Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Education

সম্পাদক সমীপেষু: আলোও রয়েছে

বহু কাল ধরে সরকারি স্কুলের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এবং অর্থবানরা ছেলেমেয়েদের চড়া টাকা দিয়ে বেসরকারি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করেছে।

student.

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৪:৪৭
Share: Save:

সুকান্ত চৌধুরীর ‘শিক্ষা অন্তর্ধান রহস্য’ (২২-১১) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, শুধু আমাদের রাজ্যেই নয়, আরও অনেক রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থার টালমাটাল অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ অজস্র! সত্তরের দশকের শেষার্ধে সবার জন্য শিক্ষা এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি দেশের সমস্ত রাজ্যে রূপায়িত হওয়া শুরু হয়। সকলেই মেনে নেন যে, নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রথম সোপান হল ৫-৯ বছর বয়সের শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসা। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শিশু-কিশোরদের স্কুলে নিয়ে আসা খুব সহজসাধ্য ছিল না।

তবে কেন্দ্র ও রাজ্যের এবং কিছু কাল ইউনিসেফ-এর যৌথ প্রচেষ্টায় সর্বশিক্ষা অভিযান অত্যন্ত সফল ভাবে রূপায়িত হয়েছিল। স্কুলছুটদের জন্য সেতু পাঠক্রম বা ব্রিজ কোর্স, মিড-ডে মিল প্রকল্প, প্রশাসনিক পরিকাঠামো এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সমন্বিত উদ্যোগে স্কুলশিক্ষা অগ্রাধিকার পেয়েছিল। স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছিল, স্কুলগুলিতে ছাত্রসংখ্যার হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষকদের বণ্টন হয়েছিল। এ রাজ্যে স্কুলের অপ্রতুলতার জন্য শিশু শিক্ষাকেন্দ্র, মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনও হয়েছিল। গোলমাল বাধল শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশে, এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের পদে পদে মতবিরোধে।

বহু কাল ধরে সরকারি স্কুলের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এবং অর্থবানরা ছেলেমেয়েদের চড়া টাকা দিয়ে বেসরকারি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করেছে। অথচ, সরকারি স্কুল, বিশেষত জেলা স্কুলগুলি থেকে অনেক মেধাবী ছাত্র কর্মজীবনে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। ইদানীং শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতির যে খবর পাওয়া যাচ্ছে সেগুলি অবশ্যই নিন্দনীয়, কিন্তু তা দিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে কালিমালিপ্ত করা বোধ হয় যুক্তিযুক্ত নয়।

সুবীর ভদ্র, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

গলদ নীতিতে

‘শিক্ষা অন্তর্ধান রহস্য’ প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে, কেন্দ্র-রাজ্যের শত বিরোধ সত্ত্বেও তারা শিক্ষা ধ্বংসে সমান সক্রিয়। এই বক্তব্যকে সমর্থন করে আরও বলতে চাই, এই ধ্বংসের বীজ বপন হয়েছিল আশির দশকের পরে, তৎকালীন কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ-সহ কিছু রাজ্য সরকারের উদ্যোগে। বর্তমানে কেন্দ্র (বিজেপি) এবং রাজ্যের (তৃণমূল কংগ্রেস) সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্র (কংগ্রেস) এবং রাজ্য (সিপিএম) সরকার শিক্ষা ধ্বংসের বিষয়ে একই জায়গায় অবস্থান করছে।

বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শিক্ষানীতিতে শিশুকে তিন থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত ‘ফাউন্ডেশনাল স্টেজ’-এ পড়াতে বলেছে। ক্লাস ওয়ানের আগে শিশুকে তিন বছর অঙ্গনওয়াড়িতে পড়াতে হবে, এবং তার সঙ্গে এখনকার ক্লাস ওয়ান এবং ক্লাস টু মিলিয়ে মোট পাঁচ বছর হল ফাউন্ডেশনাল স্টেজ। এই অঙ্গনওয়াড়ির পরিকাঠামো কী রকম, আমরা জানি। উপযুক্ত বিল্ডিং, শিক্ষক নেই, জলের ব্যবস্থা, শৌচাগার নেই। তার উপর যদি প্রাইমারির শিশুরা অঙ্গনওয়াড়িতে ভিড় করে, সেই পরিবেশ কেমন হবে? ঘরের বাইরে কর্মরত শ্রমিক পরিবারের তিন বছরের শিশুকে কে স্কুলে নিয়ে যাবে? অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে প্রাক্-প্রাথমিক পাঠদানের জন্য যত শিক্ষকের পদ প্রয়োজন, তা পূরণ হবে কি না, এবং সেই শিক্ষকদের খরচ কে বহন করবে, অঙ্গনওয়াড়ির জন্য নতুন করে বিল্ডিং তৈরি হবে কি না, এর কোনও কিছুই শিক্ষানীতিতে বলা নেই। অথচ, এটাই হল একটা শিশুর ভিত গড়ার গুরুত্বপূর্ণ সময়।

আশির দশকে এ ভাবেই প্রথমে পরিকাঠামো গড়ে না তুলে প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হল। দুটো বা একটি রুমে চারটে ক্লাস, দু’-এক জন শিক্ষক, অথচ বিদেশের অনুকরণে মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু হল। না পড়েই পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে ছাত্ররা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের দায়িত্ব পড়ে গেল ক্লাস ফাইভের ছাত্রদের নাম লিখতে, সাধারণ যোগ বিয়োগ করতে, সাধারণ বাক্য তৈরি করতে শেখানো। একুশ শতকের প্রথমে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষায় প্রথম সারি থেকে চলে এল শেষের দিকে। অভিভাবকরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকলেন। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল এবং অন্যান্য বেসরকারি স্কুল গড়ে উঠতে লাগল। এখন তো ক্লাস এইট অবধি পাশ-ফেল উঠে গিয়েছে।

কেরল, রাজস্থান, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্য এই জাতীয় শিক্ষানীতিকে সরাসরি মেনে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো কিছু রাজ্য বিরোধিতার ভান করেও জাতীয় শিক্ষানীতির বিভিন্ন দিক সুকৌশলে চালু করছে। কিছু দিন আগে আমাদের রাজ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের যে সংঘাত দেখা দিয়েছিল, সেটা কেন্দ্র বা রাজ্য শিক্ষানীতির সংঘাত নয়, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খবরদারি কে করতে পারবে, এই নিয়েই ছিল তাদের সংঘাত। এই সংঘাতের সঙ্গে ছাত্রস্বার্থের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন কংগ্রেস পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া তৈরি করেছিল। মনমোহন সিংহের উদারীকরণ এবং বেসরকারিকরণের নীতি যে ধনীর স্বার্থই রক্ষা করছে, বর্তমানে জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মোদী সরকারের শিক্ষানীতি (২০২০) রাজীব গান্ধীর শিক্ষানীতিরই (১৯৮৬) কিছু পরিবর্তিত রূপ।

কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির আদলে এই রাজ্যেও চালু হচ্ছে অনলাইন শিক্ষা, নো ডিটেনশন পলিসি, অস্থায়ী শিক্ষকের আধিক্য, প্রশাসনিক কর্তাদের দ্বারা শিক্ষা পরিচালনা, চার বছরের ডিগ্রি কোর্স, স্কুল স্তরেই সিমেস্টার প্রথা, প্রাক্-প্রাথমিককে প্রাথমিকে যুক্ত করা, ত্রিভাষা নীতি ইত্যাদি। জাতীয় শিক্ষানীতির পরোক্ষ ভয়ঙ্কর দিক হল, নতুন নিয়োগ নয়, নিয়োগ হলেও অতিথি শিক্ষক-আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়ে স্কুল-কলেজ চালানো। রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেও অনেকটা এই নিয়মেই চলছে।

নিখিল কবিরাজ, কল্যাণী, নদিয়া

মাটির মা

“এলাম ‘নতুন দেশে’” (২১-১১) শীর্ষক শিবাজীপ্রতিম বসুর প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “ ...আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনাদের পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্রে, এর স্নেহশালিনী নদীগুলির ধারে, এর সুখ-দুঃখ-ময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই-সমস্ত দরিদ্র মর্তহৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে ক’রে এনে দিয়েছে। আমরা হতভাগ্যরা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, ...আমি ভালোবাসি, কিন্তু রক্ষা করতে পারি নে। ...জন্ম দিই, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারি নে।”

কবির এই হতাশা একুশ শতকেও কুরে কুরে খায়। আড়াআড়ি ভাবে ভাগ হয়ে যাওয়া বিশ্বে সংখ্যালঘু-বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে। এরই হাত ধরে এক সময়ের উদার ভারতে আজ কট্টরপন্থী সংখ্যাগুরু মানুষ ‘জাতির অস্তিত্ব রক্ষা’ করতে অস্থির। ৬ ডিসেম্বরের কালো অধ্যায়টির নানা চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণে পাঁচ বিচারকের ডিভিশন বেঞ্চ রামমন্দির নির্মাণের পক্ষেই সিলমোহর দিয়েছিল। মন্দির নির্মাণ ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। আর বর্তমান ভারত হিন্দু রাষ্ট্রের ঘোষণা থেকে মাত্র হাতকয়েক দূরে অবস্থান করছে। তবুও সম্যক রূপে নিজেদের হিন্দুত্ববাদী ঘোষণা, এবং ‘ইন্ডিয়া’ নামক ছদ্ম-সেকুলার জোটের হাত ধরে নরম হিন্দুত্বের রাজনৈতিক ভাষ্য, দুটোই ভারতকে ধর্মান্ধতার কানাগলিতে নিয়ে এসে ফেলেছে।

‘ওদের রামমন্দির আছে তো আমাদেরও আছে তারকেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর’— এমন কথাও চরম হিন্দুত্ববাদকে প্রতিহত করার পরিবর্তে আরও তার কাছেই আত্মসমর্পণ করে। তাই দেশের সবটুকু জুড়েই বর্তমান সময়ে ধর্ম, জাতপাতের আবেগই সক্রিয়।

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Society West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE