ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী ধারার তিন মহান নেতার নাম অমর অক্ষরে খোদাই হয়ে আছে। তাঁরা হলেন— অবিভক্ত পঞ্জাবের লালা লাজপত রাই (ছবিতে বাঁ দিকে), মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর টিলক (মাঝে) এবং অবিভক্ত বাংলার বিপিনচন্দ্র পাল (ডান দিকে)। ভারতবাসী এই ত্রয়ীকে স্মরণ করে আসছেন ‘লাল-বাল-পাল’ নামে। দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে এঁদের ত্যাগ, সাহস, ও চিন্তাধারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিকে দৃঢ় করেছিল এবং তরুণ প্রজন্মের রক্তে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়েছিল। আজ যখন আমরা স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের সুফল ভোগ করছি, তখন এই মহান ব্যক্তিদের অবদান স্মরণ করা কেবল ইতিহাসের পর্যালোচনা নয়, বরং জাতীয় কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। বালগঙ্গাধর টিলক ও লালা লাজপত রাইয়ের স্মৃতিকে অমর রাখার উদ্দেশ্যে দেশের নানা প্রান্তে তাঁদের নামে রাস্তা, চত্বর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নামকরণ হয়েছে— যা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
অথচ, বিপিনচন্দ্র পাল, যিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, সাংবাদিক, বক্তা ও নির্ভীক স্বাধীনতা সংগ্রামী, তাঁর স্মৃতির যথাযথ মর্যাদা আজও আমাদের রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেবল রাজনীতির মঞ্চে নয়, তিনি তাঁর কলম ও চিন্তাশক্তির মাধ্যমে সমগ্র ভারতীয় জাতিকে আত্মমর্যাদা ও আত্মনির্ভরতার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এমন এক জনের স্মরণে কলকাতার মতো ঐতিহ্যবাহী শহরে কোনও উল্লেখযোগ্য স্থানের নাম না থাকা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক।
সম্প্রতি কলকাতা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ভারতের মহান সন্তানদের স্মৃতিরক্ষার্থে একাধিক স্টেশনের নামকরণ করে যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে, কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, গড়িয়া থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চলমান মেট্রো প্রকল্পের অন্তর্গত কোনও একটি স্টেশন যেন মহান দেশভক্ত বিপিনচন্দ্র পাল-এর নামে নামকরণ করা হয়। এই উদ্যোগ বাংলা তথা সমগ্ৰ ভারতের মানুষের কাছে গৌরবের বিষয় হবে।
ধীমান ভট্টাচার্য, কলকাতা-১৩৪
ক্ষমতা সীমিত
সিদ্ধার্থ মজুমদারের ‘এআই কি চিন্তা করতে পারে’ (৪-১০) শীর্ষক প্রবন্ধের শিরোনামে শোভিত প্রশ্নটি আজকের প্রযুক্তি-নির্ভর বিশ্বে একটি বিরাট প্রশ্ন। এর উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে প্রথম যে চিন্তাটি মানুষের মস্তিষ্ককে গ্রাস করছে, তা হল, সৃষ্টি স্রষ্টার চেয়ে শক্তিশালী হবে না তো? আবার এর উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ ভেবে নেওয়ার পরে যে দুশ্চিন্তাটা মানুষকে পীড়া দিচ্ছে তা হল, ‘তখন মানবজাতির ভবিষ্যৎটাই বা কেমন হবে? এই বসুন্ধরায় তার কি আর কোনও প্ৰয়োজনই থাকবে না?’ এই সব জটিল আলোচনায় যাওয়ার আগে এক বার জেনে নেওয়া যাক, ‘এআই’ বা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ জিনিসটা কী। সার্চ ইঞ্জিনে এই প্রশ্নটা রাখলে জানা যায়, এআই হল এমন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা মানুষের সহজাত বুদ্ধি, যেমন— শেখা, যুক্তি তৈরি করা, সমস্যা সমাধান করা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কাজগুলো কম্পিউটার বা মেশিনের মাধ্যমে অনুকরণ করে। বলা বাহুল্য, এর সুফল মিললেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, এই প্রযুক্তি হয় মানুষকে বিপদে ফেলেছে, নয়তো এর প্রয়োগে মিলেছে উল্টো ফল। যেমন, আমেরিকার এক মহিলা একটি এআই অ্যাপের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, সেটি তাঁর সন্তানকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছিল। শুধু তা-ই নয়, আমেরিকারই আইনি ব্যবস্থায় ‘কম্পাস’ সফটওয়্যারের ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, সেটি শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের অপরাধ প্রবণতার বিষয়ে অনেক বেশি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। তাই মানুষের ক্ষমতার সঙ্গে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র ক্ষমতার তুলনা টেনে প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, মানুষের ক্ষেত্রে অপরিহার্য রকম জরুরি ‘কমন সেন্স’ সাধারণ ও স্বভাবসিদ্ধ এক ক্ষমতা হলেও, আধুনিক এআই-এর ক্ষেত্রে ‘কমন সেন্স’ জাতীয় স্বজ্ঞাভিত্তিক যুক্তিবোধ বা বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষমতা আরোপ বা অর্জন অসম্ভব।
এআই-এর সব কিছুই সমীকরণ বা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন-ভিত্তিক। তার সমস্ত সৃষ্টি করার ক্ষমতাই একটা গাণিতিক হিসাবের উপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞান বা গণিতের কোনও জটিল সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে মানুষের আগে এআই-এর সাফল্য পাওয়াটা তাই হয়তো অসম্ভবও কিছু নয়। কিন্তু, কোনও অজানা প্রশ্ন বা হঠাৎ অপরিকল্পিত ভাবে কোনও সমস্যার উদয় হলে, মানুষ তার স্বাভাবিক বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা ব্যবহার করে সমাধানের চেষ্টা করতে পারলেও, পূর্ব-প্রদত্ত নির্দেশের অনুপস্থিতিতে এআই’কে সেখানে জড়ভরত হয়েই থাকতে হবে। পাবলো পিকাসোর অঙ্কনশৈলীর প্রয়োগ ঘটিয়ে কোনও কিছু এঁকে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হলেও নতুন কোনও শিল্পরূপ আবিষ্কার করার ক্ষমতা এআই-এর একেবারেই নেই।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
এআই প্রভাব
‘দুনিয়া ডায়েরি’ বিভাগে (৫-১০) ‘ট্রামের বুদ্ধি’ শীর্ষক খবরের শেষ লাইনে এসে আটকে গেলাম। লেখাটির শেষে বলা হয়েছে— ‘গত শতকে এআই এলে হয়তো বেঁচে যেত সহস্র কবিতা’। এই বাক্যে বোঝা গেল কিছু শ্লেষ এবং কিছু ব্যঙ্গ মেশানো রয়েছে। এখন কৃত্রিম মেধায় যেমন স্বয়ংক্রিয় ট্রামযাত্রা শুরু হচ্ছে তেমনই আগামী দিনে ড্রাইভারহীন ট্রেনযাত্রাও শুরু হবে। আবার অসুন্দর অবয়বকে এআই মুহূর্তে সুন্দর করে দিচ্ছে। অন্য দিকে, অর্থনৈতিক শঠতায় মানুষ বিপন্নও হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল, কবিতা প্রসঙ্গটা হঠাৎ করে কেন টানা হল? তা হলে কি ধরে নিতে হবে এর পরে কবিরা নিজস্ব মৌলিক কবিতা, চিন্তা ভাবনা স্বখাত সলিলে দিয়ে এআই-এর সাহায্য নিয়ে উচ্চমার্গের কবিতা লিখবেন? মৌলিক বিষয় বলে আর কিছু থাকবে না, এটা ধরে নিয়েই আমরা স্ব-অস্তিত্ব ক্রমশ বিপন্ন করব?
শ্যামলজিৎ সাহা, চুঁচুড়া, হুগলি
খাদানে মৃত্যু
বীরভূমের নলহাটির বাহাদুরপুরে পাথর খাদানে নিয়মবহির্ভূত ভাবে পাথর তোলার কাজ করতে গিয়ে ধসে প্রাণহানি ঘটল ছ’জন হতভাগ্য গরিব শ্রমিকের। পরে হাসপাতালে আরও এক গুরুতর আহত শ্রমিকের মৃত্যুর খবরও উঠে এসেছে। এই বিষয়ে ‘বৈধতার গেরো’ (২৬-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয় বিশ্লেষণটি অত্যন্ত বাস্তবোচিত এবং তাৎপর্যপূর্ণ। খাদানের সাম্প্রতিক ঘটনাটি বেদনাদায়ক হলেও, অপ্রত্যাশিত নয়। ২০২৪ সালেও ওই জেলায় নলহাটির মহিষাগড়িয়া গ্রাম সংলগ্ন পাথর খাদানে ভূমিধসে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিন শ্রমিক। রাতারাতি মুনাফা কামানোর নেশায় এক শ্রেণির প্রভাবশালী খাদান-মালিকের পাথর তোলার কারবারের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি-চক্রের গভীর যোগ। যেমন দেখা যায়, অবৈধ পাথর খাদানগুলি জুড়ে বেআইনি ভাবে গজিয়ে ওঠে বহু সংখ্যক পাথর ভাঙার ক্রাশার কল। পাথর চুরিকে কেন্দ্র করে যে ভয়ানক হিংসাত্মক রাজনৈতিক গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চলেছে, এটা কি তার মোক্ষম প্রমাণ নয়? পাথরের ধুলো-দূষণে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে অসংখ্য দরিদ্র শ্রমিক ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান। তাই তো পাথর খাদান অঞ্চলকে বলা হয় ‘সিলিকোসিসের আঁতুড়ঘর’।
কী ভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় মাটি-জমি-জঙ্গল উৎখাত করে, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে এবং পরিবেশগত যথাযথ ছাড়পত্র ছাড়াই, তৈরি হয় একের পর এক অবৈধ পাথর খাদান? আর এই কাজে প্রাণ বলি দেওয়াই যদি দরিদ্র শ্রমিকশ্রেণির ‘ভবিতব্য’ হয়, তা হলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এর চেয়ে অপদার্থতার পরিচয় আর কী-ই বা হতে পারে? মুষ্টিমেয় মানুষের লোভের কারণে আর কত কাল শ্রমজীবীর জীবনকে এ ভাবে তিলে তিলে ধ্বংস হতে হবে?
পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)