Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Bankruptcy Bill

সম্পাদক সমীপেষু: ব্যাঙ্কের সঙ্কট

অতীতে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের উদ্যোগ করা হয়েছিল কর্মসংস্থান, পরিকাঠামো উন্নয়ন, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের লক্ষ্যে।

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২১ ০৪:৫০
Share: Save:

শুভনীল চৌধুরীর ‘কিছুতেই হিসেব মেলে না’ (২৬-৭) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মূল সমস্যা হল অনাদায়ি ঋণ। কেন্দ্রীয় সরকারের দেউলিয়া সংক্রান্ত আইন ২০১৬ সালে শুরুর পর যে টাকা উদ্ধার হয়েছে, তা অনাদায়ি ঋণের ১৪ ভাগের এক ভাগমাত্র। অনেক সময় দেখা যায়, যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আগে অনাদায়ি ঋণের নজির রেখেছে, তাঁকেও ফের ঋণ দিতে ব্যাঙ্ক বাধ্য হয়েছে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে। মোদী সরকারের দেউলিয়া আইন ব্যাঙ্কের ঋণ সমস্যা মেটাতে পারেনি। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় সরকার এই অনাদায়ি ঋণের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে তুলে দিতে চাইছে কর্পোরেটদের হাতে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করলেই কি সব সমস্যা মিটে যাবে? পিএমসি ব্যাঙ্ক, ইয়েস ব্যাঙ্ক, তার পর লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক— নরেন্দ্র মোদীর জমানায় একের পর এক বেসরকারি ব্যাঙ্ক লালবাতি জ্বেলেছে। ১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ২৮টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়েছে, যেগুলির দায়িত্ব নিতে হয়েছে কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে, দেশে যদি কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক না থাকে, তা হলে কোনও বেসরকারি ব্যাঙ্ক লালবাতি জ্বাললে দায়িত্ব কে নেবে? মানুষের জমানো টাকাই বা কী ভাবে সুরক্ষিত থাকবে? শুভনীল চৌধুরীর বক্তব্য সঠিক, “বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেচে দিলে এই সমস্যা মিটবে না, বরং নতুন সমস্যার জন্ম নেবে।”

অতীতে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের উদ্যোগ করা হয়েছিল কর্মসংস্থান, পরিকাঠামো উন্নয়ন, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের লক্ষ্যে। অর্থাৎ, ব্যাঙ্ককে একটা সামাজিক উন্নয়নের ভূমিকায় ব্যবহার করাই এর উদ্দেশ্য। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আর কোনও প্রয়োজন নেই। সত্যিই কি তা-ই? রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর বিমল জালান বলেছিলেন, যখন দরকার কৃষি ঋণ বাড়ানো, গ্রামীণ ব্যাঙ্কের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চরিত্র নষ্ট করা উচিত নয়। কিছু দিন আগে একটি নিবন্ধে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন ও প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য সতর্ক করেছেন, বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতি দিলে ভারতের আর্থিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে। তাঁদের আশঙ্কা, যে সব সংস্থার ঘাড়ে বিপুল ঋণের বোঝা এবং ভাল রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তারাই বেশি করে লাইসেন্স পেতে ঝাঁপাবে।

রবীন রায়, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

কার স্বার্থে?

শুভনীল চৌধুরীর বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক এবং যথার্থ। বেসরকারি ব্যাঙ্কের অনিশ্চয়তার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী ব্যাঙ্কগুলির জাতীয়করণ করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদী সরকার পুনরায় ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি বেসরকারি ব্যাঙ্কের তুলনায় নির্ভরযোগ্য, এ কথা কমবেশি সকলের জানা। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অবস্থা আজ এত খারাপ কেন? এর জন্য দায়ী সরকারের ভুল নীতি। পছন্দের লোকেদের কম সুদে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে চাপ দেওয়া হয়, এবং তারা ঋণ শোধ করতে না পারলে ব্যাঙ্কের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি দুর্বল হয়ে পড়ছে। রঘুরাম রাজন যখন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ছিলেন, তখন ঋণখেলাপি এই সব ব্যবসাদার বা শিল্পপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। তিনি ঋণখেলাপিদের নামের তালিকা তৈরি করে জনগণকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার বাধা সৃষ্টি করায় তাঁকে পদ ছেড়ে দিতে হয়। এ কেমন সরকার, যারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে শিল্পপতি বা ঋণখেলাপিদের স্বার্থ বেশি দেখছে?

অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ

শিল্পের স্বপ্ন

ঋণখেলাপি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শুভনীল চৌধুরী উদাহরণ হিসেবে ভিডিয়োকনের কথা বলেছেন। ওই সংস্থা ৬৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে প্রায় ২৫ বছর ভোগ করার পর শোধ করল মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা। কারণ হিসেবে (লেখকের কথায়) রঘুরাম রাজন-সহ একাধিক অর্থনীতিবিদ বললেন, ওঁরা প্রকল্পের ঝুঁকি বুঝতে পারেননি। অর্থাৎ, ওঁরা না বুঝেই শিল্প গড়ে তুলেছেন। তাজ্জব ব্যাপার, না বুঝে হাজার হাজার কোটি টাকা ওঁরা ঋণ নিয়ে ফেলেছিলেন! মনে রাখতে হবে, ঋণের সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র বিশেষজ্ঞরা একে একে পর্যালোচনা করেছিলেন। হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে পুরে শেষে কিনা ব্যাখ্যা হল, আমি জানতাম না! সাধারণ মানুষের গচ্ছিত এত টাকা ধ্বংস হল কিনা ভুল করে!

সেই দিনগুলোতে উদারনীতির পথ ধরে শুরু হয় বিশাল আর্থিক বিকাশের রঙিন ফানুস ওড়ানো। কতকগুলো শিল্পকে ‘রত্ন’ মর্যাদা দেওয়া হয়। এক দিকে অর্থনীতির লোকজন বলতে লাগলেন, আরও পুঁজি লাগাও। ব্যাঙ্ক শুধু টাকার জোগান দিয়ে যাক। অন্য দিকে, বুদবুদ ২০০৮ সালেই মিলিয়ে যেতে লাগল। একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান হতে লাগল রুগ্ণ থেকে রুগ্ণতর। বার্ন স্ট্যান্ডার্ড থেকে এয়ার ইন্ডিয়া, কেউ বাদ গেল না। সে কথা গোপন রাখা হল। কিছু সংস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা হল। কিন্তু রোগের চিকিৎসা হল না, বাঁচবে কী ভাবে?

এখন আবার আনকোরা নতুন উদ্ভাবনী এসেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর বেসরকারিকরণ করতে হবে। যে সব শিল্পপতি হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শেষে শিল্পকে দেউলিয়া করলেন, আজ তাঁরা এবং তাঁদের সহযোগীরাই এই সব ব্যাঙ্ক কিনতে উৎসুক। জনসাধারণের টাকা যথেচ্ছ ভোগের পথ একেবারে মসৃণ।

বিমল জানা, বেলদা, পশ্চিম মেদিনীপুর

সহজ আদায়

ঋণখেলাপি প্রসঙ্গে শুভনীল চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, ‘কিছুতেই হিসেব মেলে না’। প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মী হিসেবে কিছু সংযোজন করতে চাই। ব্যাঙ্কগুলোর অনাদায়ি ঋণ কার্পেটের তলাতেই চাপা ছিল। রঘুরাম রাজনের নির্দেশেই প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পেতে থাকে। ব্যাঙ্ককর্মীরাও সরকারকে চাপ দিতে থাকেন যাতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপকারীদের নাম ও ঋণের পরিমাণ জনগণ জানতে পারেন। এ দেশের আইনের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা ঋণের টাকা বেআইনি ভাবে অন্যত্র খাটিয়ে যথেষ্ট সুদ বা মুনাফা লাভ করেন। পরে আদালতের রায়ে কিছু ফেরত দিতে বাধ্য হলেও তার পরিমাণ প্রায়শই ব্যাঙ্কের প্রাপ্য অর্থের তুলনায় অনেক কম হয়। ২০১৬-র দেউলিয়া আইনের পরও এ চিত্র বদলায়নি। ঋণ আদায়ের পদ্ধতি অনেক বেশি সরল ও দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। এক জন জেলাশাসক রাজস্ব আদায়ের জন্য বিশেষ ক্ষমতাবান। ঋণ আদায়ের জন্য তেমন ক্ষমতা থাকা উচিত এক জন ব্রাঞ্চ ম্যানেজারেরও। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ করলে যেমন নষ্ট হবে মিশ্র অর্থব্যবস্থা, তেমনই বিদায় নেবে সমাজকল্যাণের রাষ্ট্রীয় ধর্ম।

গোবিন্দ চন্দ্র বিশ্বাস, কলকাতা-১২৬

টাকা আছে?

প্রায় সকল সরকারি ব্যাঙ্কেই দীর্ঘ দিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে পাসবুক আপডেট করার ব্যাপারে চূড়ান্ত অনীহা। লোক নেই বা মেশিন খারাপ, এই দুইয়ের যে কোনও একটি এদের অজুহাত। নিম্নবিত্ত অজস্র মানুষের ভরসাস্থল এই সরকারি ব্যাঙ্কগুলি, যে মানুষদের অধিকাংশই আবার নেটব্যাঙ্কিং-এ অভ্যস্ত নন। টাকা তুলতে যাওয়ার আগে তাঁদের প্রতিনিয়ত ভাবতে হয়, টাকা আছে কি না, বা কত আছে। ব্যাঙ্কের সংগঠন তো শুনেছি যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা কি এ বিষয়ে কোনও নৈতিক দায় অনুভব করে না? আমাদের সত্যিই প্রতিনিয়ত ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে।

অজয় চৌধুরী, কলকাতা-১৩৫

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nationalised banks Unpaid Loans Bankruptcy Bill
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE