বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা’ (৯-২) প্রবন্ধটি সাম্প্রতিক রাজ্যের শিল্প সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে বেশ ব্যঞ্জনাময়। আমাদের রাজ্যে নতুন শিল্পস্থাপনের আগমন বার্তা তথা শিল্পপতিদের লগ্নির প্রতিশ্রুতির খবরাখবর উৎসাহজনক, যা অবশ্যই দেশের কাছে সদর্থক বার্তা প্রেরণ করবে। কিন্তু রাজ্যবাসীর প্রশ্ন থেকেই যাবে যে, বন্ধ কলকারখানাগুলির উৎপাদন পুনরায় শুরুর জন্য কী ধরনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে এবং তা ফলপ্রসূ হয়নি কেন! এ ক্ষেত্রে একটি গাড়ি তৈরির কারখানার রাজ্য পরিবর্তন এখনও একটি বিতর্কিত বিষয়।
‘হিন্দুস্তান মোটরস লিমিটেড’ স্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালে হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায়, বিড়লা পরিবারের উদ্যোগে ও ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। সেখানে ঐতিহ্যবাহী সব গাড়ির উৎপাদন হত। গাড়ির ব্যবসা বেশ রমরমিয়ে চলছিল। গাড়ি ব্যবহারকারীরা যথেষ্ট বিত্তশালী এবং সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং গাড়িটি তাঁদের ঐশ্বর্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হত। কারখানার শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ ভাল ছিল। আমি কিছু দিন কর্মসূত্রে হুগলি জেলা প্রশাসনে ছিলাম। লোকমুখে শোনা যেত বাজার-হাটেও অতিরিক্ত ক্রয়ক্ষমতা হেতু গাড়ি কারখানার কর্মচারীদের দোকানিরা যথেষ্ট সমীহ করতেন। তার পর তো বেশ কিছু দিন টালবাহানার পরে ২০১৪ সালে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। বিভিন্ন সময় রাজ্য সরকারের শ্রম বিভাগ, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে ত্রিস্তরীয় বৈঠকের সহায়তায় কারখানার উৎপাদন শুরু করাতে প্রয়াসী হয়েছিল, কিন্তু যত দূর শুনেছি মূলধনের অভাবে এবং মালিক পক্ষের অনীহাতে তা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের রাজ্যের শিল্পোদ্যোগ বিশ্বের দরবারে সমাদৃত হচ্ছে। গাড়ি কারখানার বিশাল জমিতে অন্য শিল্পের কথা ভাবা যেতেই পারে। তবে এ বিষয়ে ভারত সরকারের সদর্থক ভূমিকাও বিবেচ্য। লেখক অনেকগুলি উদাহরণ দিয়েছেন বটে, কিন্তু শিল্পের পুনরুদ্ধার কোনও নির্দিষ্ট নিয়মে চলে না, ক্ষেত্রবিশেষে পরিবর্তিত হয়।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
হাহাকারময়
বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। এই কারখানাটির মৃত্যু হয়েছিল ২০১৪ সালের মে মাসে। হাহাকার উঠেছিল শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। কী ভাবে সংসার চলবে ভাবতে ভাবতেই হারিয়ে গেলেন কয়েক হাজার শ্রমিক কর্মচারী, ভাগ্যের অতল গহ্বরে। আজকের দিনে এই হিন্দমোটরের কারখানার কথা স্মরণ করতে গিয়ে একই ভাবে মনে পড়ছে সিঙ্গুরের টাটা মোটরসের কারখানা বিদায়ের কথা। কিন্তু সেই সময়ের ‘অগ্নিকন্যা’ ভেবেছিলেন এমনই এক আধুনিক অটোমোবাইল হাব যদি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে গড়ে ওঠে তবে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আর থাকবে না। ইতিহাস বলছে যে, প্রদেশের মাটিতে এমন শিল্প গড়া হলে এর পরে আর কাজের জন্য সে ভাবে বাইরে ছুটতে হয় না। যখন কারখানায় অনেকটাই কাজ শেষ হয়েছে সেই সময় বিরোধী নেত্রী এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে টাটাকে তাড়িয়ে দিয়ে মুঠো মুঠো সর্ষে বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
রতন টাটা বলেছিলেন ট্রিগার টিপে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর কোনও ভাবেই ফেরত আসার সম্ভাবনা থাকল না। মুখ্যমন্ত্রী তার পরের ১৪ বছরের মধ্যে একটাও শিল্প গড়তে পারলেন না। আজ সেই মোটর কারখানার পরিত্যক্ত জমিতেও পশ্চিমবঙ্গের বেকার যুবকদের হাহাকার ঘুরে ফিরে আসছে। টাটারা সেই কারখানা গুজরাতের সানন্দে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। এ সব উপাখ্যান সব ভারতীয়ই জানেন।
হিন্দুস্তান মোটরস-এর সেই অ্যাম্বাসাডরকে শখ করে বলা হত— ‘হিন্দুস্থান কি জান, হিন্দুস্থান কি শান’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় এসে অ্যাম্বাসাডর-এর পরিবর্তে আধুনিক মডেল তৈরি করতে পারতেন, পরিবর্তে বেকার যুবকদের হাহাকার সৃষ্টি করলেন। ফলে, শিক্ষিত বেকারদের লম্বা লাইন বাড়ছে দক্ষিণের রাজ্যে।
বীরেন্দ্র নাথ মাইতি, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
বিষাদছায়া
বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা’ প্রবন্ধ পড়ে মনটা বিষাদে ভরে গেল। সাধারণত কয়েকটি কারণে চালু কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমত, উৎপন্ন পণ্য যদি সময়োপযোগী না হয়। দ্বিতীয়ত, মালিক যদি কারখানার আধুনিকীকরণের জন্য মূলধন বিনিয়োগ না করেন। তৃতীয়ত, শ্রমিকদের অন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য বন্ধ ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় সরকার হিসেব করে দেখিয়েছে দুই শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়েছে শ্রমিকদের কারণে। হিন্দমোটর কারখানা বন্ধের কারণ বিড়লা গোষ্ঠী এই কারখানায় আর বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক ছিল না। এ ছাড়া তখন নতুন নতুন কারখানা থেকে নতুন ডিজ়াইনের ঝকঝকে গাড়ি বার হচ্ছিল।
কারখানা বন্ধ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু জায়গাটা তো এখনও পড়ে আছে। নতুন কোনও শিল্পপতি যদি এখানে কোনও কারখানা খোলেন, তবে তো মন্দ হয় না। তবে তার আশা খুব কম। শিল্পপতিরা সিঙ্গুরের হাল দেখে হয়তো ঝুঁকি নিতে চান না।
সঞ্জয় চৌধুরী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
জ্ঞানের যাত্রা
স্বাগতম দাসের ‘জ্ঞান যেথা মুক্ত’ (৭-২) নামে লেখাটি অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিক হায়েক-এর দু’টি প্রবন্ধের কথা মনে করায়। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ‘দি ইউজ় অব নলেজ ইন সোসাইটি’ প্রবন্ধে হায়েক এমন এক কেন্দ্রীয় পরিকল্পকের বিফলতাকে বিশেষ ভাবে দেখান, যিনি কাজ করেন সবজান্তা এক গোষ্ঠীর মতো যা বিকাশ সম্পর্কে স্বকীয় ধারণা বা স্বপ্নকে জোর করে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। পরে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত বইয়ে তিনি সেই মানুষটিকে ব্যঙ্গ করেন, যিনি মনে করতেন তাঁর চার পাশের পৃথিবীকে নিজের ইচ্ছামতো রূপায়িত করতে পারেন। হায়েক এই দু’ক্ষেত্রেই যা বলতে চেয়েছেন তা ‘ডিপসিক’-এরই ইঙ্গিত বা ফলিতার্থে তা প্রযোজ্য। প্রথমত, ছাপাখানার সূচনা থেকে জ্ঞানের একচ্ছত্র অধিকার গির্জা হারায়, কারণ তার আগে গির্জার বাইরে বইয়ের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। সেই থেকে জ্ঞানের বিস্তার অদম্য বেগে ছুটে চলেছে। তফাত যেটুকু তা হচ্ছে অনুসৃত পদ্ধতি এবং সদ্ব্যবহারের গতিপ্রকৃতিতে।
বুদ্ধিমত্তার জ্ঞানও আলাদা নয়, পৃথিবীব্যাপী তা ছড়িয়ে পড়েছে, তার উৎকর্ষের মাত্রা ও সদ্ব্যবহারের হেরফেরে কেউ তা থেকে বেশি সুযোগ পেয়েছে, কেউ পায়নি।
মনোজ ঘোষ, কলকাতা-৬১
আলস্য ভীষণ
সম্পাদকীয় ‘উদ্যোগ কাহিনি’ (৯-২) প্রসঙ্গে এই চিঠি। বাঙালিরা বাণিজ্যমেলায় অধুনা কেন অনুদ্যোগী তার কারণ সাংস্কৃতিক মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাসে নেই, আছে বতর্মান রাজনৈতিক বাস্তবতায়। নইলে মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যগুলিতে যে বণিক বাঙালি নায়করা, চাঁদ বেনে, ধনপতি সওদাগররা সপ্তডিঙা ভাসিয়ে এই সপ্তগ্রাম থেকে সুদূর সিংহল দ্বীপ থেকে বহির্বিশ্বের বাণিজ্যজগতে প্রবেশ করতে পেরেছেন, তাঁদের উত্তরসূরিরা কেন বাণিজ্যিক ঝঞ্ঝাট এড়াতে চাইবেন?
আমাদের প্রাকৃতিক ও জলবায়ুর অবস্থাও বিবেচ্য। যেখানে ঘরে বোঝাই করা ধান, গোয়ালে দুগ্ধবতী গরু, পুকুরে মাছ থাকত, সেখানে মানুষ তো অলস হবেনই। বঙ্গতনয়রা যেখানে ব্যবসা, মানে ‘বিজ়িনেস’ বা ব্যস্ত থাকা, সে দিকে যায় নাকি? ব্যবসা-বাণিজ্যের বিড়ম্বনায় তাঁরা উত্ত্যক্ত হতে চাইবেন কেন?
তপোময় ঘোষ,কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)