অভিরূপ সরকার তাঁর ‘ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও উন্নয়ন’ (৮-৭) প্রবন্ধে সঠিক ভাবেই উল্লেখ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলে দীর্ঘ দিন ধরে বাম শাসন থাকা সত্ত্বেও কেরলের তুলনায় ক্ষুদ্র শিল্পে লগ্নি এবং উৎপাদনশীলতায় এই রাজ্য অনেকটাই পিছিয়ে। অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এমএসএমই) শিল্প ক্ষেত্রে বরাবরই পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল। এটা ঠিক যে, ছোট ও ক্ষুদ্র শিল্পে বড় ও মাঝারি শিল্পের তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু বড় ও মাঝারি শিল্প না থাকলে ছোট ও ক্ষুদ্র অনুসারী শিল্পের প্রসার ঘটা সম্ভব নয়। একটা সময় হাওড়া জেলার বেলিলিয়াস রোড, লিলুয়া, ঘুসুরি প্রভৃতি অঞ্চলে অসংখ্য ছোট-বড় কারখানা ছিল। কিন্তু বিরোধীদের ধ্বংসাত্মক শিল্প বিরোধী আন্দোলনের ফলে বড় এবং মাঝারি শিল্পের পাকাপাকি ভাবে সলিল সমাধি ঘটেছে। যদিও কেরলে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলো কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
একই ভাবে আমাদের রাজ্যে বর্তমানে সরকারের সঙ্গে বিরোধীদের তীব্র বিরোধ থাকা সত্ত্বেও গত ১৪ বছরে কোনও বিরোধী দল রাজ্য সরকারের শিল্পোদ্যোগের বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। রাজ্য সরকারের উদাসীনতার ফলে এমএসএমই ইউনিটের সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে থাকা সত্ত্বেও উৎপাদনশীলতায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ঔপন্যাসিক পার্ল এস বাক তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দ্য গুড আর্থ-এ দেখিয়েছিলেন কী ভাবে অভাবের তাড়নায় উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র ওয়াং লাং রিকশাচালকে পরিণত হয়েছিলেন। আমাদের রাজ্যেও একই ভাবে হাজার হাজার বেকার ছেলে অভাবের তাড়নায় টোটোচালকে পরিণত হচ্ছেন। যে-হেতু এই বেকার যুবক-যুবতীদের কোনও সরকারের পক্ষেই চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়, সেই কারণে দান-খয়রাতির পরিবর্তে সরকারের উচিত উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, পরিকাঠামো এবং সহজ সরল শর্তে ঋণ দানের ব্যবস্থা করে এঁদের উদ্যোগপতি হয়ে উঠতে সাহায্য করা।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
অনুপ্রবেশকারী?
‘বিএলও-চাপ, কমিশনকে চিঠি শুভেন্দুর’ (৩০-৭) শীর্ষক খবরে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রেরিত শুভেন্দু অধিকারীর চিঠিতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটির প্রয়োগ আপত্তিকর। তিনি বলেছেন, “যাঁরা ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে আছেন, তাঁরা শরণার্থী। তাঁদের জন্য সরকার সিএএ (সিটিজ়েনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) করেছে। তাঁদের কারও নাম বাদ যাবে না। দায়িত্ব নিচ্ছি।” একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, “মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা এবং আগত বাংলাদেশি মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী।” তিনি কি জেনেশুনেই ‘নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ২০১৯’-এর বিকৃতি ঘটাচ্ছেন?
প্রসঙ্গত, ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯ সালে পাশ হয়েছিল যথেষ্ট বিতর্কের মধ্যে দিয়ে। এতে ১৯৫৫ সালের মূল নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মাধ্যমে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আগত নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। মূলত, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর কিংবা তার আগে আসা অভিবাসীদের জন্য আবেদনের ভিত্তিতে এই আইনি সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে কোথাও শরণার্থী বা অনুপ্রবেশকারী শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়নি। আইনে রয়েছে ‘ইললিগাল ইমিগ্র্যান্ট’ (অবৈধ অনুপ্রবেশকারী) শব্দবন্ধটি। প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ‘অভিবাসী’; আগত মুসলমান, তামিল বা তিব্বতিরাও ‘অভিবাসী’। কিন্তু কোথাও তো ‘ইনট্রুডার’ বা ‘ইনফিলট্রেটর’, যাকে বাংলায় বলে অনুপ্রবেশকারী, পাইনি কখনও।
ফলে, শুভেন্দু অধিকারীর এই ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দপ্রয়োগ রাজনৈতিক এবং অবৈধও বটে। উনি নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরপেক্ষতা রক্ষার দায়কে বিশেষ রাজনীতির রং দিয়ে কলুষিত করতে চাইছেন।
জিতেন নন্দী, কলকাতা-১৮
রুচির অভাব
এক ইউটিউবার প্ল্যাটফর্মে উদ্ভট ভঙ্গিতে রিল বানাচ্ছে। কিংবা, ব্যস্ত বাজারে এক তরুণ দোকানদারের মুখে জল ছুড়ে পালাচ্ছে, পাশেই ঘাপটি মেরে থাকা কেউ তা ক্যামেরাবন্দি করছে। এ সব ঘটনা এখন আর ব্যতিক্রম নয়। এগুলোই আমাদের ‘কনটেন্ট কালচার’। আমরা কেউ দর্শক, কেউ প্রশ্রয়দাতা। আর, এই ‘কনটেন্ট’-এর অভ্যন্তরেই লুকিয়ে রয়েছে এক ভয়াবহ সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিপন্নতা— যা আমাদের সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আমরা ক্রমে প্রবেশ করছি এক এমন ডিজিটাল যুগে, যেখানে মাপকাঠি ‘রুচি’ নয়, ‘রিচ’। যার যত বেশি ভিউ, সে তত বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে— তুলনায় কনটেন্টের বিষয়বস্তু হয়ে পড়ে গৌণ। এই সমাজে সব কিছুই হালকা, অগভীর এবং তাৎক্ষণিক আনন্দের খোরাক। বর্তমানে যে কনটেন্ট ‘ভাইরাল’ হয়, তার গঠনমূলক বা নান্দনিক মূল্য কতটুকু? কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এর পিছনে রয়েছে ‘অ্যাটেনশন ইকনমি’। এখানে যে যত বেশি নজর কাড়তে পারবে, সে তত বেশি লাভবান হবে— লাইমলাইট, স্পনসরশিপ, অর্থ, পরিচিতি। তাই যে কোনও মূল্যে ‘চমক’ তৈরি করতে পারাই লক্ষ্য। ফলে, ক্রিয়েটররা যেমন বিকৃত প্রতিযোগিতায় জড়াচ্ছেন, তেমনই দর্শকরাও এমন অসুস্থ রুচিকে উৎসাহ দিচ্ছেন। আমরা প্রায় ভুলে গিয়েছি যে, সমাজমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলি মূলত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তারা এমন কনটেন্টকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা ‘এনগেজমেন্ট’ বাড়ায়— মানে যা দেখে মানুষ প্রতিক্রিয়া দেবে, শেয়ার করবে, আলোচনা করবে, বিরক্ত হলেও চোখ সরাতে পারবে না।
স্ট্যানফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, রিলস, শর্টস-এর অতিরিক্ত আসক্তিতে কিশোরদের মধ্যে অ্যাটেশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডার, অবসাদ, আত্মপরিচয়ের সঙ্কট আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সমাজমাধ্যমে তৈরি হচ্ছে এমন এক ‘ভার্চুয়াল আয়না’, যেখানে সবাই নিজের মুখ দেখতে চায়, কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চায় না।
এখানে কনটেন্ট ক্রিয়েটররাও বন্দি। তাঁদের উপর রয়েছে প্রতিনিয়ত আপলোডের চাপ, ‘ভিউ’ না পাওয়া, জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলার ভয়, বা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক। এই চাপই অনেককে ঠেলে দিচ্ছে মানসিক বিপর্যয়ের দিকে। এই প্রভাব শিশু-কিশোরদের মধ্যেও ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। দশ বছরের একটি শিশু যদি ভাবে—‘ভিউ না পেলে জীবন বৃথা’, তা হলে সে যে কতটা বিপন্ন, তা সহজেই বোঝা যায়।
তবে এত খারাপের মাঝেও আশার আলো আছে। সব ক্রিয়েটরই এই তুচ্ছতার রাস্তায় হাঁটেন না। অনেকেই শিক্ষামূলক, সৃজনশীল, নান্দনিক বা সামাজিক ভাবে প্রাসঙ্গিক কনটেন্ট তৈরি করছেন— যাঁদের মধ্যে কেউ বিজ্ঞান শেখাচ্ছেন সাধারণ ভাষায়, কেউ পরিবেশ রক্ষার কথা বলছেন, কেউ সাহিত্যচর্চা করছেন। তাঁরা সংখ্যায় কম হলেও তাঁদের প্রভাব গভীর। তাঁরা প্রমাণ করছেন— কনটেন্ট মানেই রুচিহীনতা নয়। প্রয়োজন দর্শকের দায়িত্বশীলতা ও মঞ্চগুলির পক্ষপাতহীন নীতি।
এই ‘রুচিহীনতা’র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো জরুরি। প্রযুক্তি সংস্থাগুলির উচিত নীতিগত কিছু পরিবর্তন এনে এই ধরনের লঘুতাকে প্রশ্রয় না দেওয়া। সবশেষে, আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দায়িত্ব— কী দেখছি, কী শেয়ার করছি, কোন জিনিসে ভিউ বাড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছি— সেগুলি নিয়ে একটু ভাবা। কারণ এই ‘রিচ’-এর পিছনে ছুটতে গিয়ে যদি ‘রুচি’ হারিয়ে যায়, তবে আগামী প্রজন্ম কোনও কিছুর গভীরে গিয়ে ভাবতে শিখবে না।
অগ্রদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)