E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ভুলিয়ে দিতে চায়

ভুলে গেলে চলবে না যে, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার মান আলাদা, তা এক ধ্রুপদী ভাষা।

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৪

শুভময় মৈত্রের ‘হঠাৎই আত্মঘাতী গোল’ (১৩-৮) নিয়ে কিছু কথা। আলোচনায় কিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এল— যা শুধুমাত্র সামাজিক নয়, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অবস্থানও অনেকটা সুস্পষ্ট করে দিল। অনেকটা উদ্বেগ, অনেকটা সংশয়, অনেকটা বাস্তবতা ঘিরে লেখকের যে ভাবনা তা আসলে সাধারণ নাগরিকদের একাংশের মূল্যবোধের আয়না।

ভুলে গেলে চলবে না যে, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার মান আলাদা, তা এক ধ্রুপদী ভাষা। রাজনৈতিক দলগুলি বাংলা ভাষার অপমান তো করছেই, তার সঙ্গে এই প্রান্তের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা শিল্প ও সাহিত্য জগতে আমাদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাকেও অবহেলা করছে। বাংলা থেকে উঠে আসা নামগুলি রাজনৈতিক চালচিত্রে বা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চিরন্তন। সেগুলো কিন্তু মুছে দেওয়া বা ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়। এই রেশ সারা পৃথিবীতেই যুগ যুগ ধরে থেকে যাবে। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, রাসবিহারী বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ— কোন নামটি বা কার ভূমিকা ভুলে যাওয়ার?

রাজনৈতিক ডামাডোল দেখার পর কি চিন্তাশীল মানুষ বুঝতে পারছেন না যে, বাংলাভাষী বা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী— এই আখ্যাগুলির মধ্যে রাজনৈতিক গন্ধ বা লাভ লুকিয়ে আছে? বেশ কিছু বিবৃতি উল্লেখ করে লেখক সেই বিষয়গুলিকে সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করবার চেষ্টা করেছেন ছোট্ট পরিসরে। এই রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্প এমনিতেই দুর্নীতিতে ছয়লাপ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিভাগে অধঃপতন হয়েছে, যাঁরা বর্তমানে লেখাপড়া করছেন তাঁদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ, না আরও দুঃসময় আসছে— অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল আর জি কর কাণ্ডে এখনও ন্যায় মেলেনি। এত প্রমাণ সকলের সামনে এলেও প্রভাবশালীদের বা প্রশাসকের সদিচ্ছার অভাবে ঠিকঠাক শাস্তি হয়নি। শুধুমাত্র ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে অনুদান প্রকল্পের প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হবে বা তা আদতে আরও অন্ধকার এনে দেবে কি না, সময় বলে দেবে। তবে, মূল্যবোধের অভাবের রেশ সমাজের নিম্ন স্তর থেকে উচ্চ স্তর— সকল জায়গাতেই থকথকে পুঁজের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।

‘সিস্টেম’-এ পরিবর্তন চাইলে আগে দরকার সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনার জাগরণ।

সোমা বিশ্বাস, কলকাতা-৭৬

রাজনীতির ঘুঁটি

শুভময় মৈত্রের ‘হঠাৎই আত্মঘাতী গোল’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। বাঙালি পরিচিতি নিয়ে এখন গোটা দেশে এক অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতেই দিল্লির পুলিশ বাংলা ভাষাকে বলেছে, ‘বাংলাদেশি ভাষা’। দিল্লি, হরিয়ানা, গুজরাত, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি বিজেপি-শাসিত রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকেরা মূলত বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। যা আতঙ্কের এবং অনভিপ্রেত। নিম্ন আয়ের পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি এই অমানবিক আচরণ প্রতিহত করায় দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির থাকলেও, সে দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার তেমন কোনও উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করতে গিয়ে বাংলাভাষা ও বাংলাভাষী মানুষকে আক্রমণ করাটা কোনও যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না।

দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে অনুপ্রবেশকারীদের সীমান্তেই আটকানো উচিত। সেখানে কোনও গাফিলতি থাকলে তার দায় কখনওই এ রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর বর্তায় না। অথচ সেটাই হচ্ছে। স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই অধিকার রয়েছে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে নেওয়ার। কিন্তু তা করতে গিয়েই এ রাজ্যের দুর্বল পরিযায়ী শ্রমিকদের নাজেহাল অবস্থা। স্বভাবতই এ রাজ্যে বসবাসকারী বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে হেয় করার অভিযোগ তুলে প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। তাঁর এই পদক্ষেপ তৃণমূল দলকে কতটা রাজনৈতিক আলো দেবে, তার হিসাব মেলাতে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

হয়তো বাঙালি বিদ্বেষ ছড়ানোর কারবারিরা বুঝে গিয়েছেন, এখন বাঙালি অস্মিতার লড়াইয়ে শামিল হওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। বরং, ক্রমাগত বাড়ছে সরকারি আনুকূল্য লাভের প্রত্যাশীর সংখ্যা। এমতাবস্থায় লড়াইয়ের অভিমুখ পাল্টে ফেলার চাল, রাজনীতির কারবারিদের কাছে মোটেও অচেনা নয়। সম্ভবত তাই, হিন্দুদের সঙ্কট এসেছে— এই মতবাদের পক্ষে সংখ্যাগুরুদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা বেগবান হচ্ছে। আর এই অভিমতের পক্ষেও যে মানুষের সমর্থন ধীরে ধীরে বাড়ছে, তারও প্রমাণ বিজেপির ভোট প্রাপ্তির অঙ্কে পাওয়া যাবে। সাধারণ মানুষ যে ইভিএম-এর বোতামে চাপ দেওয়ার সময় কর্মসংস্থান, উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পে দুর্নীতি; জীবনদায়ী ওষুধ-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়গুলির কথা বেমালুম ভুলে যান, তার প্রমাণ খুঁজতে খুব বেশি দিন পিছিয়ে না গেলেও চলবে। তাই মতাদর্শগত লড়াইয়ের তত্ত্ব বামপন্থীদের মাথায় যতই গিজগিজ করুক, তা জনগণের মস্তিষ্ককে চারিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই বললেই চলে।

এক সময় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পাশাপাশি দেশ গঠন ও সমাজসেবার ভাবনা রাজনীতিতে যথেষ্ট গুরুত্ব পেত। রাজনীতির ভাষা বদল হতে শুরু করার পর, বাঙালি হয়তো নিজের সম্মান নিয়ে জোটবদ্ধ হওয়ার বিশেষ সময় বার করতে পারেনি বা পারছে না। নিঃশব্দে রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র থিতু হওয়ার প্রবণতা যত বেড়েছে, ততই নড়বড়ে হয়েছে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার ভিত। মাঝেমধ্যে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গের দেখা মিলেছে ঠিকই, কিন্তু তা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে সাফল্য ছিনিয়ে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে বাংলার ভিতরে বা বাইরে বাঙালিদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি ও ভাষার সম্মানরক্ষার বিষয়টি যদি কোনও ভাবে উপেক্ষিত হয়, তা হলে ভবিষ্যতে ভিন রাজ্যে শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির মানুষেরা আদৌ কতটা সুরক্ষিত থাকবেন, সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে কি?

রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

অজ্ঞতার চিহ্ন

‘হঠাৎই আত্মঘাতী গোল’ শীর্ষক প্রবন্ধটির বিষয়ে লেখকের সঙ্গে একই মত পোষণ করে বলি, বাঙালির রাজনৈতিক সচেতনতা, মেধা, রুচি এবং সাংস্কৃতিক বোধ সমগ্র ভারতের চোখে সম্ভ্রম আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। এটি আমি চাকরিসূত্রে রাজ্যের বাইরে বিভিন্ন প্রদেশে বসবাস করে এবং ঘুরে ঘুরে কিছুটা হলেও অনুভব করেছি।

পরিস্থিতি অনেকটা হয়তো পাল্টে গিয়েছে, তবে এক শ্রেণির মানুষ বাংলা এবং বাঙালি সম্পর্কে ইদানীং যে বিরূপ অভিমত ব্যক্ত করছেন সেটি তাঁদের অজ্ঞতারই পরিচায়ক বলে মনে করি।

বাবুলাল দাস, ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

সম্ভাবনা

শুভময় মৈত্রের প্রবন্ধ ‘হঠাৎই আত্মঘাতী গোল’ প্রসঙ্গে বলি, বিজেপি-শাসিত ভিন রাজ্যে বাঙালি হিন্দু পরিযায়ী শ্রমিকদের উৎপীড়নের ফলে এ রাজ্যে কিন্তু হিন্দু বাঙালিরা বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। তবে বিরোধী পরিসর কখনও শূন্য থাকে না। বিরোধী দলের তকমা পেতে পারে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট, যদি তারা উদ্যোগী হয়, তবে।

কমল চৌধুরী, কলকাতা-১৪০

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Bengali Migrant Worker Classical Language

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy