সম্প্রতি সোনাঝুরি মৈত্রের ‘যেন অদৃশ্য দুর্গে বন্দি’ (১৮-৯) প্রবন্ধ বিষয়ে কিছু কথা। এই লেখাটিতে বর্তমান সময়ের সামাজিক ও মানসিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে প্রযুক্তি নির্ভরতা, বিশেষ করে মোবাইল ফোন এবং সমাজমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান প্রভাব অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। এটা খুব সত্যি যে, মানুষ এক অদৃশ্য কারাগারে নিজেকে আটকে ফেলেছে। প্রবীণ থেকে নবীন কিংবা কম শিক্ষিত থেকে বেশি শিক্ষিত, সকলের হাতে হাতে স্মার্টফোন এক জোয়ার নিয়ে এসেছে। এক সময় প্রযুক্তিকে আনা হয়েছিল মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলার জন্য। তবে সহজ হতে হতে ফোন যে মনকে বশ করে নিচ্ছে, তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না বা বুঝতে চাইছি না। সমাজমাধ্যমে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিয়োর মতো আমাদেরও দ্রুত নামতে শুরু করেছে ধৈর্যের মাত্রা। ক্ষণিকের ভিডিয়োর আনন্দ নিতে নিতে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি বাস্তবতা থেকে। নেশার মতো ডুবে থাকছি যন্ত্রটিতে।
প্রবন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে খুব সোজা ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে— এখন আর চোখে দেখা শত্রু নেই। বরং আমাদের চার পাশে অদৃশ্য এক দুর্গ তৈরি হয়েছে। ক্রমাগত দুর্গের প্রাচীর পোক্ত হচ্ছে, ঘিরে ফেলছে ডেটা সংগ্রহ, অ্যালগরিদম, রিচ বাড়ানো, ফলোয়ার-এর মতো শব্দ দিয়ে। আমাদের রুচি, পছন্দ, রাজনৈতিক মতামত পর্যন্ত প্রযুক্তির শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে থাকছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল শিশু-কিশোরদের অবস্থা। বাবা-মা কখনও ছোটদের জেদ মেটাতে, কখনও খাওয়াতে মোবাইলে নানা রকম কার্টুন চালিয়ে দিচ্ছেন। মানসিক চাপ থেকে বা একটানা পড়াশোনা থেকে কিছুটা রেহাই পেতে রিলস-এর ফাঁদে পড়ছে অনেকে। ট্রেনে, বাসে, রাস্তাঘাটে ইতিউতি একটু সময় পেলেই মোবাইল বার করে স্ক্রল করা এখন এক প্রকার ‘ট্রেন্ড’। মনোযোগের ক্ষয়, চোখের উপর বাড়তি চাপ, শারীরিক অবস্থার অবনতি, ঘুমের সমস্যা, স্থূলতা ইত্যাদি নানা রোগের দরজা খুলে দিচ্ছে মুঠোফোন। এ সব এক-এক করে আমাদের সমাজকে এক আসন্ন দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তবে আশার আলো রয়েছে। প্রযুক্তিকে সম্পূর্ণ বন্ধ না করা গেলেও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বা পরিবর্তিত পদ্ধতিতে ব্যবহার অবশ্যই যুক্তিসম্মত। পারিবারিক দিক থেকে সচেতনতা, বই পড়া, লেখালিখি, আঁকা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে গঠনমূলক কাজে ব্যস্ত রাখা কিংবা স্কুল-কলেজে ‘ডিজিটাল লিটারেসি’র প্রসার অত্যন্ত জরুরি। একই ভাবে রাষ্ট্র এবং সমাজেরও দায়িত্ব সহকারে অতিরিক্ত আসক্তি রোধে উপযুক্ত আইনকানুন ও সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে এই দুর্গের প্রাচীর ভেদ করে আমরা সকলে বেরিয়ে আসতে পারি।
অভিজিৎ নন্দী, বাগান্ডা, হুগলি
হারাচ্ছে বিস্ময়
সোনাঝুরি মৈত্রের ‘যেন অদৃশ্য দুর্গে বন্দি’ (১৮-৯) শীর্ষক প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা। তিনি লিখেছেন, আমরা যেন অ্যালগরিদমের দুর্গে বন্দি। নেপালে সেপ্টেম্বর মাসে ঘটিত গণঅভ্যুত্থান ‘জেন জ়ি’ বিক্ষোভ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যদিও ‘জেন জ়ি’রা এ আন্দোলন শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সে দেশের সমস্ত জনগণ। বলা হচ্ছে, ‘জেন জ়ি’রা হচ্ছেন সামাজিক রূপান্তরের চাবিকাঠি। কিন্তু এই ‘জেন জ়ি’রা কতটা প্রভাবিত এই অ্যালগরিদম দ্বারা? ‘জেন জ়ি’, অর্থাৎ আজকের দিনে ১৩ থেকে ২৮ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠা ডিজিটাল যুগে। পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ, প্রেম, বিচ্ছেদ— সব কিছুই ডিজিটাল-নির্ভর। সমাজমাধ্যমের সঙ্গে এই ‘জেন জ়ি’র নাড়ির সম্পর্ক।
‘জেন-এক্স’ প্রযুক্তি আসার সময়ে বড় হয়েছেন। তাঁরা তথ্য খুঁজতে এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে মানিয়ে নিতে পারদর্শী হলেও, তাঁদের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী মাধ্যম এবং ডিজিটাল মাধ্যমের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার বজায় থাকে। তাই অ্যালগরিদম ‘জেন এক্স’ প্রজন্মের উপর খুব একটা প্রভাব তৈরি করতে পারে না। ‘মিলেনিয়ালস’ প্রজন্ম ডিজিটাল যুগে বেড়ে উঠলেও, ডিজিটাল মাধ্যম তাঁদের কাছে একটি ব্যাকআপ প্ল্যান-সাপোর্ট সিস্টেম। তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে অ্যালগরিদমের প্রভাব থাকলেও তা গভীর নয়, বিশেষ করে যাঁরা ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন। ‘জেন জ়ি’ প্রজন্মকে ডিজিটাল নেটিভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যাঁরা প্রযুক্তির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যে-হেতু অ্যালগরিদমগুলো পূর্ববর্তী আগ্রহ ও পছন্দের ভিত্তিতে কন্টেন্ট প্রদর্শন করে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি জেন জ়ি-র পছন্দগুলিকে সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে অনেক সময় মানসিক স্বাস্থ্যের উপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং এই কারণে সম্প্রতি ‘জেন জ়ি’ ও ‘জেন আলফা’ (যাদের ২০১২ সালের পরে জন্ম) প্রজন্মের মধ্যে, নিঃসঙ্গতার প্রভাব আর আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। প্রবন্ধকারের সঙ্গে সহমত হয়ে জানাচ্ছি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য যে বিস্ময়ের প্রয়োজন, তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত
প্রাপ্তি
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘নিঃসঙ্গতা ভাঙার পুজো’ (২৮-৯) সুখপাঠ্য। বর্তমান কালে বেশির ভাগ পরিবারই অণু পরিবার। বাবা মা আর সন্তান, তার মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাবা, মা— উভয়েই কর্মরত। তাই শিশুটি সারা দিন একলা। তার আবদার জানানোর মানুষগুলির সংখ্যাও ক্রমশ কমে আসছে। দিনের বেশির ভাগ সময়টাই তার কাটে বাড়ির পরিচারক বা পরিচারিকার কাছে। তাই তার একাকিত্ব কাটে না। শুধু ব্যতিক্রম দুর্গাপুজোর মতো বড় কোনও উৎসব। একাকিত্বের বনবাস কাটিয়ে কিছু দিনের জন্য হলেও তাদের অনেকেই ফিরে পায় দাদু-দিদা-ঠাকুমার ভালবাসা, খুড়তুতো, পিসতুতো ভাইবোনেদের সঙ্গে খুনসুটি, পরিজনদের প্রশ্রয়। সারা দিনের খাওয়া, পড়ার নিয়ম তখন উধাও, শুধু আনন্দ অফুরান। বছরের অন্য দিনগুলিতে যে শিশুটিকে খাওয়াতে নাভিশ্বাস ওঠে, সেই শিশুটিই তুতো ভাইবোনদের সঙ্গে বসে নিজের হাতে খেয়ে নেয়। সেই সব দিনে মোবাইল তাকে আর টানে না। পুজো মানেই শিশুদের কাছে ‘সব পেয়েছির দেশ’।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
বিচ্ছিন্ন নয়
‘এ রাজ্যের অসম্মান’ (৪-৯) সম্পাদকীয়টি উদ্বেগের। উর্দু অ্যাকাডেমিতে উর্দু সাহিত্যের অনুষ্ঠানে জাভেদ আখতারের আমন্ত্রণ বাতিল কেবল লজ্জার নয়, পিছনে হাঁটার একটা দৃষ্টান্তস্বরূপ। কোন ‘অনিবার্য কারণবশত’ জাভেদ আখতারকে আমন্ত্রণ জানিয়েও বাতিল করা হল, জানতে পারলে একটা স্বচ্ছতা থাকত। বাংলার বাইরে দীর্ঘ দিন কাজের সূত্রে থাকার কারণে বলতে পারি, বাংলার একটা ভাবমূর্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক ও উদার মনোভাবের। একটা অন্য রকম শ্রদ্ধা পেতাম আমরা। কিন্তু, ইদানীং নানা ঘটনায় সেই ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বাংলায় যে কোনও রূপ সাম্প্রদায়িক ভাবনা ছিল না, তা বলা যায় না। গোলাম মুরশিদের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি গ্রন্থে এ বিষয়ে উল্লেখ দেখি। তবে তা কখনও মূল ভাবধারা হয়ে ওঠেনি। আর এ বাংলায় যে সুফি দর্শনেরও একটা প্রভাব ছিল তা অশীন দাশগুপ্তের লেখাতে পাই। এর আগে তসলিমা নাসরিনকে শহরের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতির কারণ দেখিয়ে কলকাতা থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। জাভেদ আখতার এক জন সংস্কৃতিমনস্ক, উদার মনের মানুষ। এমন এক জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েও না আসতে বলাটা ভীষণ ভাবে অসৌজন্যের পরিচয় বহন করল।
প্রশান্ত দাস, খলিসানি, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)