E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: অন্তরের শুদ্ধিকরণ

প্রবন্ধকারের মতে, স্থানীয় স্তরে সামবায়িক সমাজ ব্যবস্থাপনার আদর্শটা এখনও প্রাসঙ্গিক।

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:০০

‘অনুসরণ নয়, প্রেরণা’ (৬-১০) শীর্ষক অনুরাধা রায়ের সুচিন্তিত প্রবন্ধটি সম্পর্কে কয়েকটি কথা। মহাত্মা গান্ধী বলতেন, নিজের গ্রামকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা গ্রামবাসীদের কর্তব্য। স্বরাজ-সরকার তাঁদের জন্য এ কাজ করে দেবে, গ্রামবাসীদের এ রকম আশা মনে পোষণ করলে চলবে না। গ্রামের কার্যকলাপ যথাসম্ভব সমবায়ের ভিত্তিতে পরিচালনা করতে হবে। গ্রামের শাসনকার্য চালাবেন পাঁচ জন সদস্যের একটি পঞ্চায়েত এবং স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের সকল প্রাপ্তবয়স্ক অধিবাসীর দ্বারা তাঁদের বাৎসরিক নির্বাচন হবে। সেই গ্রামে জাতিভেদ প্রথা বা অস্পৃশ্যতার অভিশাপ থাকবে না। অহিংসা ও সত্যাগ্রহ হবে গ্রামীণ সমাজের শক্তির মূলাধার। পঞ্চায়েতের সদস্য নির্বাচনকারী এই সব গ্রামবাসীর ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে। গান্ধীজি লিখেছিলেন, আমার কল্পিত গ্রামীণ একম্ (ইউনিট) সর্বাপেক্ষা শক্তিশালীর মতোই বলবান। গ্রামে এক হাজার লোকের বাস— এই রকম কোনও একম্-কে স্বাবলম্বনের আধারে সুসংগঠিত করলে চমৎকার ফল পাওয়া যাবে।

প্রবন্ধকারের মতে, স্থানীয় স্তরে সামবায়িক সমাজ ব্যবস্থাপনার আদর্শটা এখনও প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে আমাদের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে যে গ্রামসমাজ চলছে সেখানে সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই চলছে। শুধু তা-ই নয়, পঞ্চায়েতগুলি সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের দেওয়া অর্থের উপর নির্ভরশীল। স্বনির্ভর হওয়ার কোনও রকম পরিকল্পনা নেই। প্রকৃতপক্ষে পঞ্চায়েতগুলি সরকারের দেওয়া অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে এজেন্সি হিসাবে কাজ করে মাত্র। এখানেই গান্ধীজির আদর্শের সঙ্গে বড় পার্থক্য। গান্ধীজি মনে করতেন, যখন টাকা কেবল দেওয়া হয়, তখন তার ফলে শুধু অপকারই হয়। প্রয়োজন হলে অর্থ উপার্জন করতে হয়। আসলে গান্ধীজি তত্ত্ব এবং জীবনকে মিলিয়েছেন। কার্ল মার্ক্স এক সম্পূর্ণ বিকল্প সমাজের কথা ভেবেছিলেন। গান্ধী চেয়েছিলেন এক বিকল্প সভ্যতা। মার্ক্স-এর বিশ্লেষণে সামাজিক মানুষের কথা উঠত। গান্ধীজি তাকাতেন ভিতরের দিকে। অর্থাৎ তিনি নিজেকে দিয়েই বিশ্লেষণ করতেন। নিজের মোক্ষলাভের চেষ্টা করলেন অন্য লোকের সেবায়। সমাজকে বদলানোর আগে ব্যক্তিকে বদলানোর উপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। তিনি জোর দিয়েছিলেন ব্যক্তির মধ্যে মানবিকতা ও পারস্পরিকতা নিশ্চিত করতে। তিনি জানতেন, মানুষ পাল্টালে তবেই সমাজ পাল্টাবে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কাজই মানুষকে তৈরি করে, কাজই মানুষকে পাল্টায়। আন্দোলন সত্যাগ্রহীকে তৈরি করবে। সত্যাগ্রহ থেকেই নতুন মানুষ আসবেন। সেই মানুষ নতুন সমাজ তৈরি করবেন। তাই ব্যক্তি মানুষ যদি নিজেকে শোধন করতে না পারেন তিনি অন্যকে পথ দেখাবেন কেমন করে! এ ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের কথাও স্মরণীয়। স্বামীজি বলতেন, আগে নিজে তৈরি হও। পরে অন্যকে তৈরি করো। গান্ধীজি একটা অহিংস সমাজ চাইছিলেন, যে সমাজে সবাই কাজ করবে এবং সবাই সবাইকে চিনবে। সেই সমাজে প্রতিযোগিতা থাকবে না, ফলে হিংসা আসবে না। তাই, বলা চলে আমরা গান্ধীজিকে গ্রহণ করতে পারিনি, কেবলমাত্র তাঁকে মনে রেখেছি। কারণ তাঁর জন্মদিনটি আমরা জাতীয় ছুটির দিন বলে উপভোগ করি মাত্র। গান্ধীজিকে আমরা নিজেদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করিনি, তাঁকে আদর্শ বানিয়েছি মাত্র।

সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি

অহিংসার সন্ধানে

‘অনুসরণ নয়, প্রেরণা’ শীর্ষক অনুরাধা রায় লিখিত প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা।

বর্তমান সমাজে গান্ধীজির আলোকে সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তিটির আলোচনার প্রারম্ভে ‘দুর্নীতি’ নামক দূষণের চরিত্রটি নির্ণয় অতি প্রাসঙ্গিক। সুভাষচন্দ্র বসু কিংবা জওহরলাল নেহরু আর্থিক বিকাশে রাষ্ট্রের মুখ্য ভূমিকার কথা বার বার উল্লেখ করতেন প্রধানত এই কারণে যে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং বাজারে কেনাবেচার মধ্য দিয়ে যে ধরনের বিনিয়োগ সাধারণত হয়ে থাকে তাতে সামাজিক উন্নতির চিন্তার তুলনায় কারবারের লাভ-লোকসানের চিন্তাই বেশি থাকতে দেখা যায়। গান্ধীজি আর্থিক বিকাশকে জীবনচর্যার মূল লক্ষ্য বলেই মনে করতেন না। অন্য দিকে, কার্ল মার্ক্স আশা করেছিলেন, শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠনই পারবে আর্থিক বিকাশের পথ প্রশস্ত করতে, রাষ্ট্র সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বিগত দিনগুলিতে আমরা দেখেছি, আড়েবহরে পার্টির শ্রীবৃদ্ধি করাই ছিল বামপন্থীদের অন্যতম উদ্দেশ্য। শেষ পর্যন্ত সমাজ গঠনে আত্মা দিয়ে মনোনিবেশ করার কাজে তাঁরা ব্যর্থ। মহাত্মা গান্ধীর কংগ্রেসের আন্দোলনও ছিল প্রধানত গ্রামজীবনকে নিয়ে এবং কৃষকদের নিয়েই। কিন্তু স্বাধীনতার পর কংগ্রেস গান্ধীজির নির্দেশ এবং কর্তব্য পালন করেনি। কংগ্রেস ধরেই নিয়েছিল যে গ্রামের মানুষরা বেশির ভাগই তাদের বিরুদ্ধবাদী। নেতারা গ্রামে না গিয়ে শহরকেন্দ্রিক রাজনীতি করেছেন।

বস্তুবাদী সভ্যতার কিছু কুশ্রী রূপ দেখেছিলেন গান্ধীজি। তিনি বলেছিলেন, প্রাচীন ভারতের কৃষি ও কুটির শিল্প উৎপাদন বা বিনিময়-নির্ভর গ্রামজীবনে শোষণ ছিল না, তাই হিংসা ছিল না। বৃহৎ যন্ত্র ও বেপরোয়া নগরায়ণ হিংসার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। গ্রামের মানুষ স্বল্পে সন্তুষ্ট ছিল। সামবায়িক জীবনে অভ্যস্ত ছিল। অন্য দিকে, বৃহৎ শিল্পের মূল কথা মূলধনের সর্বাধিক লাভের প্রয়োজনে যথেচ্ছ ভোগ্যপণ্য উৎপাদন এবং বাজারের বিস্তার, যা করতে গিয়ে এল উপনিবেশ আর সাম্রাজ্য। বস্তুবাদ থেকে শিল্প-বিপ্লব, আবার তার থেকে সাম্রাজ্যবাদ যা হিংসাকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই ‘অহিংসা’ নামক গুণটি শ্রেণি-বিশেষের স্বার্থ সাধন করবে না। অহিংসা সভ্যতার চিরন্তন মূল্যবোধ।

গান্ধীজি বলেছিলেন, সত্যিকার স্বাধীনতা পেতে গেলে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। গ্রামের সরল সহজ স্বনির্ভর জীবনযাত্রায় হিংসা ও অসত্য ত্যাগ সম্ভব, শহরে নয়। ব্যক্তি যদি তাঁর জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের উপর নিয়ন্ত্রণ হারান, তবে প্রথমে বলি হবেন দলের কাছে, পরে রাষ্ট্রের কাছে।

অথচ পরবর্তী সময়ের ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় আমরা লক্ষ করেছি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নে আমরা দ্রুতগতির জীবনে অভ্যস্ত হয়েছি, কিন্তু তাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া আর কারই বা কী লাভ হয়েছে! আমরা ভোগ্যপণ্যের স্তূপে হারিয়েছি শান্তি। আত্মাহীন প্রগতির পরিণাম এক ফাঁপা সমাজের প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে আমরা বুঝতে পেরেছি বাজার অর্থনীতিও আমাদের সমাজে সমস্যার সুরাহা করতে পারছে না। নির্দ্বিধায় বলা চলে রাষ্ট্রীয় শিল্প বা বাজার অর্থনীতি আমাদের আদর্শ জীবন দিতে সফল হতে পারেনি।

সঞ্জয় রায়, হাওড়া

কুর্নিশ তাঁদের

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অন্তর্বর্তী উপাচার্য শান্তা দত্ত-সহ সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য প্রশাসনের কঠোর পরামর্শকে যে সাহসিকতার সঙ্গে উপেক্ষা করেছেন তা ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁরা রাজ্যের সর্বস্তরের আমলাদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। দেখালেন, নীতি-আদর্শে অবিচল থেকে কর্মক্ষেত্রে ঋজু শিরদাঁড়া নিয়ে মাথা উঁচু করে কাজ করা যায়।

কর্মকর্তারা যদি শান্তা দত্ত এবং তাঁর সহযোগীদের দেখানো পথে প্রশাসনিক কাজে নিজেদের উদ্বুদ্ধ করেন তা হলে কিন্তু বাংলার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার সম্ভব।

জয়ন্ত তপাদার, রহড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

অনুল্লেখ কেন

অশোক মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ (৩০-৮) পড়ে একটি প্রশ্ন জেগে উঠছে মনে। লেখকের অভিনয়ের গুণ, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সম্মান করি। তবুও বলি, উনি যাঁদেরই নাম উল্লেখ করেছেন প্রত্যেকের প্রসঙ্গই যথাযথ মনে হয়েছে, অথচ লেখায় শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের অনুল্লেখ বিস্মিত করল।

তপন মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৩৬

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

mahatma gandhi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy