Advertisement
০২ মে ২০২৪
People's Representatives

সম্পাদক সমীপেষু: বিদ্যা চাই, বুদ্ধিও

মাথা গোনার গণতন্ত্র বলেই ভোটযুদ্ধে রক্ত ঝরে দেদার। নিয়োজিত হয় অর্থ, পেশি ও অন্যান্য প্রভাব। এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্য মেলায় কেনা ‘ঘাড় নড়বড়ে বুড়ো’ গড়ে তোলা।

An image of leader

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:২৯
Share: Save:

সোনালী দত্তের ‘আর দেশ চালানোর শিক্ষা?’ (২৮-৮) প্রবন্ধটির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আরও দু’-একটি কথা। প্রবন্ধে উল্লিখিত ‘গণতন্ত্র মাথা গোনে, মগজ নয়’ এই বাক্যের অভিঘাত যে একটি জাতিকে কোন তিমিরে নিমজ্জিত করতে পারে, তার সেরা উদাহরণ বোধ হয় আমাদের দেশ। মাথা গোনার গণতন্ত্র বলেই ভোটযুদ্ধে রক্ত ঝরে দেদার। নিয়োজিত হয় অর্থ, পেশি ও অন্যান্য প্রভাব। এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্য মেলায় কেনা ‘ঘাড় নড়বড়ে বুড়ো’ গড়ে তোলা। সেই প্রত্যাশিত সুরের সঙ্গে না মেলাতে পারায় কাউকে বরখাস্তও হতে হয়েছে, কারণ তিনি বিদ্যা এবং বুদ্ধিকে দেশের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠার পক্ষে কথা বলেছেন। তার জন্য সত্যিকারের শিক্ষা আবশ্যক। শুধু ডিগ্রি লাভের জানা নয়, চাই বোধ। জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠতে গেলে এক জন উচ্চ-প্রশাসনিক কর্মচারীর থেকে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে উঠতে হবে। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের পরীক্ষায় প্রতিযোগীর নিজের পছন্দমতো বিষয়ে যোগ্যতামান পেরোলেই উত্তীর্ণ হওয়া যায়। কিন্তু জনপ্রতিনিধিকে বিশ্বের সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান না থাকলেও নেওয়ার মতো আধার থাকতেই হবে। আর চাই সুস্থ রুচিবোধ। নীতিবোধ। তা না হলেই ভোটে কারচুপি হবে। জেতার পর ভোটদাতাদের কাঁচকলা দেখিয়ে ক্যাম্প বদলাবেন নির্বাচিত প্রতিনিধি। এগুলির বিষয়ে অন্যায্যতার ‘বোধ’ কিন্তু কোনও স্কুল-কলেজে পাওয়া যাবে না। অতএব, হবু জনপ্রতিনিধির যোগ্যতামান বিষয়ে শুধু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট দেখে নিলেই চলবে না। সর্বাগ্রে নিতে হবে প্রার্থীর নীতিবোধ, আদর্শ ও প্রজ্ঞার পরীক্ষা।

প্রবন্ধকার বিষয়টি ছুঁয়ে গিয়েছেন। আইনসভায় যাঁরা প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন, তাঁদের জন্য বিশেষ ক্লাসের কথা ভেবেছেন তিনি। এখানে বলি, ক্লাসের বন্দোবস্ত হোক নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার আগে। জ্ঞান, বোধ এবং স্থিরচিত্তের যোগ্যতামান পেরোনো, তার পর মনোনয়নপত্র দাখিল।

বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি

বিশিষ্ট বিজ্ঞানী

১০ সেপ্টেম্বর, মুর্শিদাবাদ সম্মিলনীর উদ্যোগে সদ্যপ্রয়াত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বিকাশচন্দ্র সিংহ স্মরণে এবং শ্রদ্ধায় একটি বিজ্ঞান আলোচনা চক্র অনুষ্ঠিত হয় গভর্নমেন্ট কলেজ অব এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেক্সটাইল টেকনোলজি, বহরমপুরের প্রেক্ষাগৃহে। উপস্থিত ছিলেন জিয়াগঞ্জ, আজিমগঞ্জ, কান্দি, বহরমপুর এবং মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞান অনুরাগীরা।

মুর্শিদাবাদ সম্মিলনীর প্রতিষ্ঠাতাদের এক জন সমর নাগ মহাশয় বলেন, বিজ্ঞানী বিকাশচন্দ্র সিংহ বলতেন যে “বিজ্ঞানে বিনিয়োগ হল যুবক সম্প্রদায়ের উপর বিনিয়োগ এবং যুবক সম্প্রদায়ের উপর বিনিয়োগ হল দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে বিনিয়োগ।” প্রয়াত বিজ্ঞানী বিকাশচন্দ্রের এই বিজ্ঞানে বিনিয়োগের সূত্রই হয়তো আমাদের জি২০-র “এক পৃথিবী, এক পরিবার ও এক ভবিষ্যৎ”-এর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবে। তিনি বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মেলবন্ধনের কথা বলতেন এবং বিজ্ঞান ও সাহিত্য সৃষ্টির উল্লাসকে ব্যক্ত করে গিয়েছেন তাঁর লেখা সৃষ্টি ও কৃষ্টি— বন্ধনহীন গ্রন্থি এবং স্থান, কাল এবং বিশ্বলোক— এই দু’টি বইয়ের মাধ্যমে। তবে সমাজসেবী সমর নাগের মতে, মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা গড়ে তুলতে এই দু’টি বইয়ের মধ্যে দিয়ে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁর বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রচারের কাজটি সহজ এবং নিপুণ ভাবে করে গিয়েছেন।

প্রাক্তন অধ্যাপক মৃণাল চক্রবর্তী বিকাশ সিংহ প্রসঙ্গে বলেন যে, তিনি ছিলেন বড় মনের মানুষ। মুর্শিদাবাদ সম্মিলনীর কোনও একটি সমিতির প্রধান নির্বাচনের সময় বাকি সদস্যরা তাঁর নাম প্রস্তাব করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ওই একই সমিতিতে উপস্থিত দাদা অতীশচন্দ্র সিংহের পক্ষে সওয়াল করেন। শেষ পর্যন্ত একাধারে শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ দাদা অতীশচন্দ্র সিংহের নামই ওই সমিতির প্রধান হিসাবে গৃহীত হয়। তিনি বলেন, পাইকপাড়ার রাজ পরিবারের শিক্ষাদীক্ষা অনুসারে, যেখানে একই সঙ্গে দাদা-ভাই দু’জনেই উপস্থিত, সেখানে দাদাকে ব্যতিরেকে ভাই কোনও পদ অলঙ্কৃত করবে না। বিকাশচন্দ্র বড় মাপের বিজ্ঞানী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেও পরিবারের ঐতিহ্যকে ভুলে যাননি এবং তাঁর জন্মস্থান কান্দি, মুর্শিদাবাদের সঙ্গেও শিকড়ের সম্পর্ক স্থাপন করে রেখেছিলেন।

আলোচনার মধ্যগগনে উঠে আসে যে, বিকাশচন্দ্র এক জন বড় রবীন্দ্র-অনুরাগী ছিলেন এবং তিনি যতটা বিজ্ঞানী, ততটাই সাহিত্য অনুরাগীও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞান চেতনার কথা বলতে গিয়ে তিনি উদ্ধৃত করতেন রবি ঠাকুরের লেখা কবিতার সেই বিখ্যাত পঙ্‌ক্তি, “বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া” এবং “নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু”। তিনি বলতেন, মহাকাশ বিজ্ঞানীরা কল্পনার আকাশে ভর করেই চলেন। ছাত্রদের সহজ মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শেখানোর জন্য রবি ঠাকুরের বিশ্ব পরিচয় বইটিকে স্কুলপাঠ্য করা উচিত বলে তিনি মনে করতেন।

কলকাতার টেগোর সেন্টার ফর ন্যাচরাল সায়েন্স অ্যান্ড ফিলসফি-র সভাপতি হিসাবে তিনি সাহিত্য ও বিজ্ঞান সৃষ্টির মেলবন্ধনের কাজটি খুব দক্ষতার সঙ্গে করে গিয়েছেন এবং রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানসত্তাকে সাহিত্যের আঙিনায় জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। তিনি প্রমাণ করে গিয়েছেন যে, সৃষ্টির উল্লাসে সাহিত্য ও বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক।

তবে কিশোরবয়সি বিকাশচন্দ্রের বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ গড়ে উঠেছিল বোধ হয় তাঁর ঘরোয়া পরিবেশে কান্দির পাইকপাড়ার রাজবাড়ি থেকে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, কান্দি মহকুমার প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মদনমোহন তর্কালঙ্কার এই পাইকপাড়ার রাজবাড়িতে কাজের সূত্রে গিয়েছেন এবং থেকেছেন বিভিন্ন সময়ে। স্বভাবতই তাঁর মনে এই সকল মনীষীর কাজ ও অভিজ্ঞতা বিস্ময় ও জ্ঞানের উদ্রেক করেছে এবং দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলেছে। এই ঘরোয়া সাহচর্য এবং প্রশিক্ষণই ভবিষ্যতে তাঁকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির জ্ঞানভান্ডারে নিমজ্জিত হতে সাহায্য করেছে।

উল্লেখযোগ্য, কান্দি রাজ উচ্চ বিদ্যালয় উদ্বোধনের সময় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় কান্দির রাজবাড়িতে তিন মাস অবধি ছিলেন ও সেখানকার পঠনপাঠনের দিক নির্দেশ করেছিলেন। অগ্রজ অতীশচন্দ্র সিংহের কাছ থেকেও পদার্থবিদ্যা ও ভূপদার্থবিদ্যার পাঠ তিনি পেয়েছিলেন।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সামসুজ্জামান বিকাশচন্দ্র সিংহের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞের কথা তুলে ধরেন। তাঁর মতে, মেঘনাদ সাহা এবং বি ডি নাগচৌধুরীর পরবর্তী কালে তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে কলকাতার ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ, অতিপরিবাহী (সুপারকন্ডাকটিং) সাইক্লোট্রন ও মেডিক্যাল সাইক্লোট্রন স্থাপনে বিকাশচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। বিজ্ঞানী বিকাশচন্দ্র পরমাণু এবং পারমাণবিক শক্তিকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত করে গিয়েছেন এবং ঠিক এখানেই তিনি অনন্য এক জন মানবিক বিজ্ঞানী। বিকাশচন্দ্র কলকাতা তথা ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক স্তরে ইউরোপের পরমাণু গবেষণা সংস্থা সার্ন-এর গবেষণা ও কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলেন এবং এটি তাঁর কাজের দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতির জন্যই সম্ভবপর হয়েছিল।

অধ্যাপক প্রীতিকুমার রায়চৌধুরী বলেন, ভবিষ্যতে বিভিন্ন বিজ্ঞান আলোচনা-চক্রের মাধ্যমে বিজ্ঞানী বিকাশচন্দ্র সিংহের কাজকে আমাদের সাধারণ মানুষ ও পড়ুয়াদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ ভাবেই তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

তবে, বিজ্ঞানী মহলে তিনি সমাদৃত হয়ে থাকবেন পদার্থের অতি ক্ষুদ্র অন্তিম মৌলিক কণা ‘কোয়ার্ক’ এবং পদার্থের কেন্দ্রক-কণা প্রোটন বা নিউট্রনের আঠালো প্লাজ়মা রসে ব্রাউনীয় গতিতে ঘুরে বেড়ানো ‘কোয়ার্ক’ কণার ‘কোয়ার্ক গ্লুওন প্লাজ়মা’ সম্বন্ধীয় তাঁর কাজের জন্য।

সঞ্জিত কুমার সাহা, সল্ট লেক, কলকাতা-১০৬

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE