E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: কোনটা দেশপ্রেম

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৫ ০৬:৩১

রোহন ইসলামের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ (১০-৫) উত্তর-সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে এই চিঠি। প্রবন্ধকার আমাদের মতো অনেকের না বলা ভয় ও ভাবনাগুলো স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছেন। সময়টা ১৯৬৪-৬৫। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে। এক রাতে আমার সরকারি অফিসার কাকাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে প্রায় দশ মাস আটকে রাখে। কাকা গানবাজনা ও লেখালিখি নিয়ে থাকতেন। ধর্ম বিষয়ে তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। তবুও কাকা মুসলিম বলে পাকিস্তানের চরবৃত্তি করতে পারেন, এই সন্দেহে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ রকম একটা দমবন্ধ করা পরিবেশে, অপরিসর গণ্ডির মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুকন্যাটি নিজে থেকেই বুঝে যায় তার সীমাবদ্ধতা। সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক— এমনটা মেনে নিয়েই সে একাধিক বার হেনস্থা হয়েও অন্যদের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা করে বড় হয়। নিজের দেশ, সংস্কৃতিকে নিজের জেনে ভালবেসেও তা অনেককেই বিশ্বাস করাতে পারে না। কোথাও কোনও অঘটন ঘটলেই তাদের কাঠগড়ায় তোলা হয়। কটূক্তি শুনেও চুপ থাকতে হয়। দাড়ি, টুপি থাকলে তো কথাই নেই। এই আচরণ যারা করে থাকে তারা আর যা-ই হোক, কোনও দিন দেশপ্রেমিক হতে পারে না। এগুলো তাদের জাতিগত বিদ্বেষ ও আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ। অবশ্যই সবাই এ রকম নন। তাই বহু মানুষের থেকে পেয়েছি সম্মান ও ভালবাসা। দিয়েছিও উজাড় করে।

রোশেনারা খান, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

আশা এখনও

রোহন ইসলামের ‘জন্মই আমার আজন্মের পাপ’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। আমরা অনেকেই কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি অবশ্যই এবং বর্তমানে তা ক্রমবর্ধমান। তবে আমার ছেলেবেলার স্মৃতি অত্যন্ত সুখের। স্কুলের বন্ধুর বিধবা ঠাকুমার খাটে বসে অনেক সময় কাটিয়েছি। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য হস্টেলে। রুমমেট ছিল নবদ্বীপের নিরামিষাশী হিন্দু বান্ধবী, যার বিয়ে উপলক্ষে ওদের বাড়িতে কাটিয়ে এসেছি কিছু দিন। বাড়ির লোকের আচরণ একটুও অন্য রকম মনে হয়নি। কোনও কারণে এক বার খুব অল্প সময়ে মেস বদলাতে হবে। বন্ধু রুপালি, দীপিকা একটা ঘর দেখে এসেও শেষ পর্যন্ত গেল না, কেননা আমাকে ছেড়ে যেতে হবে যে! মুসলিমকে ভাড়া দেবেন না মালিক। অন্য একটা মেস ঠিক হল, যেখানে দুটো খাট জোড়া দিয়ে তিন জন থাকতে হবে। তাই থেকেছি। আজ যখন চার পাশে এত ঘৃণাভাষণ শুনি, মনে হয়, এরা তো আমার মতো ছেলেবেলা পায়নি। বর্তমানে হস্টেলনিবাসী কন্যার কলেজের অনুষ্ঠানের ভিডিয়োতে দেখি, মেয়ে আবৃত্তি করছে দেবেশ ঠাকুরের ‘ভারতবর্ষ’। মেয়ে বলছে, “মা, বন্ধুরা খুব প্রশংসা করেছে।” আশা তা হলে এখনও আছে।

শামিমা রশীদ, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

মূল প্রশ্ন

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর তুলনায় ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সমাজ অনেক বড়। তবু ছবিটা কাছাকাছি। গত শারদোৎসবে, প্রতিবেশী দেশে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল তছনছ করে, প্রতিমা এবং একের পর এক হিন্দু মন্দির ভেঙে উল্লাসপর্বে মেতে উঠতে দেখেছি মৌলবাদীদের। আর এ বারে, খাস কলকাতার এক স্কুলের পরিচিত শিক্ষকের কাছে শোনা, স্কুলের সংখ্যালঘু ছাত্র-ছাত্রীরা সরস্বতী পুজোয় অংশগ্রহণে রাজি হয়নি। প্রশ্ন করলে জবাব মিলেছে, “বাড়ি থেকে না করেছে।”

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কখনওই এক দিক দিয়ে আসে না। মুর্শিদাবাদ বা পহেলগামে দেখা গেল, কী ভাবে ইসলামি ধর্মান্ধতাও বিরাট বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “যে-দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনো বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে-দেশ হতভাগ্য। সে-দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে-বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটেকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি। যে-দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি সে-দেশকে বাঁচাতে পারে।” (‘হিন্দু মুসলমান’)। রবীন্দ্রনাথ প্রধানত আঙুল তুলেছিলেন হিন্দুদের দিকে, তাদের ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য। “হিন্দুর কুয়ো থেকে মুসলমানে জল তুললে তাতে জল অপবিত্র করে। এটা বিষম মুশকিলের কথা। কেননা, পবিত্রতা হল আধ্যাত্মিক রাজ্যের আর কুয়োর জলটা হল বস্তুরাজ্যের। যদি বলা যেত, মুসলমানকে ঘৃণা করলে মন অপবিত্র হয় তা হলে সে কথা বোঝা যেত; কেননা, সেটা আধ্যাত্মিক মহলের কথা। কিন্তু মুসলমানের ঘড়ার মধ্যে অপবিত্রতা আছে বললে তর্কের সীমানাগত জিনিসকে তর্কের সীমানার বাইরে নিয়ে গিয়ে বুদ্ধিকে ফাঁকি দেওয়া হয়” (‘শিক্ষার মিলন’)। বহু দশক ধরেই এই দেশে হিন্দু এবং মুসলমান পাশাপাশি বসবাসকারী। দুই সমাজের মধ্যে সর্বত্রই শত্রুতা বিরাজ করে না। ধর্ম-বিষয়ক বিভাজন ততটা গভীর নয় যে সকল হিন্দুই মুসলমানদের হেয় করেন, কিংবা উল্টোটা। আসল বিভাজন সৃষ্টি করেন— ধর্মান্ধ, ধান্দাবাজ রাজনীতিবিদরা।

আমার মায়ের চরম অসুস্থতার সময় দু’জন সহায়িকা দিন-রাত থাকতেন পাশে। এক জন মুসলিম সম্প্রদায়ের। প্রথম দিন কাজে যোগ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, “দাদা, আমি কিন্তু মুসলিম। মাসিমার ঠাকুর আছেন ঘরে। আপনাদের অসুবিধে হবে না তো?” দু’বছর তিনি যে যত্নআত্তি করেছেন মাকে, ভুলব কী করে? ফ্ল্যাটের বারান্দায় শেড লাগাব। চার জন মিস্ত্রি এলেন, তিন জনই মুসলিম। “জল পেতে পারি দাদা? যা গরম!” কেউ কি পারেন, জল না দিতে, ধর্মপরিচয়ের কারণে?

শেষ অবধি তো প্রশ্নটি মানবাধিকারের, সহমর্মিতার এবং শিক্ষার— যে কথা রবীন্দ্রনাথ পইপই করে বলেছেন।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫

অলীক ধারণা

ব্যক্তির অস্তিত্ব ও বিকাশ চিরকাল সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রনির্ভর। কোথাও আবার এই তিন উপাদানকে একত্র করা হয়। তখন পড়ে থাকে শুধু সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ সত্তা। রোহন ইসলাম ভারতে যে অস্তিত্ব-সঙ্কটের কথা লিখেছেন, সেই একই রকম অবস্থায় থাকেন বাংলাদেশের হিন্দু, মায়ানমারের রোহিঙ্গা ও তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়। মধ্যযুগ জানে, প্রায় তিনশো বছরের ক্রুসেড-এর ইতিহাস। তখনও মানবতা অধরা ছিল নিরপেক্ষ অবস্থানকারীদের। ভারত যত বার বিদেশি শাসকদের কব্জায় থেকেছে, প্রতি বার বিধ্বস্ত হয়েছে মানবতা। কাজেই প্রবন্ধকার সান্ত্বনা পেতে পারেন এই ভেবে যে ‘মানবতা’ হয়তো সত্যিই একটি অলীক ধারণা।

সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা-৯১

সহমত নই

রোহন ইসলাম তাঁর প্রাণের কথা সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করেছেন। ভারতের অহিংস ও অসাম্প্রদায়িক চেহারাটিকে নষ্ট করে রাজনৈতিক জাঁতাকল আমাদের সর্বনাশের পথ সুগম করে দিয়েছে। ভারতে কেবল নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের বাস নয়, নানা জাতির সহাবস্থান। তিনি সত্যই বলেছেন যে, আমরা, এ দেশের সাধারণ মুসলমানেরা চাই আলো— যে আলোয় আমাদের পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।

আমরা যারা সংখ্যাগুরু, আমরা মানুষ হিসেবে ভীষণ ভাবে লজ্জিত! তবে, সতর্কের খাতিরে এও কি বলা চলে না যে এ দেশের মুসলিমরা এমনিতে নিরাপদ পরিস্থিতিতেই থাকে। তাদের চলাফেরা আটকানো হয় না। ব্যতিক্রম সামান্যই। তুলনায়, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর যে ফারাক বাংলাদেশ এখন দেখাতে শুরু করেছে, অত্যাচার লুণ্ঠন খুন আগুন রাহাজানি, তাতে ভারতের সঙ্গে এখনও তফাত স্পষ্ট।

বিবেকানন্দ চৌধুরী, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy