E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ভীতি ও ভালবাসা

শশিভূষণ দাশগুপ্ত ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য গ্রন্থে লিখেছেন, “কালীর ধ্যানরূপ কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে গৃহীত হ‌ইয়াছে এবং কালীর এই রূপ‌ই এখন সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের মাতৃপূজায় গৃহীত।”

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৫৪

বাংলার কালীপুজো এক টোটাল প্যাকেজ। স্বয়ং মা কালীর ভয়ঙ্করী রূপ, ঘোর অমাবস্যা, শ্মশানঘাট, ডাকিনী-যোগিনী, কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বর-তারাপীঠ, ডাকাতকালী, বামাখ্যাপা, রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ-ত্রয়ী, তন্ত্রমন্ত্র, রামপ্রসাদ, শ্যামাসঙ্গীত, রক্তজবা, বাজি— সব এক ভয়মিশ্রিত আনন্দ। কালীপুজোর গভীর দার্শনিক দিকটি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলে জানা যায়, তন্ত্র ও পুরাণে দেবী কালিকার অনেক রূপ। গুণ ও কর্মভেদে তিনি ভিন্ন শরীরা, কিন্তু স্বরূপে তিনি নিরাকার। শশিভূষণ দাশগুপ্ত ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য গ্রন্থে লিখেছেন, “কালীর ধ্যানরূপ কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে গৃহীত হ‌ইয়াছে এবং কালীর এই রূপ‌ই এখন সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের মাতৃপূজায় গৃহীত।” বাংলার ঘরে বা মণ্ডপে যে কালীমূর্তি দেখি, শ্যামাসঙ্গীতে তাঁর রূপের যে বিবরণ, তার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় সেই রূপ। “রাঙা রক্তধারা ঝরে কালো অঙ্গে।” ‘তরঙ্গিনী’ প্রবন্ধে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখছেন,“মহাকালের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে কাল বা কালী।... মহাকালের বুকের ওপর খণ্ডকাল, স্পর্ধা, অহঙ্কার জিব কেটে লজ্জিত। তাঁর দুই দক্ষিণ হস্তে তখন বর ও অভয়।” রামকৃষ্ণের কথায়, “এই শ্যামাকালীর অনেকটা কোমলভাব। তিনি শ্মশানকালীর মতো শুধু সংহারিণী নন, সৃষ্টির বীজ তিনি কুড়িয়ে রাখেন।”

বাংলার বিভিন্ন জেলায় নানা নামে ও নানা রূপে মা কালীর পুজো প্রচলিত। বর্ধমানের কাঞ্চননগরের ‘কঙ্কালেশ্বরী কালী’ কিন্তু চতুর্ভুজা নন, অষ্টভুজা। বীরভূমের দুবরাজপুরে অভিযান সিনেমাখ্যাত মামা-ভাগ্নে পাহাড় অঞ্চলে চারশো বছর ধরে পূজিতা হন বিবসনা বারো হাত পাহাড়েশ্বর শ্মশানকালী। সারা বছর ধরে চলে এই পুজো, পূজারি বসেন পেরেকের আসনে। আবার হাওড়ার শিবপুরে হাজার হাত কালী। তাঁর পদতলে শিব ঠাকুর নেই, প্রসন্ন হাসি তাঁর মুখে। দেবী বাঁ পা রেখেছেন সিংহপৃষ্ঠে। চুঁচুড়ার খড়োবাজার অঞ্চলে প্রসিদ্ধ দয়াময়ী কালী বাদশা আকবরের আমল থেকে প্রসিদ্ধ। উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙার মঠবাড়িতে আকবর সেনাপতি মানসিংহ নাকি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন করুণাময়ী কালীর মন্দির। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মজিলপুরে তিনশো বছরের প্রাচীন ধন্বন্তরী কালী কষ্টিপাথরে নির্মিত। বসন পরিহিতা, সালঙ্কারা, ত্রিনয়নী দক্ষিণাকালী। অম্বিকা-কালনার নিম কাঠের বিগ্রহ সিদ্ধেশ্বরী কালী সমান প্রসিদ্ধ। কাঁথি শহরে কপালকুণ্ডলা কালীর অধিষ্ঠান। একদা কাপালিক দ্বারা পূজিতা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাঁথিতে থাকাকালীন এঁর‌ই অনুপ্রেরণায় লিখেছিলেন কপালকুণ্ডলা।

দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডাকাতদের নামেই কালীর‌ও নামডাক, যেমন রঘু ডাকাতের কালী, চিতে ডাকাতের চিত্রেশ্বর কালী বা ভবানী পাঠকের কালী ইত্যাদি। বিবেকানন্দের কাছে কালী ছিলেন মৃত্যুস্বরূপা। রামপ্রসাদ লিখেছেন, “কে জানে রে কালী কেমন। ষড়দর্শনে না পায় দরশন।” রামকৃষ্ণদেব কালীকে দেখতেন এই জগৎসংসারের মহাগৃহিণী রূপে। তাই তিনি দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীকে সাজাতেন ভূষণে, অলঙ্কারে। আবার রাজর্ষি উপন্যাসে জয়সিংহ বলেন, “তুই এমন পাষাণী! রাক্ষসী, সমস্ত জগৎ হইতে রক্ত নিষ্পেষণ করিয়া লইয়া উদরে পুরিবার জন্য তুই ওই লোলজিহ্বা বাহির করিয়াছিস। স্নেহ, মমতা, সৌন্দর্য, ধর্ম সমস্তই মিথ্যা, সত্য কেবল ওই অনন্ত রক্ততৃষা।”

সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৪২

কালীর শহরে

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদ উৎসব শেষ হতে না হতেই শুরু হয় কালীপুজোর প্রস্তুতি। মূলত অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির বিজয়ের প্রতীক রূপে কালীপুজো করা হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে পালিত এই পুজো, যা নিয়ে বাঙালির মধ্যে যথেষ্ট আবেগ ও উৎসাহ দেখা যায়। এই অমাবস্যা তিথি দীপান্বিতা অমাবস্যা নামেও পরিচিত। কালীপুজো পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি ও প্রতিবেশী দেশেও মহা সমারোহে পালিত হয়। নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ নাকি কালী মূর্তির প্রতিমা পুজো প্রচলন করেন। এর আগে কালীর উপাসকেরা তাম্রপটে বা খোদাই করে কালী সাধনা করতেন বলে প্রচলিত বিশ্বাস।

শারদোৎসব বললে যেমন কলকাতা, জগদ্ধাত্রী পুজো বললে যেমন চন্দননগরের কথা সকলের মনে আসে ঠিক তেমনই কালীপুজোর কথা বললেই দক্ষিণবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসতের কথা সকলের মনে আসে। শহরটির দূরত্ব কলকাতা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার। বারাসতের কালীপুজো সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বৃহত্তম। যা কলকাতার দুর্গাপুজোর সমতুল্য বলা যেতে পারে। এখানে যেমন থিমের বৈচিত্র নজর কাড়ে তেমনই প্রতিমার গড়ন, অলঙ্করণ দর্শকদের মুগ্ধ করে। উৎসবের দিনগুলিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম চোখে পড়ে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ভিড় করেন এই পুজোমণ্ডপগুলিতে। এই সময় প্রশাসনকেও যথেষ্ট সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। পূর্ব রেলের তরফে এই সময় রাতে অতিরিক্ত ট্রেন চালাতেও দেখা যায়। বারাসতের পাশাপাশি মধ্যমগ্রাম, নৈহাটি, বাগদার পুজোও অত্যন্ত জনপ্রিয়।

মণ্ডপগুলিতে কালী মায়ের পাশে শিব এবং দুই বিখ্যাত সাধক রামকৃষ্ণ ও বামাখ্যাপাকেও দেখা যায়। বারাসতের বহু পুরনো বেশ কিছু কালী মন্দির এই উৎসবকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। প্রাচীন কালী মন্দিরগুলির মধ্যে প্রায় ৫০০ বছরের পুরাতন বারাসত কাজিপাড়ার ডাকাত কালী মন্দিরের কথা সবার প্রথমে বলতে হয়। কথিত আছে, রঘু ডাকাত ও তাঁর ভাই বিধু ডাকাত ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে এই মন্দিরে পুজো দিয়ে মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বার হতেন। এখানে একটি অষ্টধাতুর মূর্তি ছিল। যদিও তা চুরি হয়ে যায়। এখানে একটি সুপ্রাচীন বটগাছ আছে। তাকেই স্থানীয় মানুষেরা কালীমাতা রূপে ভক্তিভরে পুজো করেন।

চোখে পড়ে বড় বাজেটের পুজোমণ্ডপ এবং তাদের অভিনব থিম। উৎসবের আমেজে আলোকসজ্জায় মুখরিত হয়ে ওঠে এই শহর। এ বারেও স্থান, মাহাত্ম্য, ইতিহাস, জনশ্রুতি মিলেমিশে থাকবে বারাসতের কালীপুজোয়।

সুদীপ গুহ, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা

পুরাতনী স্বাদ

নীলাঞ্জন মিশ্রের ‘দিনান্তবেলার ফসল’ (৪-১০) নামাঙ্কিত প্রবন্ধ নিয়ে কিছু কথা। আজকের উচ্চফলনশীল ধানে আগের স্বাদ ও গন্ধ উধাও। নৈনীতাল, বাঁশঝাড়ে, আলতাপাটি প্রভৃতি মধুর স্বাদের আলু আজ আর নেই। তেঁতুল বীজ যাকে কাঁইদানা বলতাম, মাটির খোলাতে গরম বালির উপর ভেজে, বন থেকে আনা মহুয়া গাছের ফল দিয়ে, প্রয়োজন মতো নুন দিয়ে হাঁড়িতে সেদ্ধ করা হত। কাঁইসেদ্ধর গন্ধে সারা পাড়া ম ম করত। সেই স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। কাঁঠাল বীজ আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া, তরকারি করে খাওয়া। দিঘিতে বা পুকুরে অজস্র শালুক ফুল ফুটত, তার বীজ বালিতে ভেজে খই হত, আমরা বলতাম ভ্যাটের খই। হলুদ দিয়ে রাঙানো হলুদ মুড়ি, তার সঙ্গে কুসুমবীজ ভাজা এ প্রজন্মের কাছে অজানা।

সে সময় চাষি সামান্য হলেও ঘর খরচের জন্য আখ চাষ করতেন। ফাগুন-মাঘ মাসে গ্ৰামে বলদ দিয়ে ঘোরানো আখশাল হত। ছোলাভাজা দিয়ে গুড়ের পাটালি, চ্যেং গুড় আর মাটির পাওয়া ভর্তি নতুন গুড়ের সুবাসে মন মদির হত। কিন্তু আজ সবই ইতিহাস।

রাজীব ঘোষ, কুসুমদিঘি, বাঁকুড়া

বই হারে না

আগে দেখা যেত ট্রেন-সফরে যাত্রীদের হাতে গল্প, উপন্যাস! এখন সেখানে শুধু মোবাইলে গেম, সিনেমা, কমেডি শো ইত্যাদি। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য বইমেলায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা যথেষ্ট ইতিবাচক। বই-বিক্রি আশাপ্রদ! কচিকাঁচাদের বই নেওয়ার উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। মোবাইলে তো সব পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু বইয়ের পাতার গন্ধের টানকে কি অস্বীকার করা যায়?

বিশ্বজিৎ কর, কলকাতা-১০৩

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

goddess kali

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy