Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Communalism

সম্পাদক সমীপেষু: মৌলবাদ ভয়ঙ্কর

মৌলবাদ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, নৃশংস। এরা ধর্ম মানে না, তা সে ইসলামি মৌলবাদ হোক বা হিন্দু মৌলবাদ।

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২১ ০৪:৩৯
Share: Save:

‘হুঁশিয়ার’ (১৯-১০) সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে জানাই যে, কোনও ধর্মবিশ্বাসী মানুষ অপর ধর্মে বিশ্বাসী মানুষকে আঘাত করতে পারেন না। সম্প্রতি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের কিছু স্থানে ষড়যন্ত্রমূলক ক্রিয়াকলাপকে অজুহাত করে মৌলবাদী শক্তির দ্বারা মন্দির, মূর্তি ভাঙচুর, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর আক্রমণের বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। মৌলবাদ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, নৃশংস। এরা ধর্ম মানে না, তা সে ইসলামি মৌলবাদ হোক বা হিন্দু মৌলবাদ। এদের হাতিয়ার ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, উগ্রতা; এরা মানবতার শত্রু। এরা মানুষের আবেগকে উস্কে দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করে দেশকে রক্তাক্ত করে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা বা দাঙ্গা কেবলমাত্র মানুষের প্রাণ কিংবা সম্পত্তি ধ্বংস করে না; সৌভ্রাতৃত্ববোধ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতির মধ্যেও চিড় ধরায়, সাধারণ মানুষের ঐক্যকে নষ্ট করে, তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং সেই সঙ্গে জ্বলন্ত সমস্যাগুলো থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেয়।

সাম্প্রদায়িকতাকে সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে রোখা যায় না। আশার সোনালি আলো উদ্ভাসিত হয়, যখন দেখি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, ছাত্র-যুব-মহিলা সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িক দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন, ঐক্য ও শান্তির পক্ষে সরব হয়েছেন। রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, লালন ফকিরের ঐতিহ্যবাহী আমাদের রাজ্যেও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষ, বিদ্বজ্জনেরা সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এবং সম্প্রীতি ও ঐক্য রক্ষার আবেদন জানিয়েছেন।

স্বপন মুনশি

দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান

দু’টি কুসুম

ও-পার বাংলায় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে যে ধর্মীয় উন্মাদনা ঘটে গেল, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। অনেক আত্মত্যাগ, অনেক রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে হাজার হাজার তরতাজা হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের যুবক ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাতৃভূমি রক্ষায়। দেশ সে দিন স্বাধীনতা পেয়েছিল হিন্দু-মুসলিম ভাইদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তবে কারা আজ সেই অতীত ভুলে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বারুদ ছড়ানোর চেষ্টা করছে? একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশকে বিশ্বের দরবারে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে?

বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের নাড়ির টান। অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে আমাদের হৃদয় ব্যথিত হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, কবি নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এ কে ফজলুল হক, সৈয়দ মুজতবা আলী, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, শামসুর রাহমান প্রমুখের আদর্শ, দর্শন, সাহিত্য চর্চা করেই আমরা বড় হয়েছি, জ্ঞান অর্জন করেছি। লালন ফকির, হাসন রাজা, ফিরোজা বেগম, মহম্মদ রফি, এ আর রহমান প্রমুখ সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার যখন তাঁদের গান, প্রতিভা আমাদের সামনে তুলে ধরেন, আমরা তো তখন হিন্দু-মুসলিম ভাবতে বসি না। মুসলিম শিল্পীরা যখন হিন্দু বিয়েবাড়িতে সানাইয়ে সুর তোলেন, তখন কি জাত যায়? পাড়ার বা ক্লাবের বারোয়ারি পুজোতে যে মুসলিম ছেলে বা মেয়েটা ফুল দিয়ে গেল, আমরা কি তাকে জিজ্ঞেস করেছি সে কোন জাতের? সন্ধেবেলা রোজা ভাঙতে গিয়ে হিন্দু ছেলেটা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষটিকে কি চপ-মুড়ি-শিঙাড়া এগিয়ে দেয়নি?

ইদের সময় অনেক হিন্দু মুসলিম বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন। মুসলিম শ্রমিক ভাইয়েরা হিন্দুদের পূজামণ্ডপ শৈল্পিক ভাবে নির্মাণ করে দেন। মহরম উৎসবের মিছিলে হিন্দু ভাইয়েরা পানীয় জল এগিয়ে দেন। বাস্তবে অতীতের দিনগুলি থেকেই হিন্দু-মুসলিমদের উৎসব আনন্দধারায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। তবে আজ কেন এই জাতিবিদ্বেষ? কেন এই হানাহানি? কট্টরপন্থী হিন্দু-মুসলিম উভয়কেই বুঝতে হবে— “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”।

স্বপন আদিত্য কুমার

অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

সম্প্রীতির লক্ষ্যে

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে পুজোকে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাকে ধিক্কার জানাই। হাসিনা সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, সমস্ত দোষী শাস্তি পাবে। সরকারের এই ইতিবাচক পদক্ষেপের পরে পরিস্থিতি অবশ্যই শান্ত হওয়া দরকার। এটাও ভাবা দরকার যে, প্রতিবেশী দেশের ঘটনাপ্রবাহ যেন আমাদের দেশের সম্প্রীতিকে ধাক্কা না দেয়। সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ’সহ এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এবং সম্প্রীতি নষ্ট করার নানা রকম চক্রান্ত চলছে। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনও ধর্মীয় মৌলবাদকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত না করে সমস্ত প্রকার ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সম্প্রীতির লক্ষ্যে লড়াই করাটা সমগ্র মানবজাতির কর্তব্য। যদি কখনও কাউকে মৌলবাদী ভাবনা গ্রাস করে, তা হলে তাঁর শিক্ষার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে।

প্রসঙ্গত, শাসক যখন নাগরিকের বাস্তব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে পারে না, তখনই ব্যর্থতা আড়াল করতে ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া হয়। আমাদের দেশে শাসকের এরূপ ভূমিকা বেশ কিছু দিন ধরেই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, যা দেশ, জাতি এবং সংবিধানের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।

সনাতন পাল

বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর

দাঙ্গার দিন

পরিত্রাহি চিৎকার করছে মাস দেড়েকের বাচ্চাটা। ওর মা অনেক চেষ্টাতেও থামাতে পারছে না। এমন সময় এক জন হিসহিসিয়ে বলে উঠল, “মুখটা চেপে ধর, কান্না না থামলে গলা টিপে মেরে দে...।” শুনে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। একটা দশ বাই দশ ঘরে অন্তত জনা পঞ্চাশেক বিভিন্ন বয়সের হিন্দু নারী-পুরুষ গাদাগাদি করে বসে আছেন। আমার মা ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন। স্থান— অধুনা বাংলাদেশের ঢাকার রায়-এর বাজার সংলগ্ন এলাকা। ১ মাঘ, সাল সম্ভবত ১৩৭১। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেধেছে।

আর পাঁচটা দিনের মতোই সে দিনও সব ঠিকঠাক চলছিল। দুপুরের রান্না শেষ। কাঁসার থালা-বাটিতে ভাত, বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল, কাঁসার গ্লাসে জল, আসন-পিঁড়ি সব পাতা হয়ে গিয়েছে। সবাই খেতে বসবে, এমন সময় বাড়ির কাজের ছেলেটি ছুটে এসে খবর দিল, “রায়ট লেগে গেছে, পালাও, পালাও।” বাড়া ভাত পাতে ফেলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এ বাড়ি-ও বাড়ি আশ্রয় ভিক্ষা করে না পেয়ে অবশেষে যখন সবাই প্রাণের মায়া ত্যাগ করেছিল, ঠিক তখনই সদ্য কৈশোর পেরোনো এক যুবকের ডাক, “ও চাচা, তোমরা তাড়াতাড়ি আমার ঘরে চলে এসো। আমার প্রাণ থাকতে তোমাদের গায়ে আঁচড়টুকু লাগবেনি।” দাঙ্গার ভয়াল কোপে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে ভরসা করছে না। যেখানে ছোটবেলার বন্ধু দা-এর কোপ বসাতে দ্বিধা করছে না, সেখানে এই স্বল্পপরিচিত ছেলেটাকে কী করে বিশ্বাস করা যায়? চতুর্দিকে চলছে অবাধ লুটতরাজ। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাশ। মহিলারা নির্যাতনের শিকার। প্রাণ ও সম্ভ্রম বাঁচাতে শেষে এই বাড়িতে আশ্রয়। ছেলেটি আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিল।

ঘরটা রাস্তার পাশেই। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে আততায়ীরা পৈশাচিক উল্লাস করতে করতে যাওয়া-আসা করছে। হঠাৎ এক দল কোথা থেকে খবর পেয়ে এসে ছেলেটিকে বলল, “তোর ঘরে কিছু হিন্দু লুকিয়ে আছে, বার করে দে, নইলে তোরেও কুপিয়ে রেখে যাবো।” সেই ছেলেটি, আলম বলল, “আল্লার কিরে, বিশ্বাস করো আমার ঘরে কেউ নাই।” ওরা আলমের কথা বিশ্বাস করে চলে গেল। ও তো মুসলমান, আল্লার নামে মিথ্যে কিরে কাটবে— তা কি হয়? অথচ, স্বল্পপরিচিত কিছু প্রতিবেশীর জীবন বাঁচাতে সে সেই কাজটিই করল। নিজের জীবন বিপন্ন করে, নিজ ধর্মের মানুষের কাছে মিথ্যা দিব্যি দিয়েও সে সেই দিন আমাদের জীবন বাঁচিয়েছিল। এই কথা ভোলার নয়।

নিরঞ্জন পাল

কৃষ্ণনগর, নদিয়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Communalism Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE