Advertisement
০৭ মে ২০২৪

সম্পাদকীয় সমীপেষু: অতুলনীয় ঈশ্বর

প্রসঙ্গক্রমে, ‘বাংলা ভাষার জনক কে?’ এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। ‘সন্তানের পিতৃত্ব নিরূপণের মতো ভাষার পিতৃত্ব নিরূপণ নিঃসন্দিগ্ধ নয়। ভাষা সম্বন্ধে একজনকত্ব অপেক্ষা বহুমাতৃত্বই প্রযোজ্য। মৃত্যুঞ্জয় এই নবজাত ভাষাশিশুকে সুতিকাগৃহে স্তন্য দিয়েছিলেন, রামমোহন একে কৈশোরক্রীড়ার ক্ষেত্রে আপন নৈপুণ্য ও শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে শিখিয়েছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র একে পূর্ণ গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রতিষ্ঠিত করে জীবনের বিচিত্র কর্তব্যপালনের উপযোগী দীক্ষায় অভিষিক্ত করেছেন।’

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৯
Share: Save:

‘‘লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্যে! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত।’’ নেহাত আমাদের পাঠ্য ছিল ‘সীতার বনবাস’, নইলে অবধারিত ভাবে ‘পথের পাঁচালী’র অপুর মতো মনে হত, ‘‘খুঁজে বার করতে হবে কোথায় আছে এই লেখা।’’ যেটুকু তাঁর লেখা পড়েছি, সমৃদ্ধ হয়েছি তাঁর গদ্য-সাহিত্যে, রবীন্দ্রনাথের উক্তি দিয়েই যথাযোগ্য সম্মান জ্ঞাপন করা যায় সেই বিষয়ে। ‘‘বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিন্যস্ত ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন।... তিনি সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলা নৈপুণ্যের অবতারণা করেন।’’

প্রসঙ্গক্রমে, ‘বাংলা ভাষার জনক কে?’ এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। ‘সন্তানের পিতৃত্ব নিরূপণের মতো ভাষার পিতৃত্ব নিরূপণ নিঃসন্দিগ্ধ নয়। ভাষা সম্বন্ধে একজনকত্ব অপেক্ষা বহুমাতৃত্বই প্রযোজ্য। মৃত্যুঞ্জয় এই নবজাত ভাষাশিশুকে সুতিকাগৃহে স্তন্য দিয়েছিলেন, রামমোহন একে কৈশোরক্রীড়ার ক্ষেত্রে আপন নৈপুণ্য ও শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে শিখিয়েছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র একে পূর্ণ গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রতিষ্ঠিত করে জীবনের বিচিত্র কর্তব্যপালনের উপযোগী দীক্ষায় অভিষিক্ত করেছেন।’ এই অতীব উত্তম সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় ‘বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ড. অমিয় বক্সী সম্পাদিত)।

এখন পুজো নিয়ে মোচ্ছব, দেখনদারির রমরমা, সব তুচ্ছ হয়ে যায় শঙ্খ ঘোষ উদ্ধৃত (‘বড় কাজ একাই করতে হয়’, ২৬-৯) ঈশ্বরচন্দ্রের কথায়, ‘‘গরিবদের সারা বছর দু’মুঠো খাওয়াতে পারলে পুজো না করলেও চলবে।’’

যে স্বপ্ন, যে কাজ রূপায়িত করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে সেই সময়ে কেউ সাহস পাননি, ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর স্থিতধী দৃঢ়চেতা মানসিকতায় সেই বিধবাবিবাহের মতো দুরূহ কাজ সম্পন্ন করলেন সহস্র সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়ে। ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ তাঁর বন্ধুর বালিকা কন্যা প্রভাবতীর মৃত্যু উপলক্ষে রচিত। বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বহুবিবাহ নিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে যাঁরা বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করতেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর লিখলেন, ‘অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩) এবং ‘ব্রজ বিলাস’। এগুলি ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয় (তথ্য: ‘বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত’)। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁর ছেলে যখন বিধবা বিবাহে সম্মতি প্রদানের জন্য বাবার কাছে অনুমতি চান, তখন তাঁর মনে হয়, ছেলে স্বাধীন ভাবে এই কাজে ব্রতী হয়ে তাঁর মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরা বাপ-কা-বেটা হরবখত আওড়ে থাকি। বিদ্যাসাগর-পুত্র সম্ভবত তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী

কলকাতা-১২৫

কী পরিণতি!


১৮৭০-এ ১১ অগস্ট কৃষ্ণনগরের বিধবা কন্যা ১৪ বছরের ভবসুন্দরীর বিয়ে হয়ে গেল বিদ্যাসাগর-পুত্র ২২ বছরের নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে। চার দিন পরে ভাই শম্ভুচন্দ্রকে লিখলেন, ‘‘নারায়ণচন্দ্র স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া, আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে এবং লোকের নিকট আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে...। আমার পুত্র বিধবাবিবাহ না করিয়া কুমারী-বিবাহ করিলে আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিতাম না। বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎ ধর্ম। এজন্মে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোন সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই। এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্তস্বীকারেও পরাঙ্মুখ নহি।’’

ছেলের বিয়ের ঠিক চার বছর পরে বাবা বিদ্যাসাগর তাঁর কলকাতার বাড়িতে ছেলের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। পরের বছর যে উইল করলেন, তার ২৫ নম্বর ধারায় লিখলেন, ‘‘আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী। এজন্য ও অন্য অন্য গুরুতর কারণ বশতঃ আমি তাঁহার সংস্রব ও সম্পর্ক ত্যাগ করিয়াছি। সেই হেতু বশতঃ বৃত্তিনিবন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে...।’’

জীবনশেষে তাঁর শ্রেষ্ঠ কর্মের পরিণতি জানা যায় তাঁর নিজের লেখা একটি চিঠিতে। বিখ্যাত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা ডাক্তার দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছেন, ‘‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে, আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না। তৎকালে সকলে যেরূপ উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলেন তাহাতেই আমি সাহস করিয়া এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম নতুবা বিবাহ ও আইন প্রচার পর্যন্ত করিয়া ক্ষান্ত থাকিতাম। দেশহিতৈষী সৎকর্মোৎসাহী মহাশয়দিগের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া ধনে প্রাণে মারা পড়িলাম। অর্থ দিয়া সাহায্য করা দূরে থাকুক কেহ ভুলিয়াও এ বিষয়ে সংবাদ লয়েন না।’’
অরুণকান্তি দত্ত
বেলুড় মঠ, হাওড়া

সেই ব্যাঙ্ক


‘পাড়ার ব্যাঙ্ক ইউনাইটেড’ (১৬-৯) পড়ে আফসোস হয়। এক শতাব্দী পূর্বেও বাঙালির সমৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয়। আর ছিল বাঙালির ব্যাঙ্কও, পুরোপুরি বাঙালি মালিকানা। যে চারটি ব্যাঙ্ক মিলে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক হয়েছিল তা নিবন্ধের লেখক জানিয়েছেন। সেই চারটি ব্যাঙ্কের কর্ণধার ছিলেন নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, ইন্দু ভূষণ দত্ত, জে সি দাস এবং ডি এন মুখোপাধ্যায়। এঁদের মধ্যে প্রথম জনের নামে কলকাতার ব্যাঙ্কপাড়ায় একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছিল বেশ কয়েক দশক আগে। তাঁরই সুপুত্র বটকৃষ্ট দত্ত চেয়ারম্যান থাকাকালীন ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের জাতীয়করণ হয়। ব্যাঙ্ক হিসেবে জাতীয়করণের আগে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক ছোটই ছিল, অল্প ব্যবসা, সারা দেশে পৌনে দু’শোটির মতো শাখা, যার আশি শতাংশই পূর্বাঞ্চলে, কিন্তু লোকসান দিয়ে ব্যবসা নয়। আর গ্রাহক পরিষেবা ছিল চমৎকার।
ষাটের দশকে ব্যাঙ্কের গুয়াহাটি শাখায় প্রথম খাতা খুলি। ১০০ টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলায় চেক বই দেওয়া হয়েছিল। ম্যানেজার যত্ন করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন চেকবইয়ের কত গুরুত্ব। চেকে বাংলায় লেখা ‘ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া লিঃ’ দেখে কী আনন্দ! পুরো চেকবইতে সব লেখা অবশ্যই ইংরেজিতে। টাকা জমা বা তোলায় কোনও সমস্যা নেই, তাই অভিযোগ করার প্রয়োজন হত না, কোনও গ্রাহক এমনি দাঁড়িয়ে থাকলে ম্যানেজার (তখন এজেন্ট বলা হত) জানতে চাইতেন, কী সমস্যা।

জাতীয়করণের পর থেকেই বাঙালির একমাত্র ব্যাঙ্কের অধঃপতন শুরু। লেনদেন, শাখাবিস্তার বেড়েছে, কিন্তু কর্মীদের মধ্যে ‘সরকারি বাবু’ ভাব স্পষ্ট, দেরি করে আসা, লেনদেনে অস্বাভাবিক বিলম্ব ইত্যাদি অনিয়মে। নালিশ করে লাভ নেই, কারণ ম্যানেজারও যে সরকারি! এর পর শুরু হল লোন মেলা। রাজনৈতিক বাবু, মন্ত্রীদের অনুপ্রেরণায় রাম, শ্যাম, যদু, মধুরা লোন পেয়েছে, যার প্রয়োজন নেই সেও পেয়েছে। এই সব ঋণ অনাদায়ী থেকে গিয়েছে, ব্যাঙ্ক কিছুই করতে পারেনি। অন্য ঋণ আদায়েও এই ব্যাঙ্ক তেমন কিছু করতে পারেনি, তাই শতাংশের হিসেবে দেশে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ এই ব্যাঙ্কেরই সর্বোচ্চ। ব্যক্তিগত কারণে এক বার ৩০ লক্ষ টাকার বাড়ি বন্ধক রেখে এক লক্ষ টাকা ধার চাওয়ায়, ব্যাঙ্ক তিন লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজ়িট চেয়েছিল। সম্পত্তি বন্ধক রেখে লোন নয়, জানিয়েছিলেন সেই ম্যানেজার।
গত দুই দশক ধরে কোর ব্যাঙ্কিং চালু হলেও, সিবিএস পরিষেবা তেমন ছিলই না বলা যায়, কারণ হোম ব্রাঞ্চ ছাড়া অন্য ব্রাঞ্চ কোনও কাজ করতে চায় না। এমনকি দু’চার হাজার টাকার বেশি তুলতে চাইলে হোম ব্রাঞ্চে যেতে হয়। আর একটি নালিশ, হিন্দির সন্ত্রাস! কলকাতার ব্যাঙ্ক, অথচ কোনও একটি শাখায় দেখেছি কোনও বাংলা লেখা নেই, আছে কেবল হিন্দি ও ইংরেজি।

তিনটি ব্যাঙ্ক মিশে নতুন যে ব্যাঙ্ক হবে সেটি যেন পুরনো দোষত্রুটি ঝেড়ে ফেলে চমৎকার পরিষেবা দেয়।
কিশোর পালচৌধুরী
কল্যাণী, নদিয়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ishwar Chandra Vidyasagar Bank Letter to the editor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE