কলকাতার ট্রাম। ফাইল চিত্র।
কলকাতার কড়চা-য় প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার ট্রাম নিয়ে একটি প্রতিবেদন ‘পথে, না কি মিউজ়িয়মে’ (১৮-২)। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে কলকাতায় প্রথম ট্রাম চলেছিল। সে ট্রাম অবশ্য ছিল ঘোড়ায় টানা। এই হিসাবে এই বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ট্রাম দেড়শো বছরের গৌরবান্বিত ইতিহাস ছুঁয়ে ফেলল। এই সার্ধশতবর্ষে এসে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানে এই শহরের রাস্তায় মাত্র দু’-তিনটে রুটে ট্রাম চলছে। ‘হেরিটেজ রুট’ অভিধায় ভূষিত এসপ্ল্যানেড-খিদিরপুর রুটে ২০২০ সালের ২০ মে আমপানের সময় থেকে আজ পর্যন্ত ট্রাম চলাচল বন্ধ আছে। এই রুটে আবার ট্রাম কবে চলবে?
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যাচ্ছে যে, ভবিষ্যতে কলকাতার রাস্তায় মেরেকেটে মাত্র চারটি রুটে ট্রাম চলতে পারে। আর বাকি ট্রামলাইন পিচ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। কলকাতার রাস্তায় যানজটের জন্য নাকি একমাত্র ট্রামই দায়ী। এখন তো হাতেগোনা রুট ছাড়া কলকাতায় কোথাও ট্রাম চলছে না। এখনও তা হলে এই শহরের রাস্তায় কেন যানজট হচ্ছে? কলকাতা তো এত দিনে যানজটমুক্ত শহরে পরিণত হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, ট্রাম না চললেও কলকাতার রাস্তায় যানজট হবেই।
কলকাতা শহরে বায়ুদূষণ আজ এক ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতিতে এমন গণপরিবহণের দরকার, যার থেকে কোনও ভাবেই বায়ুদূষণ হওয়া অসম্ভব। এই দিক থেকে ট্রাম এক এবং অদ্বিতীয়। ট্রাম একটি পরিবেশবান্ধব যান। ট্রাম কখনও বায়ুদূষণ করে না। এই শহরের রাস্তায় যত বেশি রুটে ট্রাম চলবে, ততই বায়ুদূষণ কম হবে। শহরবাসী দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। এই দিকটা বিবেচনা না করেই শহরের রাস্তা থেকে ট্রাম প্রায় তুলেই দেওয়া হল। এই পরিস্থিতিতে ট্রামের দেড়শো বছরও পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। কলকাতা আর ট্রামের শহর নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে যখন দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ট্রামকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বা হচ্ছে, তখন আমরা ট্রামের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছি।
বিকাশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাকড়দহ, হাওড়া
ঐতিহ্য বাঁচুক
‘দেড়শো ছোঁয়ার মুখেই কি বাজল ট্রামের বিদায়ঘণ্টা’ (১১-২) শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। এই কলকাতা শহর আমাদের কাছে হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ-ভালবাসার শহর। এই শহরের পরতে পরতে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, আছেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ। আছে কলেজ স্ট্রিট, ঠনঠনিয়া, বড়বাজার, শ্যামবাজার আর ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে দিয়ে ময়দানের সবুজ ঘাসের মাঠের পাশ দিয়ে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ছুটে চলে আমাদের অনেক স্মৃতি জড়ানো ট্রাম। কলকাতায় ট্রামের যাত্রা শুরুর একেবারে প্রথমে ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। ঘোড়ায় টানা প্রথম ট্রামের পথচলা বন্ধ হয়ে যায় কিছু দিন পরেই। পরবর্তী কালে লর্ড কার্জন স্বল্প ব্যয়ে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে যাওয়ার জন্য সকল মানুষের সুবিধার কথা চিন্তা করে পুনরায় ট্রাম চালু করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কলকাতাকে তার ঐতিহ্য ট্রাম ছাড়া কল্পনা করা কঠিন। ট্রাম সম্পূর্ণ উঠে গেলে শহর কলকাতা যেমন তার কৌলীন্য হারাবে, তেমনই আমরা হারাব আমাদের আবেগ, হারাব এক দূষণমুক্ত পরিবহণ ব্যবস্থা।
দ্রুত গতির যুগে এই ধীর গতির ট্রামের বিপক্ষে অনেকেই মত প্রকাশ করে থাকেন। অনেকে বলেন, ট্রামের জন্যই শহরে এত যানজট হয়। কিন্তু কোনও তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি না করে প্রশাসনের কাছে ট্রামকে বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ করি। ট্রামকে একেবারে বন্ধ না করে, বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে কী ভাবে তাকে স্বমহিমায় বাঁচিয়ে রাখা যায়, তার চিন্তাভাবনা করার অনুরোধ জানাই। আগামী প্রজন্ম যেন বলতে পারে ট্রাম ছিল, ট্রাম আছে, আর ট্রাম থাকবে।
তমাল মুখোপাধ্যায়, ডানকুনি, হুগলি
আরও রুট
১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় দেশের প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রামের সূচনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত-সহ সমগ্র এশিয়ায় এক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হিসেবে এই বছর আমরা ট্রামযাত্রার সার্ধশতবার্ষিকী পালন করছি। প্রথম ট্রামটি শিয়ালদহ থেকে যাত্রা শুরু করে প্রায় ৩.৯ কিলোমিটার (২.৪ মাইল) দূরত্ব অতিক্রম করে আর্মেনিয়ান ঘাটে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ঠিক তার পরের বছর ১৮৭৪ সালে বম্বে, এর পর ধীরে ধীরে নাশিক, চেন্নাই, দিল্লি-সহ বেশ কিছু শহরে ট্রামের সূচনা হলেও বর্তমানে দেশের মধ্যে কেবলমাত্র কলকাতাতেই ট্রাম সচল আছে, যা সত্যিই বিস্ময়কর।
এমনকি ১৯০২ সালে প্রথম বিদ্যুৎচালিত ট্রামের যাত্রাও শুরু হয়েছিল আমাদের এই প্রিয় শহরের এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত। ভাবতেও অবাক লাগে যে, ভারতের বর্তমান প্রজন্ম জানেই না, এক সময় এই দেশেরই বিভিন্ন শহরে ট্রাম চলত। তাদের না-জানার কারণ, ওই সমস্ত শহরে ট্রাম ১৯৬৪ সালের পূর্বেই পথ চলা বন্ধ করেছিল। একটা সময় এই যান ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় গণপরিবহণ ব্যবস্থা। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে যখন আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি বর্জন করে বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের উপর জোর দিচ্ছি। তখন ট্রাম পরিবেশবান্ধব ও সুলভ গণপরিবহণ হওয়া সত্ত্বেও যে ভারতের একটি মাত্র শহরেই সীমাবদ্ধ, তা দুঃখের। তা ছাড়া কলকাতাতেও বর্তমানে মাত্র দু’টি রুটে গুটিকয়েক ট্রাম চালু আছে, এবং সেটাও আর কত দিন থাকবে সে নিয়ে সংশয় আছে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, এই পরিবেশবান্ধব যানটির রুট বাড়ানো হোক। নয়তো অচিরেই দেশ থেকে সুমধুর স্মৃতি-সহ এক ইতিহাস ও ঐতিহ্য চিরতরে হারিয়ে যাবে।
সৌরভ মালিক, চন্দনদহ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
গতির চাহিদা
কলকাতা ট্রামের সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতির সংবাদ ভাল লাগল (সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপনের কার্নিভালে ট্রাম প্যারেডও, ২৪-২)। রাজ্য সরকারও উৎসবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু এর বিচরণক্ষেত্র বাড়ানো দূরে থাক, তা ক্রমশ উঠে যাওয়ার পথে। কারণ, জনবহুল রাস্তায় ট্র্যাকের অপরিবর্তনযোগ্যতার কারণে গত শতাব্দীর শেষ থেকেই পরিবেশবান্ধব ট্রামের বিদায়ঘণ্টা বেজেই চলেছে। দিন যত যাচ্ছে, যাত্রিসংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে গতির চাহিদা। আবার গতির সঙ্গে বেড়েছে দূষণের পরিমাণ। তাই পরিবেশবান্ধব যান হিসেবে অবধারিত ভাবে বার বার উঠে আসে ট্রামের কথা। তবে কলকাতার মতো শহরে এর গতিমন্থরতার কারণে অন্যান্য যানের চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো, এমন সীমাবদ্ধতা কোনও মতেই খাটো করে দেখা যায় না। আবেগ বাস্তবকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। বাস্তব কারণেই এক দিন ট্রামের সামনে থেকে ঘোড়া খুলে বিদ্যুৎ সংযোগ করা হয়েছিল। তাই গণপরিবহণে ট্রামকে টিকিয়ে রাখতে গেলে এর গ্রহণযোগ্যতার পরিসর খুঁজে বার করতেই হবে। অতিরিক্ত ভিড় সামলাতে কলকাতা শহর পেয়েছে মেট্রো, অটো, আরও বেশি সংখ্যায় বাস। অথচ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে ট্রেন পরিষেবা বাড়েনি। ট্রেন লাইনের বিকল্প হিসেবে কোনও ভাবে ট্রামের কথা ভাবা যায় না? লাইন ফাঁকা পেলে অত্যন্ত দ্রুত বেগে ছুটতে পারে ট্রাম। শহর তো বটেই, সরকারি এবং অসরকারি যৌথ উদ্যোগে, শহরতলিতেও ট্রাম পরিষেবা প্রসারণের চিন্তা কি একেবারেই অবাস্তব? তেমন প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও কলকাতায় প্রায় জোর করে চালানোর চেয়ে যেখানে এর যথেষ্ট উপযোগিতা বর্তমান, সেখানে ট্রাম চালানোর কথা ভেবে দেখতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy