E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু:সম্বোধনের ঘোরপ্যাঁচ

প্রবীণ নাগরিককে অপেক্ষাকৃত কমবয়সি ডাক্তারবাবু যেমন স্বচ্ছন্দে ‘তুমি’ বলছেন, তেমনই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীদের ‘তুই’ বলছেন।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৫ ০৫:৪৩

জহর সরকারের ‘আপনি তুমি তুই...’ (২২-৬) প্রবন্ধটি কৌতূহলোদ্দীপক। আজকের সময়ের ‘ফাংশনাল কমিউনিকেটিভ অ্যাপ্রোচ’ (ব্যবহারিক কথ্যভঙ্গি)-এর প্রচলিত ধরনটি তাঁর লেখায় ছায়া ফেলেছে। প্রবীণ নাগরিককে অপেক্ষাকৃত কমবয়সি ডাক্তারবাবু যেমন স্বচ্ছন্দে ‘তুমি’ বলছেন, তেমনই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীদের ‘তুই’ বলছেন। অন্য দিকে, বিদেশ-ফেরত শিক্ষক ‘তুমি’ বলছেন তাঁর ছাত্রছাত্রীদের। রেলের টিকিটপরীক্ষক কমবয়সি যাত্রীদের ‘আপনি’ বলছেন। বাজারের আনাজ বিক্রেতা কিংবা কাজের মাসিমাকে এক-এক মানুষ এক-এক রকম সম্বোধন এবং সেই সূত্রে ক্রিয়াপদ সংযুক্ত করছেন।

কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলের কথা বলতে গিয়ে লেখক জানিয়েছেন, সম্বোধনকারী ব্যক্তির পারিবারিক শিক্ষা, আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক সংযোগ প্রভৃতি উক্ত ব্যক্তির সম্বোধন ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। বিষয়টি সম্পর্কে দ্বিমত নেই। আর সহমত পোষণ করতেই হয় যে বাণিজ্যিক সিনেমার নাম ও গানগুলোর ক্ষেত্রে ‘তু, তুম, আপ’ প্রভৃতির হালকা অসতর্ক কাব্যিক প্রয়োগও একটু কানে লাগে।

এক সময় যখন দেশের লোকসংখ্যা অনেক কম ছিল, যেখানকার মানুষ সেখানেই মূলত থিতু হতেন। শিক্ষার হার কম, ভাষা সম্পর্কে সচেতনতাও তেমন নেই। আঞ্চলিকতা বুকে নিয়েই যে যার মতো থাকা যেত। পরে যখন এক জায়গার মানুষ অন্য জায়গায় নানা উদ্দেশ্যে গিয়ে বসবাস শুরু করলেন, তাঁরা একে অপরকে কোনও সুনির্দিষ্ট সম্বোধনে যেমন ধরতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, তেমনই সর্বনাম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। কথার ধরন ‘কলকাত্তাইয়া’ না ‘ঢাকাইয়া’ হবে, না অন্য রকম, তা ঠিক করতে করতে মিশ্র ভাষাভাষীর মানুষজন আজও ঘুরপাক খেতে খেতে ছুটে চলেছেন। সম্বোধনের ব্যবহারিক রূপই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

শান্তি প্রামাণিক, হাওড়া

মনজাগানিয়া

এখনকার বাঙালির মুখের ভাষার ধরনধারণ নিয়ে ‘আপনি তুমি তুই...’ শিরোনামের মনজাগানিয়া লেখাটির জন্য জহর সরকারকে কৃতজ্ঞতা। ছোটবেলায় ঘরের চাষের কাজের বয়োজ্যেষ্ঠ লোকজনকে আমরা ‘তুই’ বলতাম। আমাদের শেখায় ভুল ছিল। বড় হয়ে এ দোষ শুধরে নিয়েছি। মধ্যযুগের সরল এক মাঝি ভদ্রঘরের বৌকে শুধিয়েছিলেন, “কে বট আপনি?” তাঁর‌ শিক্ষায় ভুল ছিল, মানসিকতায় দোষ ছিল না। মঙ্গলকাব্যের সেই ঈশ্বরী পাটনী ‘আপনি’ই বলতে চেয়েছিলেন, ‘বট’ ক্রিয়ার সম্ভ্রমসূচক রূপটি তাঁর অজানা ছিল।

এই তো সে দিন, নব্ব‌ই বছর ছুঁইছুঁই আমার জ্যাঠাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। জ্যাঠামশাই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, ঈষৎ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তাঁর চাইতে প্রায় ত্রিশ বছরের ছোট চিকিৎসককে জ্যাঠা ‘আপনি’ সম্বোধন করলেও, ডাক্তারের মুখে “তুমি এখন কেমন আছো?” বেমানান লেগেছিল। সবাই যে এ রকম তা যেমন বলা ভুল হবে, তেমনই আরও অনেকেই এ রকম। উঁচু পদে থাকলে, টাকাকড়ি তুলনায় বেশি থাকলে, লোকবল থাকলে, গায়ে জোর বেশি কিংবা হাতে অস্ত্র থাকলে সামনের মানুষটিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে গর্ব অনুভব করা বেশ কিছু জনের স্বভাব বা অভ্যাস। আমি নিজে হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতে গিয়ে নিচু ক্লাসের কোনও কোনও শিক্ষার্থীর মুখে শুনি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি ‘তুমি’ করে কথা বলছে। ওরা ওই মঙ্গলকাব্যের ঈশ্বরী পাটনীর মতো। ওদের ভুল আছে, দোষ নেই। ওদের পরিবারে বা পাড়ায় ‘আপনি’ শোনেইনি যে ওরা। ভুল শুধরোতে ওই সব বাচ্চার সঙ্গে আমি ‘আপনি’ করেই কথা বলি। কয়েক দিন পরেই ওরা দিব্যি ‘আপনি’তে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

কিন্তু যাঁরা জেনেশুনেও আপনি-র জায়গায় তুই-তুমি করেন, তাঁদের ভাষার কি সংশোধন হবে? এ ক্ষেত্রেও একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখনও গায়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ধ ছিল। একটি বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে এক অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়ী ‘তুই’ দিয়ে কথা বললেন। সে দিন শুধু জানতে চেয়েছিলাম যে আমিও তাঁর সঙ্গে ‘তুই’ করে কথা বলব কি না! বেশ কাজ হয়েছিল তাতে— ধনগর্বীর ভাষাবদল হয়েছিল দ্রুত।

মনোজ ভট্টাচার্য, উত্তর প্রতাপ বাগান, বাঁকুড়া

অন্যান্য কারণ

বাংলা ভাষায় আপনি থেকে এই যে তুমিতে বিবর্তন, আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে এর নেপথ্যে আরও একটি কারণ আছে। সেটি শ্রেণিগত। দীর্ঘকাল ধরে ভদ্রলোক শ্রেণি শ্রমজীবী মানুষকে ‘তুই’ বলতে অভ্যস্ত ছিল। এখনও বহু মানুষ আনাজ বিক্রেতা, ভ্যানওয়ালা, রাজমিস্ত্রি অথবা বিভিন্ন পেশার মানুষকে নির্দ্বিধায় তুই বলেন। তাঁরা কিন্তু অপর দিকের মানুষটিকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করে এসেছেন। কিন্তু কবে থেকে যেন তাঁরা অপর দিকের মানুষটিকেও ‘তুমি’ বলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। বেশ কিছু বছর ধরে বাসের কন্ডাক্টররা যাত্রীকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেন। এ ভাবেই মাছ বিক্রেতা, মিস্ত্রি-সহ বহু শ্রমজীবী মানুষ ক্রেতাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেন। আমার মনে হয়েছে, দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার শেষে এটি তাঁদের এক মধুর প্রতিক্রিয়া।

দেবব্রত ঘোষ মলয়, বাকসাড়া, হাওড়া

ভাষার খিচুড়ি

জহর সরকারের ‘আপনি তুমি তুই...’ পড়ে অধুনা বাংলা ভাষায় আর একটি শব্দের ব্যবহারের ভিন্নতা প্রসঙ্গে কিছু কথা। আজকাল দেখছি ‘এসো’ শব্দের প্রয়োগের পরিবর্তে ‘আসো’ ব্যবহার করা হচ্ছে। যা এত দিন ছিল, ‘এখানে এসো’, হয়ে যাচ্ছে ‘এখানে আসো’। আমরা তো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ ‘আসো’ শব্দটি এল কোথা থেকে? মান্য বাংলা ভাষায় ‘আসো’ শব্দের ব্যবহার আছে, কিন্তু তার ব্যাকরণগত তাৎপর্য অন্য। যেমন— “তুমি কি এখানে রোজ আসো?” ‘আসো’ এবং ‘এসো’-র এই জগাখিচুড়িটি নিয়ে এ বার সচেতনতা প্রয়োজন।

সুমিতা চক্রবর্তী, কলকাতা-৬৭

‘তুই যে আমার’

সুদূর অতীতে প্রেমে পড়লে তরুণ-তরুণীরা পরস্পরকে আপনি-র বদলে তুমি সম্বোধন করতেন। অদূর অতীতে প্রেমঘটিত কারণে তুই থেকে তুমিতে উত্তীর্ণ হত সম্বোধন। ইদানীং দেখি, প্রেমিক-প্রেমিকা তো বটেই, স্বামী-স্ত্রীও পরস্পরকে তুই সম্বোধন করেন। লেখক জহর সরকারের তাতে কিঞ্চিৎ আপত্তি থাকলেও আমার তো এই সম্বোধনের রীতিটি বেশ লাগে। মনে হয়, বন্ধুত্বের সম্পর্কটি অটুট রয়েছে। ভাল থাকতে আর কী চাই?

সুহাসিনী ইসলাম, কলকাতা-৫৫

গন্ধবিচার

সিদ্ধার্থ মজুমদারের ‘যেমন করে গন্ধ বুঝি’ (১৪-৬) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্র। কিছু গন্ধ আমাদের স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে আবার কিছু গন্ধ আমাদের মানসিক অবস্থাকেও প্রভাবিত করতে পারে। গন্ধ আমাদের চার পাশের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করে। গ্যাস সিলিন্ডারের গন্ধ বা কোনও কারখানা থেকে গ্যাসের গন্ধ পেলে আমাদের নিরাপত্তা এবং সতর্কতার অনুভূতিও এনে দেয়। বিভিন্ন পশু-পাখিও তাদের খাদ্য সংগ্রহ বা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেয় এই গন্ধের সাহায্যে। সব মিলিয়ে গন্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই উপলব্ধি ও সচেতনতা বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা বা একটি দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালন করা হলেও আমাদের দেশে সেই ভাবে বিশেষ কিছু করা হয় না।

তমাল মুখোপাধ্যায়, ডানকুনি, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Address Communication

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy