Advertisement
২৪ মার্চ ২০২৩
CPM

সম্পাদক সমীপেষু: হাতে রইল ঐতিহ্য?

কৃষক আন্দোলন দেশ জুড়ে খেটে-খাওয়া মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা আর প্রেরণা জুগিয়েছে। শাসক শ্রেণির মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২১ ০৪:৪৪
Share: Save:

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ‘ছক ভাঙার চ্যালেঞ্জ’ (৩১-৫) নিবন্ধে বিকল্প পন্থার হদিস দিয়েছেন। মতপার্থক্য থাকলেও তা উপেক্ষা করা যায় না। বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলন কেবল দাঙ্গা ও দেশভাগের অধ্যায় নয়, শুধু ব্রিটিশ শাসনের অবসানও নয়, সামাজিক বৈষম্য ও উৎপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রামও বটে। এই ইতিহাসই ‘সঙ্ঘ পরিবারের বাঙালি হিন্দুত্বের আখ্যানের দুর্বলতম গ্রন্থি’। এই ইতিহাসকে সামনে এনে শ্রমজীবী মানুষের লড়াইকে সংগঠিত করেই এ রাজ্যে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে রোধ করা সম্ভব, এই হল দীপঙ্করবাবুর অভিমত। এই ভাবনার গুরুত্ব অস্বীকার না করেও বলতে চাই, তাঁর বক্তব্য অনেকটাই শুভ কামনার মতো। যে বাস্তবতা দেশে বামপন্থাকে দুর্বল করেছে, শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করেছে, আর ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মাথা তুলতে সাহায্য করেছে, যার সুযোগে হিন্দুত্ববাদীরা তাঁদের মতাদর্শকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন, তাকে উন্মোচিত না করে লড়াইকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে টেনে আনা চলে কি? বাংলার গৌরবময় মানবতাবাদী ঐতিহ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করা যাবে না, রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকেও তাকে উৎখাত করা যাবে না। যে বাস্তবের ভূমিতে ‘বাংলার উদার ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বহুমুখী বলিষ্ঠ ইতিহাস’ আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে, উগ্র ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের মোকাবিলা করবে, তার সন্ধান দিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে দেশ আজ এটাই চায়।

Advertisement

আজকে কৃষক আন্দোলন দেশ জুড়ে খেটে-খাওয়া মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা আর প্রেরণা জুগিয়েছে। শাসক শ্রেণির মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে। তা সত্ত্বেও ‘ব্যাপক বেসরকারিকরণ, কর্মসঙ্কোচন, মূল্যবৃদ্ধি ও মজুরি হ্রাসের প্রেক্ষাপটে রুটি-রুজির লড়াইয়ের নতুন তাগিদ’ এখনও সে ভাবে দেখা দিচ্ছে না, প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে না আন্দোলন। শ্রেণিসংগ্রাম মাথা তুলছে না, এ রাজ্যেও না। এর সমাধান মতাদর্শ আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লড়াই গড়ে তোলার মধ্যে নেই। যদিও তা বাদ দেওয়া যায় না।

এটা ঠিক, বামপন্থীদের অবিলম্বে নিজেদের মতাদর্শগত দুর্বলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলন, শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টা নিতে হবে। সেটা ছাড়া সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে রাজনীতি আর মতাদর্শের লড়াই গড়ে তোলা যাবে না। কিন্তু কী ভাবে সেই ঐক্যের তাগিদ তাঁদের মধ্যে আসবে, সেটাই আজ প্রশ্ন।

গৌতম চৌধুরী

Advertisement

কালীতলা, মালদহ

চাই ঐক্য

আবির দাশগুপ্তের “‘দলিত কমিউনিস্ট পার্টি’ চাই” (৫-৬) প্রসঙ্গে আমার প্রশ্ন, যে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব সারা দেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, তাকে বামপন্থী দল কি সংগঠন থেকে দূর করতে পারবে? পারবে না বলেই কি পৃথক দলিত কমিউনিস্ট দল তৈরি চিন্তা? নকশালবাড়ি আন্দোলন-উত্তর কালে অনুরাধা গাঁধীর মতো কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্ব যে ভাবে ৩০ বছর ধরে দলিত, আদিবাসী ও শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার তুলনা আছে বলে মনে হয় না। এই কাজে নিজের জীবন বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও তিনি পিছপা হননি, এবং আন্দোলনেই তাঁর জীবন উৎসর্গীকৃত হয়েছে। জ্যোতিবা ফুলে এবং বি আর অম্বেডকরের পর এক নতুন আলোকে তিনি জাতপ্রথার সমস্যাগুলি এবং তার প্রতিকার তুলে ধরেছেন। দলিত আন্দোলন সম্পর্কে অনুরাধা বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ততন্ত্র, এবং বানিয়া বুর্জোয়া শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লবী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করাই জাতপ্রথা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদকে ভারতের মাটি থেকে উৎপাটনের একমাত্র পথ। উৎপাদনের মাধ্যমের উপর অধিকার অর্জন না করে নিপীড়িত মানুষের ক্ষমতা গড়ে উঠবে না। এখানে দলিত আন্দোলনে সমস্ত নিপীড়িত শ্রেণির অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।

‘কাস্ট কোয়েশ্চেন ইন ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধে অনুরাধা জাতপ্রথা নির্মূল করতে যে ২৯টি কর্তব্য নির্ধারণ করেছেন, তার একটি হল— “সাম্যবাদীকে সব জাতের নিপীড়িত মানুষের এক জন হতে হবে, এবং কথায় ও কাজে তাদের পাশে থাকতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভেক-সাম্যবাদীদের মুখোশ খুলে দিতে হবে, যারা মনেপ্রাণে জাতপ্রথায় বিশ্বাসী।” তাই পৃথক ভাবে দলিত বামপন্থী দল সৃষ্টি করে সাম্যবাদী আন্দোলনের কথা ভাবা কল্পনাবিলাস মাত্র।

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়

খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা

ব্রাহ্মণ কমিউনিস্ট

আবির দাশগুপ্ত বলছেন, বামপন্থীদের ‘মহিলা শাখা’, ‘যুব শাখা’, ‘শ্রমিক ইউনিয়ন’ রয়েছে; তা হলে একটা ‘দলিত কমিউনিস্ট পার্টি’ হতে পারে না কেন? ওই সব শাখা বা ইউনিয়ন নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা শ্রেণির সমস্যা নিয়ে কাজ করে। এর সঙ্গে একটা কমিউনিস্ট পার্টির তুলনা চলে? কমিউনিস্ট পার্টির একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। রাজ্য নিয়ে, দেশ নিয়ে, সমগ্র বিশ্ব নিয়ে; এমনকি সৌরজগৎ নিয়েও। বিশ্বের সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টি জোটবদ্ধ হয়ে আওয়াজ তুলতে পারে যে, এই মুহূর্তে মঙ্গলের মাটি এনে গবেষণা করার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি সেই অর্থ দিয়ে দুনিয়ার কয়েকশো কোটি মানুষের দু’বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করা। কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বাধীন একটি পার্টি। শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব বলতে মার্ক্স কী বুঝিয়েছেন— কারখানার শ্রমিকরাই নেতৃত্বে থাকবেন, না অন্য শ্রেণির মানুষ শ্রমিক শ্রেণির আদর্শে প্রাণিত হয়ে নেতৃত্ব দেবেন— এই নিয়ে তর্ক আছে। তবে কমিউনিস্ট পার্টি যে, শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বেই চলবে, তা নিয়ে তর্ক নেই। দলিত কোনও শ্রেণি নয়, একটি সম্প্রদায়। লেখক যদি ‘দলিত পার্টি চাই’ বলতেন, আপত্তি করতাম না। কিন্তু কমিউনিস্ট শব্দটির সঙ্গে দলিতকে মিশিয়ে দেওয়াতেই আপত্তি।

লেখক একটা কথা ঠিক বলেছেন, “দলিতদের ইতিহাসে কমিউনিস্টদের সঙ্গে সহযোগিতার অভিজ্ঞতা রয়েছে, যেখানে কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে বিশ্বাসভঙ্গের স্মৃতিও। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী আন্দোলনে সবর্ণ হিন্দুপ্রধান নেতৃত্বের অতিরিক্ত আত্মতৃপ্তির ফলে দলিতরা বাম মহলেই নিগৃহীত বোধ করেছেন।” আসলে বাংলা, কেরল, ত্রিপুরায় ‘বাম পার্টি’র নেতৃত্বে পাওয়া যাবে বর্ণহিন্দুদের, প্রধানত ব্রাহ্মণদের। এই পার্টির নেতৃত্বে ত্রিপুরার জনজাতিদের অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলেও পাওয়া যাবে না। এই তিনটি রাজ্যের পার্টিগুলো আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী পার্টি, হিন্দুত্ববাদী পার্টি, মনুবাদী পার্টি। এখানে দলিতের স্থান কোথায়? তাই দলিতরা এদের কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কী পেতে পারেন? এমনকি এরা কমিউনিস্টও নয়। আবিরবাবু এদের ‘সাম্যবাদী’, ‘কমিউনিস্ট’ বলে গর্হিত কাজ করেছেন।

সমীর সাহা পোদ্দার

কলকাতা-৪২

বিভাজন নয়

‘দলিত কমিউনিস্ট পার্টি’ তৈরির অদ্ভুত প্রস্তাব পড়ে বিস্মিত হলাম। লেখক হয়তো ভুলে গিয়েছেন কোনও পার্টির শাখা হিসেবে কাজের পরিধি আর পার্টি হিসেবে কাজের পরিধির তারতম্য ব্যাপক। এখানে একটা প্রশ্ন উঠে আসে, কে বা কারা ‘দলিত’? সমস্ত অবদমিত, অবহেলিত পিছিয়ে পড়া গরিব মানুষ? না তফসিলি জাতি ও জনজাতি গোষ্ঠী? যদি ধরে নিই লেখক তফসিলি জাতি-জনজাতির কথাই বলছেন, তা হলে তাঁদের জন্য সংরক্ষণ তাঁদের ঈর্ষার পাত্র করে তুলেছে। আমাদের সমাজে এ ভাবে অনেক বিভাজন হয়েছে, আর নতুন বিভাজন চাই না।

কিছু দিন আগে ‘দলিত সাহিত্য’ নিয়ে বেশ লেখালিখি চলছিল। সাহিত্যের আবার জাতভিত্তিক ভাগাভাগি! কিছু মানুষ ভেদাভেদ ও বিভাজনে সিদ্ধহস্ত। কমিউনিস্টরা নীতিগত ভাবে এই বিভাজন প্রথার বাইরে। লেখক ঘুরিয়ে বিভাজন আনার প্রস্তাব এনেছেন। মায়াবতীর ‘বহুজন সমাজ পার্টি’ উত্তরপ্রদেশে বহু দিন শাসন ক্ষমতায় ছিল। তাতে দলিতের কতখানি উপকার হয়েছে?

সনৎ কুমার কান্ডার

কলকাতা-৭৪

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.