Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Bank Loss

আদায়ে ঘাটতি

সরকারের দাবি, ২০১৭ সালে অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের ১১.২ শতাংশ, মোট ১০.৪ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ সালে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ শতাংশে, অর্থাৎ ৫.৩ লক্ষ কোটি টাকায়।

An image of Money

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৩ ০৪:১৬
Share: Save:

কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক ও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন একাধিক বার দাবি করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আর্থিক দিশায় চলার কারণে ব্যাঙ্কের অবস্থা এখন ভাল ও মজবুত। তাঁদের দাবি, ইউপিএ আমলের তুলনায় মোদী জমানায় ব্যাঙ্কের অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ কমেছে। যদিও অর্থনীতিবিদরা এ কথা মানতে নারাজ। কারণ মোদী জমানায় অনাদায়ি ঋণ মকুব করার পাশাপাশি নতুন করে ঋণ মঞ্জুর করাও হয়েছে। ফলে, শেষ পর্যন্ত অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে। ব্যাঙ্কের লোকসানই হচ্ছে।

এখন নিয়ম হল, অনাদায়ি ঋণ মকুব করা হলেও তা আদায়ের প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, ঋণ-খেলাপিরা ঋণ শোধ করছেন না। যে টাকাটা আদায় করা হয়েছে, তা মোট ঋণের অতি সামান্য অংশ, সিংহভাগই ব্যাঙ্কের ঘর থেকে গিয়েছে। এই লোকসানের হিসাব কিন্তু অর্থ মন্ত্রক দেখাচ্ছে না। সরকার ও ব্যাঙ্ক দেশবাসীকে ভুল বোঝাচ্ছে, যা দুর্ভাগ্যজনক।

সরকারের দাবি, ২০১৭ সালে অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের ১১.২ শতাংশ, মোট ১০.৪ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ সালে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ শতাংশে, অর্থাৎ ৫.৩ লক্ষ কোটি টাকায়। কিন্তু আসল চিত্রটা ভিন্ন। গত ৫ বছরে অনাদায়ি ঋণ আদায় হয়েছে প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা, যা মোট অনাদায়ি ঋণের মাত্র ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ, বাকি ৭৫ শতাংশ (২৪ লক্ষ কোটি টাকা) ব্যাঙ্কের লোকসান। উপরন্তু, অনাদায়ি ঋণ মকুব করার পর আবার সেই গ্রাহকদেরই নতুন করে ঋণ দেওয়া হয়েছে।

এ ভাবে গত তিন বছরে অনাদায়ি ঋণ জমেছে প্রায় ১০.৬ লক্ষ কোটি টাকা। যা আগেকার নিয়ম থাকলে দেওয়া হত না, বরং তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে বাদ দেওয়া হত। গত তিন বছরে কর্পোরেটদের জন্য অনাদায়ি ঋণ মকুব করা হয়েছে মোট ৬ লক্ষ কোটি টাকা। তবে ব্যাঙ্ক অনাদায়ি ঋণ মকুব করার সঙ্গে সঙ্গেই তা খাতা থেকে মুছে দিয়ে অনাদায়ি ঋণ কম দেখাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলির উচিত, এই বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনায় বসা, লোকসভার ভিতরে ও বাইরে প্রতিবাদে সরব হওয়া, এবং একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে চাপে রাখা, যাতে তাঁরা ব্যাঙ্কগুলির লোকসান কমাতে শীঘ্রই নতুন নিয়ম চালু করেন।

পঙ্কজ সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি

ভোগবাদ

‘লাভের গুড় যায় কোথায়’ (রবিবাসরীয়, ২৫-৬) প্রবন্ধে অমিতাভ গুহ সরকার কর্পোরেট দুনিয়ার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন। পণ্যের দাম বাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকে লাভই হোক, আর বেসরকারি হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিষেবা খরচ বাবদ ধার্য অর্থ থেকে উদ্বৃত্তই হোক, তার সবটাই সরাসরি আসে পণ্যের ক্রেতা ও পরিষেবা গ্রহণকারী ব্যক্তির পকেট থেকে। তাই যখন এক নামী টায়ার উৎপাদনকারী কোম্পানির দশ টাকা মূল্যের শেয়ারের দাম এক লক্ষ টাকা ছাড়িয়েছিল, তা পুরোটাই এসেছিল টায়ারের দাম বাড়ানোর জন্য। টায়ারের ক্রেতা ট্রাক, ট্র্যাক্টর, টেম্পো, লরি ইত্যাদির মালিকেরা সেই বর্ধিত টায়ারের মূল্যের অনেকটাই তুলেছিলেন পণ্য পরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধি করে। এ ভাবেই এক প্রসাধনী পণ্য উৎপাদনকারী বহুজাতিক সংস্থা বছরে এক কোটি টাকার বেশি বেতন দিতে পারে তার উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের। কর্পোরেট সংস্থাগুলি তাদের কর্মচারীদের জন্য এত কিছু সুযোগ-সুবিধার বেশির ভাগটাই সংগ্রহ করে পণ্যের মূল্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকে। তার পরও থাকছে ‘লাভের গুড়’, যার কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। তাই দশ টাকার শেয়ারের দাম সহজ সরল পথেই সোজা পৌঁছে যেতে পারে এক লক্ষ টাকায়। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যে জনসাধারণের পকেট কেটে এই বিপুল পরিমাণ মুনাফা লগ্নিকারীরা বাজার থেকে তুলে নিতে সক্ষম হলেন, সেই সাধারণ মানুষেরই এ বিষয়ে খবর রাখার সুযোগ বা সময়, কোনওটাই থাকে না।

এ ভাবেই চলে চিকিৎসা ব্যবস্থাও। মুনাফা অর্জনের জন্য বিবেক বিসর্জন দিতে হয় বলেই কর্পোরেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সে সব নিয়ে ভাবতে গেলে চলে না। লাভের পরিমাণ কমলেই লগ্নিকারীরা মুখ ফেরাবেন। সুতরাং, মুনাফার পরিমাণ বাড়ানোর জন্য চিকিৎসক-সহ সর্বস্তরের আধিকারিকদের জন্য কর্পোরেট দুনিয়ার অন্য কর্মচারীদের সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতেই হয়। পকেট কাটা যায় সাধারণ রোগীর। কর্পোরেট ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলির দৌরাত্ম্যে জীবনদায়ী ওষুধ থেকে সাধারণ ওষুধের দামও জনসাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ওষুধের বিপণনের জন্য কোম্পানিগুলি চিকিৎসকদের স্মরণাপন্ন হয়। মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভদের মাধ্যমে চিকিৎসকদের নানা রকম আকর্ষণীয় সুবিধা দেওয়া হয়। তার মূল্য সবটাই তুলে নেওয়া হয় ওষুধের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে। ওষুধের মোড়কের গায়ে সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য এতটাই বাড়িয়ে মুদ্রিত থাকে যে, খুচরো ওষুধ বিক্রেতারাও ক্রেতাদের শতকরা ১০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় সহজেই দিতে পারেন। আমাদের মতো গরিব দেশে চিকিৎসার খরচ নাগালের বাইরে চলে যাওয়াটা এখন এ ভাবেই গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের তুলনায় বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুদের জন্য নার্সারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল শিক্ষাবাজার। ডাক্তারি, এঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট-সহ প্রায় সব বিষয়েই পড়ার সুযোগ। কর্পোরেট লগ্নিকারীরা পাড়ায় পাড়ায় দ্রুত গড়ে তুলেছেন বেসরকারি স্কুল। এখানে খরচ ও উদ্বৃত্তের ব্যবধান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লেখ না করা হলেও, করোনার সময়ে অভিভাবকদের অসহায়তার যে ছবি প্রকাশ্যে এসেছিল, তা ছিল উদ্বেগজনক। এই সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার খরচ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরাই নির্ধারণ করেন।

ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি সর্বতোভাবে মুনাফাকেন্দ্রিক। সরকার মুখিয়ে থাকে নানা রকম কৌশলে কর আদায়ের সুযোগ নেওয়ার। এক দিকে পণ্যের উপভোক্তারা পণ্য ক্রয়ের সময়ে সরাসরি কর দেন, অন্য দিকে পণ্য উৎপাদনকারীরাও কর দিয়ে থাকেন। উচ্চ আয়ের কর্মচারীদের নিকট থেকেও আসে বিপুল পরিমাণ আয়কর। এই ব্যবস্থায় সরকারকে শুধুমাত্র কর আদায়ের ব্যবস্থাপনা করতে হয়। এ ছাড়া যত দিন পর্যন্ত সরকারের কাছে বিক্রয়যোগ্য সম্পদ থাকবে, তত দিন বিলগ্নিকরণের মাধ্যমেও সরকারের কোষাগারে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হবে। এ ভাবে চললে অচিরে সরকারের নিজস্ব আয়ের উৎস বলতে বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। উৎপাদন ব্যবস্থার গোটাটাই চলে যাবে বেসরকারি লগ্নিকারীদের হাতে। তখন রাষ্ট্রের যাবতীয় খরচের সবটাই কর সংগ্রহের মাধ্যমে তোলার উদ্যোগ করতে হবে।

মুনাফা-তাড়িত ভোগবাদী তথা আত্মকেন্দ্রিক সমাজ, মানব জীবনের সুকোমল বৃত্তিগুলোর পরিচর্যা করতে উৎসাহিত করার বদলে, কাজের গতি বাড়াতে ইন্ধন জোগায়। মুনাফার ভাগ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেশায় পরিণত করে। যাতে সে উদয়াস্ত কঠোর পরিশ্রম করে কোম্পানির মুনাফা অর্জনের স্বার্থে প্রাত্যহিক দৌড়ের গতি কখনও না থামায়। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, সুখের সন্ধান পেতে মরিয়া অনেকেরই অনেক সুপ্ত প্রতিভা আজীবন চাপাই থেকে যায়। সেগুলির বিকাশের সুযোগ হয় না।

তা সত্ত্বেও বলব, গোটা মনুষ্য সমাজ একযোগে ভোগবাদী লালসার শিকার হবে, এমনটা ধরে নেওয়া যায় না। বহু মানুষ সচেতন ভাবেই তথাকথিত সুখের হাতছানি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সমর্থ ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। তাঁরাই পারবেন সাহিত্য, সঙ্গীত, খেলা, শিল্প ও বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে সৃষ্টিধর্মী মন ও প্রতিভাকে বাঁচিয়ে রাখতে। সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে মুনাফা-সর্বস্ব পুঁজিবাদ সাময়িক অবস্থান মাত্র। তা কখনওই সভ্যতার শেষ স্টেশন হতে পারে না।

রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE