E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: প্রশাসনের প্রশ্রয়

সঠিক বিচার ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে মানুষ সরকারের উপর আর আস্থা রাখতে পারছেন না।

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২৫ ০৫:০৪

তূর্য বাইনের ‘বেপরোয়া অপরাধের নেপথ্যে’ (২-৭) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। আর জি কর কাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ছিল সরকারি হাসপাতাল। এ বার সরকারি ল কলেজ। তবে এ বার ধর্ষণের পরে খুন না করে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল নির্যাতিতাকে। এমন ঘটনার খলনায়ক শাসক দলের ছাত্রনেতা তথা কলেজের অস্থায়ী কর্মী মনোজিৎ মিশ্র। যার সঙ্গে পুলিশের এত মাখামাখি, তার এমন নৃশংস ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস হবে না তো কার হবে? যে কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা হয় সেখানেই বেআইনি কাজের অধিকারী মনোজিৎ মিশ্র এক ছাত্রীর উপর এমন অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। যখন সরকারের পক্ষ থেকে অভয়াকাণ্ড মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ক্রমাগত, তখন আরও এক বার এমন নৃশংস ঘটনা সাধারণ মানুষের কাছে পুনর্জাগরণের হাতছানি দিচ্ছে।

সঠিক বিচার ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে মানুষ সরকারের উপর আর আস্থা রাখতে পারছেন না। পুলিশকে মারধর করার অভিযোগও উঠেছে মনোজিৎ মিশ্রের নামে। তার নামে থানায় প্রচুর অভিযোগ, অনেক মামলা। তা সত্ত্বেও সে ওই কলেজের এক জন কর্মী হিসাবে থেকে গিয়েছে। প্রশাসনের সহায়তা না থাকলে এমনটা সম্ভব নয়। যদি অনৈতিক কাজের ক্ষেত্রে সরকার নিজের দায়িত্ব পালনে দীর্ঘসূত্রতা দেখিয়ে অভিযুক্তদের পাশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অবস্থান করে, তবে এমন কদর্য কাণ্ডের বিচার ও চরম শাস্তির ব্যবস্থা হবে কী করে?

অনৈতিক কাজের প্রতিবাদে সরকারি দফতরের সামনে মানুষ অবস্থান করলে সেখানে লাঠিচার্জ, সুরক্ষার দাবিতে থানার কাছে জনসমাগম হলে সেখানেও লাঠিচার্জ। সাধারণ মানুষ যাবেন কোথায়? যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রী এক জন মহিলা, সেখানে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে নারীরা সুরক্ষিত থাকার আশা করেন। সেই আশ্বাস প্রশাসন দিতে পারছে না। অভয়াকাণ্ডে আজও সব অভিযুক্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেল না। মানুষের ভয় সেখানেই।

স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০

লজ্জা

‘বেপরোয়া অপরাধের নেপথ্যে’ শীর্ষক তূর্য বাইনের যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধটি পড়লাম। তিনি যথার্থই বলেছেন, বেপরোয়া অপরাধ শাসক দলের মদত, আশীর্বাদ ‌ছাড়া সম্ভব নয়, যার নিদর্শন আমরা ইতিপূর্বে একাধিক‌ ক্ষেত্রে দেখেছি। সে কসবা ল কলেজে ধর্ষণ কাণ্ডে মনোজিৎ মিশ্রই হোক, বা কামারহাটির‌ ত্রাস জয়ন্ত সিংহ, বা মুর্শিদাবাদের বুলেট। শাসক দলের প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা‌ এই সব দুষ্কৃতীর ক্রিয়াকলাপ আড়ালেই থেকে যায়, যত ক্ষণ না তাদের অপরাধের কার্যক্রম মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছু দিন হইচই করার পর উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আসে। ইতিমধ্যে অন্য ঘটনা সামনে আসায় আগের ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে, জনগণের মধ্যে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। প্রশাসনও বিড়ম্বনা থেকে বাঁচে। শেষ পর্যন্ত অপরাধীর কী হল, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণের অগোচরেই থেকে যায়। তাই মনোজিৎ মিশ্রের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটিই এখন দেখার।

কসবার ল কলেজে মনোজিৎ মিশ্রের নতুন নতুন কীর্তি যে ভাবে প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা শিউরে ওঠার মতো। একটি শিক্ষাঙ্গন যে অপরাধের এতটা খোলাখুলি জায়গা হয়ে উঠতে পারে, তা এই ঘটনা সামনে না এলে অজানাই থেকে যেত। শাসক দল ও কলেজ কর্তৃপক্ষের মদতেই মনোজিৎ কলেজে অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়তে সক্ষম হয়েছিল‌। শিক্ষাঙ্গনে যদি নিরাপত্তা না থাকে, মেয়েদের লাঞ্ছিত ধর্ষিত হতে হয়, এমনকি কখনও খুনও হতে হয়— তা হলে এর চেয়ে লজ্জা ও দুঃখজনক ঘটনা আর‌ কী হতে পারে?

অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি

আদর্শ নির্মাণ

স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গ এর আগে কখনও এত নীচে নেমেছিল কি? এই ‘বেপরোয়া অপরাধের নেপথ্যে’ কারা আছে ও কেন আছে, তা আজ দিনের আলোর চেয়েও স্পষ্ট। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক সমাজ চাইছে সকল দুষ্কৃতীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। প্রবন্ধকার আরও চেয়েছেন, দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তাদের ‘গডফাদার’দেরও বিচারের আওতায় আনা হোক এবং বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পূর্ণ করা হোক। এটা দলমতনির্বিশেষে সবাই মনেপ্রাণে চাইবেন। সমাজে নিজেদের পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে কে না চান? তা হলে হচ্ছে না কেন?

যে কোনও অপরাধে অপরাধী সমাজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। তাই অপরাধ চরিত্রগত ভাবেই বেপরোয়া। তৃণমূল সরকারের আমলে গণতন্ত্রের পরোয়া না করার প্রবণতা আরও বেড়েছে। শাসক দল ও সরকারে দুর্বৃত্তায়ন বেড়ে চলেছে নির্বাচনে পর পর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের কারণে। নেতৃত্বের মুখে তাই শোনা যাচ্ছে, অপরাধ যা-ই হোক, ভোটে তাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন এবং হবেন। ঘটছেও তাই। এত অপশাসন মেনেও, নেতৃত্বের অত্যাচার সহ্য করেও সমর্থকরা তাঁদের দলকেই ভোট দিচ্ছেন। এমনকি একদা বিরোধী দলের সমর্থকও তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনে ভোট দিচ্ছেন। ফলে, যাবতীয় অন্যায় বৈধতা পাচ্ছে।

এই শাসক দল বেশি বেপরোয়া, কারণ বিগত প্রায় দেড় দশকে এই অপরাধ ব্যক্তিগত থেকে সংগঠিত হওয়ার লাইসেন্স পেয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’জায়গায় এই সংগঠিত অপরাধ গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছে। শাসনব্যবস্থায় আমলারা, নাগরিক সমাজে বুদ্ধিজীবীরা ভয়-ভক্তিতে বশংবদ হয়ে যাচ্ছেন। অপরাধ করাও এক ধরনের নেশা। এখন আর অপরাধ বা অপরাধীরা ‘নেপথ্যে’ থাকে না। তবে, ইতিহাসের শিক্ষা, যত দ্রুত অপরাধ ও অপরাধী চূড়ান্ত রূপ নিতে চাইবে, তত দ্রুত তার পতন হবে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর (১৯৫০-১৯৮০) ভারতে মধ্যপন্থী কংগ্রেসের দাবি ছিল জাতীয়তাবাদ দৃঢ় হোক। পশ্চিমবঙ্গে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে সমকালের (১৯৭০-২০০০) বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বামপন্থীদের আন্তর্জাতিকতাবাদকে সমর্থন দিয়ে দায়িত্ব দিয়েছিল। এর পর বিশ্বের আর্থ-রাজনীতির খোলা হাওয়া তালগোল পাকিয়ে দিল। তাই পুরনো আদর্শ মেরামত করতে হবে। নতুন আদর্শ নির্মাণ করতে হবে। না হলে মুক্তি নেই।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

পুনরাবৃত্তি

তূর্য বাইনের প্রবন্ধটি বর্তমান সরকারের সার্বিক ব্যর্থতার এক দলিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলার অবনতির চরম রূপ আজ পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র প্রকট। শিক্ষাঙ্গন রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দুর্বৃত্তদের চারণভূমি হয়ে উঠেছে। ঠিক এক বছর আগেই অভয়াকে ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছিল আর জি কর হাসপাতালের ভিতর। আর সম্প্রতি কসবার ল কলেজের ভিতর ধর্ষিতা হতে হল সেই কলেজেরই এক ছাত্রীকে। তবে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি আজ দুর্বৃত্তদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে?

কামদুনি, হাঁসখালি, আর জি কর, ল কলেজ— প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে শাসকের প্রশ্রয় অপরাধীদের আরও অপরাধে ইন্ধন জোগাচ্ছে। অবাক লাগে, এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও মহিলাদের উপর ঘটে যাওয়া এই সব ঘটনাকে প্রশাসনের তরফে আড়াল করার চেষ্টা চলে। কোনও কোনও নেতা-নেত্রী আবার ঘটনাকে লঘু করে দেখাতে বিজেপি শাসিত রাজ্যের তুলনা টানতেও কসুর করেন না। পুলিশ বারো ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা করেছে, এটাই রাজ্যের বড় সাফল্য বলে তুলে ধরা হয়। এই যদি শাসক দলের মনোবৃত্তি হয়, তা হলে তো কঠোরতর আইন এনেও এই দুর্বৃত্তদের পরাজিত করা যাবে না।

মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

torture Women Safety

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy