Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Rabindranath Tagore

সম্পাদক সমীপেষু: এক টুকরো রবীন্দ্রনাথ

মনে পড়ে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি নকল করে দেখাতাম, সুবিনয় রায় যদি মহিলা হতেন, তা হলে এ রকম করে গাইতেন।

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০১:০২
Share: Save:

‘রাবীন্দ্রিক’-এর কি সংজ্ঞা হয় কোনও? রবীন্দ্রনাথের যে গানগুলো খুব দৃপ্ত, সেগুলো যেন সুচিত্রাদি, সুচিত্রা মিত্রের গান হয়ে গিয়েছে। ধীর, স্থির, টপ্পাঙ্গের গানগুলো শুনে মনে হয়, ওগুলো মোহরদির, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আর সুবিনয় রায়ের জন্য, মনে হয়, যেন ক্লাসিক্যাল-ভাঙা গানগুলো। আমার বাবা লখনউয়ের মানুষ, গান শিখিয়েছেন, পড়িয়েছেন ভাতখণ্ডে ইউনিভার্সিটিতে, মা ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্রী। দেবব্রত বিশ্বাস যেমন আমার গানের ধারার একটা দিক, সুবিনয় রায়ও। ক্লাসিক্যাল গানটা জানলে যে রবীন্দ্রনাথের গান আরও ভাল করে গাওয়া যেতে পারে, সুবিনয় রায়ের গান শুনলে সেটা একটা প্রমাণ বলে মনে হয়। এত আকর্ষণ করে ওঁর গান! সুধাসাগরতীরে হে, ডাকে বার বার ডাকে— কত প্রিয় গানের কথা লিখব! মনে পড়ে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি নকল করে দেখাতাম, সুবিনয় রায় যদি মহিলা হতেন, তা হলে এ রকম করে গাইতেন। উনি যখন গান পরিবেশন করতেন, মাথাটাকে এক পাশে একটু হেলিয়ে গাইতেন। আমার আর একটা ব্যক্তিগত ভাল লাগা— ওঁর সঙ্গে আমার বাবার চেহারার সাদৃশ্য। সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবিনয় রায়, দেবব্রত বিশ্বাস— এঁরা সবাই আমার কাছে টুকরো টুকরো রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে যদি কয়েকটা ভাগে ভাঙা যায়, তার এক টুকরো সুবিনয় রায়— রবীন্দ্রনাথের ক্লাসিক্যাল ঘরানার গানের শিক্ষাগুরু। কী ভাবে সুর লাগাতে হয়, তার শিক্ষক। ক্লাসিক্যালটা ভাল করে জানব, রবীন্দ্রগানে রাগরাগিণী কেমন ভাবে আছে তা দেখাব, অথচ তার ওস্তাদিটা দেখাব না, সেটাই উনি শিখিয়েছেন। প্রতি দিন ওঁর গানে থাকি। এ বছর ওঁর জন্মশতবর্ষ। ‘বহে নিরন্তর’ (১১-১, কলকাতার কড়চা) পড়ে ভাল লাগল, ওঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম।

স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, কলকাতা-৬৪

চিরনির্ভর

সুবিনয় রায়ের ছাত্র হওয়ার সুবাদে তাঁকে দীর্ঘ দিন কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। শতবর্ষে জানাই কয়েকটি কথা, যা আড়ালে চলে গিয়েছে। তাঁর সময়ের বেশ কিছু জনপ্রিয় শিল্পীকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম দিয়েছিলেন তিনি। পঙ্কজকুমার মল্লিক তাঁর অগ্রজ, কিন্তু সুবিনয়ের কাছে শিখে রেকর্ড করেন ‘সঘন গহন রাত্রি’। জীবনপ্রান্তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুবিনয়-শিক্ষায় রেকর্ড করেন ‘তিমির অবগুণ্ঠনে’-সহ কিছু গান। আজীবন রবীন্দ্রগানে বিভোর থাকলেও চর্চা করেছেন শাস্ত্রীয় এবং ব্রহ্মসঙ্গীতের। সদা সঙ্গী থেকেছে রবীন্দ্রভাবনা ও সাহিত্য। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের উদ্যোগে বিলেতে যান লাইব্রেরি সায়েন্সের পাঠ নিতে। দেশে ফিরে কাজ শুরু করেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে। সেখানকার নিত্যকর্ম ব্যতীত সমস্ত সময় জুড়েই একাগ্র থেকেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার-প্রসার ও শিক্ষণে। ষাটের দশকের প্রথম ভাগে বর্তমান ছাত্রের অভিজ্ঞতা, শিক্ষক সুবিনয় ক্লান্তিহীন। ঠাট্টায়, ধমকে ঠিক সুর আদায়ে তিনি ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। তাঁর মতে, “একটা গান আয়ত্ত করতে গেলে কম করে ৬৫ বার (১৩ দিনে নিয়মিত পাঁচ বার করে) গাইলে ১৪তম দিনে সেটা সম্ভব হতে পারে। তার পর পরিবেশনের জন্য জোর দিতে হবে স্বকীয় শিল্পসত্তায়।”

আজকে ‘চটজলদি গান তোলার’ যুগে তা অভাবনীয়। শিক্ষক হিসেবে নজর থাকত সব দিকে। মনে পড়ে এক বর্ষামুখর সন্ধ্যার কথা। আমি তখন হাওড়ার বাসিন্দা, সুবিনয় রায় বালিগঞ্জ প্লেসে। মুষলধারে বৃষ্টি। কোমরজল ভেঙে পৌঁছলাম গুরুগৃহে। তিনি অবাক— কেউ আসেনি সে দিন। ভিন্ন শিক্ষায় স্নাত হল ছাত্রজীবন। নিজের পাঞ্জাবি-পাজামা দিলেন। চা-জলখাবারের সঙ্গে রেকর্ড শোনানোর আসর। রবিশঙ্করের সেতারে তিন মিনিটের মল্লার (তবলায় কানাই দত্ত), আমির খাঁ সাহেবের তিন মিনিটের মেঘ। আদি রেকর্ড বাজছে, তিনি সংযোজন করছেন রাগ-তালের সংক্ষেপ-বৈশিষ্ট্য। বৃষ্টি থামলে রিকশা ডেকে তুলে দেন।

বিশ্বভারতীতে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ছাত্র ছিলেন সুবিনয়। নানা আসরে তাঁর আহ্বানে গান শুনিয়েছেন মেনকা ঠাকুর, অমিয়া ঠাকুর, কত গুণী জন। কারণ সুবিনয় চাইতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদি, শুদ্ধ রূপটির সঙ্গে পরিচিত হন ছাত্রছাত্রী ও সঙ্গীতানুরাগীরা। ছাত্রছাত্রীদের ‘শুদ্ধসঙ্গীত’ শিক্ষার জন্য গড়ে তুলেছিলেন ‘শ্রুতি-পরিষদ’। শুদ্ধতা ও স্বকীয়তা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের স্বরলিপিকার ও বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পী রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষায় সুবিনয় গেয়েছেন ‘জাগে নাথ জোছনারাতে’। রমেশচন্দ্রের গায়ন বলিষ্ঠ, সমর্পণের মধ্যে সুরের ঝঙ্কার। ছাত্র সুবিনয়ের গলায় সেই গানেই মেলে শান্ত আত্মনিবেদনের ভাব। রবীন্দ্রগানের বাইরে নিয়মিত পরিবেশন করতেন ব্রহ্মসঙ্গীত। স্বরলিপি রচনা করেছেন বহুবিধ গানের।

দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-২৯

একাত্তরে

‘এক সঙ্গে লড়েছে দুই বেতার’ (কলকাতার কড়চা, ১৪-১২) লেখাটি পড়ে সেই সময়ের আবেগ, দৃশ্যপট যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। মুক্তিযুদ্ধের সময় খবর পাওয়ার প্রধান অবলম্বন ছিল আকাশবাণী কলকাতা। পরে মিডিয়াম ওয়েভের নব ঘুরিয়ে পাওয়া গেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। শুনতে হত খুব গোপনে। কিন্তু হানাহানি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, আমরা উৎখাত হয়ে এ পার বাংলায় চলে এলাম। আর সেখানে ফিরে যাওয়া হয়নি। প্রথমে জানতাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যশোর বর্ডারে। কিন্তু এ পারে এসে জানতে পারলাম, সেটিও কলকাতা থেকেই সম্প্রচারিত হচ্ছে।

আমার মা অবিভক্ত ভারতে খুলনা শহরে করোনেশন গার্লস হাই স্কুলে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর আগ্রহে বাবা কলকাতা থেকে কিনে এনেছিলেন মার্ফি মনার্ক রেডিয়ো। আমাদের বাড়িতে সব সময় চলত আকাশবাণী কলকাতা। অনুষ্ঠান শুরুর আগে বিখ্যাত বাজনা, ছ’টার সময় সুকণ্ঠে ঘোষিত হত ‘বন্দে মাতরম্‌’। রেডিয়োর অনুষ্ঠান অনুযায়ী ঘড়ি মেলানো হত।

মুক্তিযুদ্ধের ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে বেশি করে খবর শোনা হত। দিল্লির খবর ও স্থানীয় সংবাদ, অর্থাৎ কলকাতার খবর। ২৫ মার্চ স্বাধীন বাংলা সরকার ঘোষণা করা হল, এবং পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হল। ঢাকা রেডিয়ো মুজিবুর রহমানের বিখ্যাত ভাষণ প্রচার করল: ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’; কিংবা পাক সরকারকে হুঁশিয়ারি, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ কিন্তু খানসেনারা ঢাকা রেডিয়ো দখল করে ও মুক্তিফৌজের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার শুরু করে। আমরা আকাশবাণী কলকাতায় শুনতাম উপেন তরফদারের ‘সংবাদ বিচিত্রা’, প্রণবেশ সেন লিখিত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘সংবাদ পরিক্রমা’।

যশোর, খুলনা জেলা ছিল কলকাতার কাছাকাছি, হিন্দুপ্রধান ও মুক্তিফৌজের সমর্থক। শোনা গেল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। রেডিয়োর নব ঘুরিয়ে পাওয়া গেল তাকে। আওয়াজ কমিয়ে শোনা হত উত্তেজনাময় ভাষণ; এবং সেই সব গান, যা তখন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল— ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’, ‘শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।’ আকাশবাণীতে শোনা গেল, ভারতীয় সেনাবাহিনী আসছে মুক্তিফৌজকে সাহায্য করতে। এ কথা ঐতিহাসিক সত্য যে, ভারতীয় সেনার সাহায্য ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জেতা সম্ভব হত না। ও দেশে আর থাকা যাবে না বুঝে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় এ পারে চলে এলাম। সঙ্গে মার্ফি রেডিয়ো। তখন রেডিয়োর আওয়াজ জোরে দিয়েই শোনা হত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান, আর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেগকম্পিত কণ্ঠে সংবাদ পাঠ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, আকাশবাণীতেই খবর পেলাম পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল।

শিখা সেনগুপ্ত , কলকাতা-৫১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Suchitra Mitra Kanika Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE