E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: আপসহীন লড়াকু

ঋত্বিক এমনই এক প্রতিভা, যিনি সতত আত্মবিশ্বাসী। দেশভাগজনিত নানা নেতিবাচক প্রভাব যে এক বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন ধ্বংস করতে পারে, সেই যন্ত্রণা সারা জীবন তাঁর বুকে বেজেছে।

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:২৬

চলচ্চিত্র আলোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ঋত্বিককুমার ঘটক বিষয়ক প্রবন্ধ ‘নিঃসঙ্গ শতবর্ষী’ (রবিবাসরীয়, ২৬-১০) বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। সংক্ষিপ্ত অক্ষরে লেখা হয়েছে ঋত্বিকের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার স্বাধীনতার কথা। আমাদের মনে হয় বিষয়টা আসলে প্রত্যাঘাত করার স্বাধীনতা। যে প্রত্যাঘাতের পাঠ ঋত্বিক গ্রহণ করেছেন তাঁর নিজের পরিবার থেকে, এলোমেলো সময় থেকে আর স্বপ্রতিভা-উদ্ভূত শিল্পকলার সৃষ্টিশীলতার কারণ হেতু তাঁর জেদি মনোভাবের দরুন। তাঁর পরিবারে শিল্প ও সারস্বত চর্চার যে এক স্বতন্ত্র ধারা বহমান ছিল, তাঁর পরিবারের একাধিক মানুষের মধ্যে তা প্রবাহিত হয়েছে। এক সময় তিনি বলেছিলেন, যদি চলচ্চিত্র অপেক্ষা আরও অধিক শক্তিশালী কোনও শিল্পমাধ্যম আবিষ্কৃত হয় তবে তিনি সেই মাধ্যমই গ্রহণ করবেন। চলচ্চিত্র তাঁর কাছে ছিল না কোনও গল্প শোনানোর, মনোরঞ্জনের চিন্তাকে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যম। বরং তিনি চেয়েছিলেন মানুষ তাঁর চলচ্চিত্র দেখে তাদের চার পাশটা চিনতে জানতে শিখুক। ভাবতে শিখুক, ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ করতে শিখুক। বস্তুত, ঋত্বিক ছিলেন সারা জীবন আপসহীন লড়াকু। কবি টি এস এলিয়ট যেমন পেয়েছিলেন যুদ্ধোত্তর ইউরোপের পটভূমি, যার বুকের মধ্যে ধারণ করা আছে ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’— ঠিক তেমনই।

ঋত্বিক এমনই এক প্রতিভা, যিনি সতত আত্মবিশ্বাসী। দেশভাগজনিত নানা নেতিবাচক প্রভাব যে এক বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন ধ্বংস করতে পারে, সেই যন্ত্রণা সারা জীবন তাঁর বুকে বেজেছে। বিশাল এক মানবসমাজকে এক কলমের খোঁচায় যুগের পর যুগ পঙ্গু করে দিতে পারে যা— সেই সবেরই ইঙ্গিত তাঁর ছবিতে ছিল। তৎকালীন রাজনীতির মানুষজন বিশেষত যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁদের উপর বিন্দুমাত্র ভরসা ছিল না তাঁর। আমাদের আক্ষেপ, ঋত্বিক স্বভাবত স্বতন্ত্র, তাঁর প্রতিভার সমকালে মূল্যায়ন হয়নি, কারণ আমরা এত দিনে জেনে গিয়েছি— প্রতিবাদ করার সঙ্গী সব সময় পাওয়া যায় না।

প্রতিমা মণিমালা, হাওড়া

জীবনছবি

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ‘নিঃসঙ্গ শতবর্ষী’ প্রবন্ধ ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে এক মনোজ্ঞ বিশ্লেষণধর্মী রচনা। সত্যজিৎ রায় মনে করতেন তিনি ছিলেন বাঙালি শিল্পী। মনেপ্রাণে বাঙালি চিত্রপরিচালক। আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও শিল্পচেতনার জগতে আজও তিনি এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ঋত্বিক ঘটক ছিলেন সুষমাময় জীবনের ইঙ্গিতধর্মী রূপকার। শিল্পী হিসাবে তিনি আশাবাদী, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর। তাঁর ছবি বাঁচার ও সংগ্রামের নতুন প্রেরণাদায়ক। দেশভাগের যন্ত্রণা, বেদনা ও ছিন্নমূল মানুষের বদলে যাওয়া জীবনযাত্রা তাঁর চলচ্চিত্রে স্মরণীয় হয়ে আছে।

বাংলার মানুষের সার্বিক সত্তাসঙ্কটের মর্মস্পর্শী চিত্রায়ণ ঋত্বিক ঘটককে সিনেমাজগতে এক স্বতন্ত্রতা দান করেছে। তিনি ছিন্নমূল মানুষের অন্তর্বেদনা, সামাজিক সঙ্কট ও সংগ্রামের প্রেরণার উজ্জ্বল রূপায়ণ ঘটিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন চলচ্চিত্রে। পরিবারের অন্নসংস্থানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নারীর অসহায়তা ও শূন্য হৃদয়ের আর্তি তাঁর ছবিতে (মেঘে ঢাকা তারা) এক অনন্য রূপ পেয়েছে। সেখানে দেশভাগ-পরবর্তী যুগের চিত্ররূপ আমাদের আজও ভাবায় (কোমল গান্ধার)। সেই সঙ্গে বাস্তুহারা মানুষের আর্থিক বিপন্নতা ও সামাজিক অধোগতির মর্মান্তিক দৃশ্যায়ন ঘটিয়েছেন অপূর্ব দক্ষতায় (সুবর্ণরেখা)। ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে ঋত্বিক সব সময়ই গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে বিষয়বস্তু নির্বাচনে অসম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। যন্ত্রের মধ্যে মনুষ্যত্ব আরোপের চেষ্টা বিশেষ তাৎপর্য বহন করেছে। এবং ছবিতে লোকসঙ্গীতের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি অসম্ভব সাফল্য অর্জন করেছিলেন। এ সব ক্ষেত্রে ঋত্বিকের ক্ষমতা ছিল তর্কাতীত।

এক রকম হতাশা ও বেদনায় শেষ হয়েছিল তাঁর জীবন। কিন্তু ঋত্বিকের কবিতা তৈরির আশ্চর্য দক্ষতা, সঙ্গীতের সুমিত প্রয়োগ তাঁকে অমর করে রেখেছে। ঋত্বিক ঘটকের প্রতিটি ছবিই চিন্তা উদ্রেককারী, নাগরিক মনকে নাড়া দিয়ে যায়। আসলে তাঁর চলচ্চিত্রবোধের মানই ছিল প্রশ্নাতীত। নাগরিক ভারতীয় সিনেমার অগ্রগতির ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ছবি বলে মনে করেন অনেকেই। অথচ ঋত্বিকের জীবিতকালে এ-ছবি মুক্তির আলো দেখেনি। তাঁর মৃত্যুর পর এ দেশের বিভিন্ন শহরে নাগরিক প্রদর্শিত হয় এবং পোস্টারে লেখা হয়েছিল ‘সঠিক সময় মুক্তি পেলে নাগরিক-ই হত বাংলা সিনেমায় নবজাগরণের সূত্রপাত।’ পরে প্রদর্শিত হওয়ায় ঋত্বিকের শিল্পী জীবনের ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।

নাগরিক ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাংলাদেশের নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত জীবনের ভাঙনের ছবি। ঋত্বিক ঘটক বরাবরই ছিলেন সময়ের থেকে এগিয়ে। সংলাপ নির্মাণে, মননে, দৃশ্য সংঘাতে ও শব্দের ব্যবহারে তাঁর সৃষ্টি ছিল অভিনব। সঙ্গে ছিল দর্শকমন নাড়িয়ে দেওয়া সব কাব্যমুহূর্ত। একটি সামগ্রিক সাংস্কৃতিক রাজনীতির দিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল। আজ দেশে বিদেশে তাঁকে নিয়ে চর্চা, প্রশংসায় আমরা গর্ব অনুভব করি। তবে সমকালে নানা কারণে তিনি হয়েছিলেন অবহেলিত, পিছিয়ে গিয়েছিল ছবির প্রদর্শন। সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি একক হয়েও আমাদের চোখে আজও জাত শিল্পী। বাস্তুহারার জীবনছবি নির্মাতা হিসাবে খ্যাতির আলোয় উজ্জ্বল।

সুদেব মালখরসরাই, হুগলি

অনন্ত সৃষ্টিশক্তি

ভারতীয় চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটক এক অনন্য নাম। তিনি কেবল এক জন পরিচালক নন, অসাধারণ লেখক, শিক্ষক, অভিনেতা, রাজনীতি-সচেতন নাগরিকও। তিনি ছিলেন সময়ের বিবেক, সমাজের রক্তক্ষরণের সাক্ষী। তাঁর চলচ্চিত্রের মূল সুর— দেশভাগের যন্ত্রণা, মানুষের বিচ্ছিন্নতা, সংস্কৃতির অবক্ষয়, আর পুনর্মিলনের আকাঙ্ক্ষা। কেবল বিনোদন নয়, তিনি সিনেমাকে ব্যবহার করেছেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে, সমাজকে বার্তা দেওয়ার মাধ্যম হিসাবে। সত্যজিৎ রায় যেখানে নীরব কাব্যের মাধ্যমে বাঙালি জীবনের সৌন্দর্য দেখিয়েছেন, সেখানে ঋত্বিক ঘটক দেখিয়েছেন তার বেদনাময় রূঢ় বাস্তবতা। তখনকার স্বল্প বাজেট, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাব, উপযুক্ত লোকেশন না পাওয়া সত্ত্বেও ঋত্বিক বিশ্বমানের সিনেমা তৈরি করেছেন। তাঁর ছবি-দৃশ্যপট নির্মাণের ভাবনা ও প্রতিস্থাপন সেই সময় সবচেয়ে আলাদা মনে হয়েছে। এক রকম আকর্ষণ তৈরি করেছে বারে বারে। এই রসদের ভান্ডার হল তাঁরই সমসাময়িক শিল্পীদের আঁকা ছবি, যেগুলির ব্যবহার তিনি তাঁর সিনেমায় করেছেন।

তাঁর জীবন ছিল তাঁর সিনেমার মতোই ভাঙাচোরা। তবুও সৃষ্টিশক্তি কখনও নিঃশেষ হয়নি।

গৌতম পতিতমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

কালজয়ী

‘নিঃসঙ্গ শতবর্ষী’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ভাবা যায়, যে-লোক মূলত বামপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাস করতেন তিনি মুম্বইতে গিয়ে এমন গল্পে হাত দিয়েছেন যা মূলত পরজন্ম নিয়ে। দিলীপকুমারের কেরিয়ারের ভূষণ হয়ে ওঠে এই ছবি, যার নাম মধুমতী। মনে পড়ে সত্যজিতের সেই অমোঘ কথা যা উনি এই কালজয়ী সিনেমাশিল্পীর সম্বন্ধে বলেছিলেন, “টু হুম হলিউড নেভার এগ্‌জ়িস্টেড।”

সুশান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা-৪০

চলমান সিঁড়ি

ব্যারাকপুর স্টেশনে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যেতে ওভারব্রিজ ব্যবহার করতে হয়। কিছু মানুষ লাইনের উপর দিয়ে যাতায়াত করেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বয়স্ক মানুষের ওভারব্রিজ দিয়ে যাতায়াতও কষ্টকর। এখানে চলমান সিঁড়ি বা লিফট-এর ব্যবস্থা হোক।

আশাদু জামান বিশ্বাস, কলকাতা-১২১

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Film Industry Tollywood

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy