন্নাথ দেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। মন্দির নির্মাণ, সেই মন্দিরের প্রসাদ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে পিছপা হচ্ছেন না। শাসক দল ধরেই নিয়েছে, অযোধ্যার রাম মন্দিরের চেয়ে দিঘার জগন্নাথ মন্দির পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ভোটারদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। অযোধ্যার রামের চেয়ে পুরীর জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার গুরুত্ব যে এ রাজ্যের ভোটারদের কাছে অনেক বেশি, তা বুঝতে তারা এতটুকুও দেরি করেনি। তাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দিঘার জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করে, সেটি উদ্বোধন করা হয়ে গিয়েছে। কার টাকায় মন্দির নির্মাণ হল, তা নিয়ে সাধারণ ভোটারদের বিশেষ মাথাব্যথার কারণ আছে বুঝলে, তড়িঘড়ি মন্দির নির্মাণের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হত না। বিজেপি হিন্দুদের মন জয় করার জন্য যে সকল পন্থা নিয়ে এগোচ্ছে, তাকে প্রতিহত করতে দিঘার জগন্নাথ মন্দির তৃণমূলের পক্ষে একটা ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারে।
তৃণমূল দলও যদি ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের জন্য বিজেপির দেখানো ভোট মেরুকরণের পথে হাঁটতে শুরু করে, তা হলে আশ্চর্যের কিছু না থাকলেও দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি অবশ্যই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এর বিকল্প তুলে ধরা না হলে ভোটাররা সঠিক পথের সন্ধান পাবেন কী ভাবে? এখানেই জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলির এমন কিছু কর্মসূচি নেওয়া উচিত, যা পশ্চিমবঙ্গবাসীকে ভরসা জোগাতে পারে। তবে, গত কয়েকটি বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, বেকারত্ব ইত্যাদি বিষয়কে উপেক্ষা করে ভোটাররা যে ভাবে ভোট দিয়েছেন তা দেখে মনে হয় না, এ বারের নির্বাচনেও সেই বিষয়গুলি বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভোটাররা যদি নিজেদের জীবন জীবিকার প্রশ্নগুলোকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় মেরুকরণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইভিএম মেশিনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন, তবে সেটা সুস্থ গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
জরুরি অবস্থা
দেশে জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেমন্তী ঘোষের “সংবিধান ‘হত্যা’ না করেই” (২৫-৬) প্রবন্ধটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। প্রবন্ধকার বলেছেন, রায়বরেলী লোকসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল করে ইলাহাবাদ হাই কোর্ট এবং পরবর্তী কালে তাঁর ভোটে দাঁড়ানোর উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর পরেই তেরো দিনের মাথায় সারা দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা। অর্থাৎ, জরুরি অবস্থার মূল কারণ হল এই নিষেধাজ্ঞা। একমত না হয়েই বলি, কংগ্রেস তথা ভারতের রাজনীতিতে সঞ্জয় গান্ধীর আগমনে এবং তাঁর বহুবিধ বেপরোয়া কার্যকলাপে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল। এই অস্থিরতা সৃষ্টির কারণেই ‘ঘুমন্ত’ জয়প্রকাশ নারায়ণের জাগরণ ঘটে। তাঁর ডাকেই ইন্দিরা গান্ধী তথা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সব বিরোধী রাজনৈতিক দল এক ছাতার তলায় জড়ো হয়, মূলত ‘ইন্দিরা হটাও, দেশ বচাও’ স্লোগানকে সামনে রেখে। বাধ্য হয়েই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এবং অন্যদের পরামর্শে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ইন্দিরা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর বহু বিরোধী নেতাকে গ্রেফতার করা হয়, কণ্ঠরোধ করা হয় সাধারণ সংবাদপত্রের। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে ওঠেনি সেই সময়ে। সময়মতো কর্মস্থলে আসা, ঠিক সময়মতো ট্রেন ছাড়া, সর্ব স্তরেই সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কর্মসংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতেই বসবাস করছিলেন। আবার এটাও ঠিক, ওই জরুরি অবস্থার কারণেই ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হয়। ইন্দিরা গান্ধী হেরে গিয়েছিলেন, যদিও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ভূমিকা বিশ্বের সমীহ আদায় করেছিল।
এ দিকে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার গণতন্ত্রের পতাকা উড়িয়ে গণতন্ত্রকেই আজ কলুষিত করে চলেছে। বিবিধের মাঝে মিলন মহান, ভারতের এই সনাতন ঐতিহ্য আজ বিপন্ন। আইন ও সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা চলছে। কেন্দ্রে বর্তমান শাসক দলের আমলে সংসদের গুরুত্ব লোপ পেয়েছে। গণতন্ত্র বিরোধী বিভিন্ন ধরনের আইন পাস করা হচ্ছে কোনও রকম আলাপ-আলোচনার অবকাশ ছাড়াই। অনেকেরই দাবি, দেশের শিল্প চালিত হচ্ছে সরকার ঘেঁষা শিল্পপতিদের দ্বারা। ফলে বলা যেতেই পারে, বর্তমান সরকারের আমলেও দেশে বলবৎ রয়েছে অলিখিত এক জরুরি অবস্থা।
বাবলু নন্দী, কলকাতা-৭৯
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)