মোহিত রায়ের ‘একলা চলো রে?’ (১৬-৭) শীর্ষক উত্তর-সম্পাদকীয় সম্বন্ধে দু’চার কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলাম। আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে চিরকাল ভারতের এমন নিঃসঙ্গ অবস্থা ছিল না। একটা সময় ভারতের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক পারদর্শিতা সমগ্র বিশ্বে সমীহ আদায় করেছিল। বিশেষত, ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের থেকে আলাদা করে দেওয়ার পরে এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও বিধিনিষেধ উড়িয়ে ১৯৭৪ সালে পোখরানে ঐতিহাসিক পরমাণু বিস্ফোরণের পরে বিশ্বের দরবারে বিশেষ সম্মান লাভ করেছিল ভারত। তা হলে আজ তার এমন কোণঠাসা অবস্থা?
বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে সমানে-সমানে টক্কর দিতে গেলে তার আগে নিজের জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে হয়। অবশ্য এটাও ঠিক, কোনও কাজ তত্ত্বগত ভাবে বলা আর সেটা বাস্তবে করার মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য থাকে। তাই কূটনীতির মঞ্চে অতি সাবধানে কৌশলী পদক্ষেপ করতে হয়। কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত কিংবা অবিবেচনামূলক মন্তব্য দীর্ঘ দিনের বন্ধুকে বিরাগভাজন করে দিতে পারে। প্রতিবেশী ছোট বা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হলেও তাকে অবহেলা বা তাচ্ছিল্যর চোখে দেখলে, প্রাপ্য সম্মান না দিলে সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শ্রীলঙ্কা, নেপাল ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র, তা হলেও ভারতের তরফে এমন কোনও নীতিগত ভুল হয়নি তো যে সবাই এক সঙ্গে বিগড়ে গেল? বিশেষত, চিনের মতো শক্তিশালী ও আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে গেলে অন্যান্য কাছের দেশের বন্ধুত্ব অত্যন্ত প্রয়োজন। তবে আশার কথা, সামান্য হলেও মলদ্বীপের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করছে।
প্রবন্ধকার কয়েক বার ‘ভারতের সনাতনী রাজনীতি’, ‘ভারতীয় সনাতনী সংস্কৃতি’-র কথা উল্লেখ করেছেন। সনাতনী সংস্কৃতি বলতে খুব সম্ভবত উনি ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু সংস্কৃতির কথা বলতে চেয়েছেন। মুশকিল হল, এই একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই জন্ম দেয় বিভেদের। ভারতের মতো এমন বৈচিত্রপূর্ণ দেশে সংখ্যাগুরুর নামে এক বিশেষ সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে, তা দেশের ঐক্যকেই বিপন্ন করে। রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে জনসাধারণের উপর বিচ্ছিন্নতাবাদ চাপিয়ে দেওয়া যায়, প্রশাসনের সাহায্যে বলপ্রয়োগ করে দেশের মানুষকে দমিয়ে রাখা যায়, কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহলে নিজেকেই বিচ্ছিন্ন হতে হয়। আর তখনই ‘একলা চলা’-র পরিস্থিতি তৈরি হয়।
সুললিত ভাষণে যেমন চিঁড়ে ভেজে না, তেমনই শুধু আলিঙ্গনেও কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় না। অবিশ্বাস্য যে, কূটনৈতিক লড়াইয়ে পাকিস্তান এখন ভারতের থেকে অনেক পাকাপোক্ত জায়গায় আছে। রাষ্ট্রপুঞ্জে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কমিটির সহ-সভাপতি হয়েছে। ভারতের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার পাকিস্তানকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। তবে ভারতের ক্রমাগত চেষ্টায় এক দিন অবশ্যই অবস্থার উন্নতি হবে। অন্ধকারের শেষে নিশ্চয়ই আলোর রেখা আছে। আমরা আপাতত সেই আশাতেই থাকি।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
অনিবার্য
কিছু দিন ধরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশনের আপ লাইনের ফাটল বা প্ল্যাটফর্মের বসে যাওয়া নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। আমি এই অঞ্চল থেকে ১১০ নম্বর ওয়র্ডের তিন দফার পুর-প্রতিনিধিত্ব করছি। অতএব এই বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা আছে।
কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশনের অবস্থান যে ‘বৈষ্ণবঘাটা পাটুলি উপনগরী’তে, তা গড়ে উঠেছে ৩০০ একর ধানজমির উপরে। ওই ধানজমি থেকেই ৫১ একর জলাশয় খনন করে নিচু ধানজমি উঁচু করা হয়েছিল। আজ সেখানেই ইএম বাইপাস, সার্ভিস রোড, বাড়ি, বহুতল— সবই হয়েছে। উপনগরী গঠনের পরিকল্পনা হয়েছিল রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলে। কিন্তু কংগ্রেস সরকার কাজ শুরু করতে পারেনি। কারণ, তারা এই জমি অধিগ্রহণের জন্যে জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের অর্থ বরাদ্দ করলেও ভাগচাষি, খেতমজুরদের জন্য কিছুই করতে রাজি হয়নি।
সমস্যার নিষ্পত্তি হয় বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর। তখন প্রশাসনিক সহযোগিতায় ১৯৫টি জীবিকাচ্যুত ভাগচাষি-খেতমজুর পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধান করা হয়। আলোচনার একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এঁদের মধ্যে থেকে ৫০ জনকে নিয়ে বৃজি-পাটুলি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি গড়া হয় ১৯৮০ সালে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন মাছ চাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি থেকে মাছ চাষের পাশাপাশি হাঁস, ছাগল পালন, নৌ-বিহারের ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছিল। সদস্য ও সমবায়ের অংশীদার ছিলেন সমবায়ের শ্রমদাতা কর্মীরা। তাঁরা ধীরে ধীরে আর্থিক ভাবে কিছুটা সচ্ছল হয়ে উঠতে থাকেন। সমবায়ের এই উন্নয়ন সেখানকার বাসিন্দাদের একাংশের পছন্দ ছিল না। তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দল তৃণমূল এর পূর্ণ সুযোগ নেয়।
মূলত তাঁদের উদ্যোগেই এই সমবায়ের লিজ় নেওয়া জলাভূমি তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে অধিগ্রহণ করানো হয়। মৎস্য সমবায়ের পক্ষ থেকে এই সময়ে বার বার বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল এবং পশ্চিমবঙ্গ মৎস্যজীবী সমিতি থেকেও চেষ্টা করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই প্রস্তাব ছিল, মেট্রো রেল শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে সরাসরি গড়িয়া স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করা হোক।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সমস্ত পরামর্শ অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। মূলত মাটির সমস্যাই এর অন্যতম কারণ। সেই দিন সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সমবায়ের মতামত গ্রহণ করা হলে আজ এই পরিণতি হত না। এই স্টেশন বন্ধ হওয়ার ফলে নিত্যযাত্রীদের যে হয়রানির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা হয়তো ঘটত না।
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
হার-জিত নয়
আকাশ বিশ্বাসের ‘জিতে গেলেন ভবানীচরণ?’ (১০-৭) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জানাই যে, রামমোহনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদের মধ্যেও ভবানীচরণ সমকালীন সমাজের অধঃপতনের বাস্তবচিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে মানুষকে পাপাচার থেকে সংযত করতে চেয়েছিলেন। ভবানীচরণের ‘ধর্মসভা’-কেন্দ্রিক রামমোহন-বিরোধী আন্দোলন আজকে হাস্যকর মনে হলেও সমকালে তা বিপুল সাড়া ফেলেছিল। অধিকাংশ হিন্দুই সে দিন ‘চন্দ্রিকা’-র সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ভবানীচরণ রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থী চিন্তাধারার বাহক হলেও ধর্মের নামে কুৎসিত আমোদ-প্রমোদ এবং অশ্লীল ক্রিয়াকলাপকে কখনও সমর্থন করেননি। রামমোহন বিরুদ্ধতায় অবতীর্ণ হওয়ার আগেই শ্রীরামপুর মিশনের সমাচার দর্পণ-এ প্রকাশিত ‘শৌকীন বাবু’, ‘বৃদ্ধের বিবাহ’ প্রভৃতি রচনায় তিনি সামাজিক ও ধর্মীয় ত্রুটি-বিচ্যুতিকে তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন। সেই সঙ্গে কাহিনি শেষে উপদেশের মাধ্যমে সমাজ-সংশোধনের বার্তা দিয়েছিলেন। আবার শাস্ত্রমতে লোকচরিত্র গঠনের প্রয়াসও লক্ষ করা গেছে তাঁর মধ্যে। মানুষের মধ্যে উত্তম ও উৎকৃষ্ট বোধশক্তি গড়ে তোলার জন্য তিনি হিতোপদেশ-এর স্বকৃত বঙ্গানুবাদ করেন।
তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এক নিরাসক্ত শিল্পীর দৃষ্টিতে সমাজের ক্লেদ-গ্লানিকে তুলে ধরে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে তিনি সমাজপতিদের কুকীর্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করে তাঁদের তথাকথিত ভব্যতার মুখোশ খুলে দিয়ে এক অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কাজেই মনে হয়, আজকের সমাজ-প্রেক্ষাপটে তাঁর মূল্যায়ন এবং ধর্ষণের মতো এক সামাজিক ব্যাধি প্রসঙ্গে মানবপ্রেমিক ভবানীচরণের ‘জেতা’ বা ‘হারা’-র প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক।
সুদেব মাল, তিসা, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)