E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: শুধু মুখ বদলে যায়

জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে যে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে চাকরিহারারা রয়েছেন, তাঁদের অধৈর্য হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। কারণ তখনও পর্যন্ত স্কুলগুলোর বেতন সংক্রান্ত পোর্টাল বন্ধ ছিল। তাঁরা আগামী মাসে বেতন আদৌ পাবেন কি না, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল।

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০২৫ ০৪:৩৮

‘শিক্ষকদের লাথি, লাঠি’ (১০-৪) শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। চাকরিহারা শিক্ষক, শিক্ষিকাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মানবিক মুখ’ হতে চেয়েছিলেন। অথচ সেই সভার দু’দিন পরেই পুলিশ ডিআই অফিসে স্মারকলিপি জমা দিতে আসা শিক্ষক, শিক্ষিকাদের উপর যে ভাবে আক্রমণ করল, তা যেন মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছার উপরেই প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিল। জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে যে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে চাকরিহারারা রয়েছেন, তাঁদের অধৈর্য হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। কারণ তখনও পর্যন্ত স্কুলগুলোর বেতন সংক্রান্ত পোর্টাল বন্ধ ছিল। তাঁরা আগামী মাসে বেতন আদৌ পাবেন কি না, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। তাই তাঁরা ডিআই অফিসে যাওয়াটাই পথ বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু শুধু সেই কারণে স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকারের পুলিশের থেকে বিনা প্ররোচনায় যে ভাবে বার বার প্রকাশ্য রাস্তায় লাঠির বাড়ি, গলাধাক্কা ও পদাঘাত খেতে হচ্ছে, তা সভ্য সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। চাকরিহারাদের এই দুঃসময়ে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতি ভুলে সকল শুভবুদ্ধির মানুষের তাঁদের পাশে থাকাটাই ছিল জরুরি। শাসকের দায় তো আরও বেশি। কারণ তাঁদেরই পক্ষ থেকে কিছু মানুষের অন্যায়ের কারণে এত জনের জীবনে হাহাকার নেমে এসেছে। কিন্তু দেখলাম কত সহজেই মানবিকতার মুখটি সরে গিয়ে প্রশাসনের হিংস্র চেহারা বেরিয়ে এল। ভূলুণ্ঠিত হল শিক্ষকের সম্মান ও মর্যাদা।

এ-হেন অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণের সঙ্গে সাযুজ্য রয়েছে একই দিনে পুনঃপ্রকাশিত একশো বছর আগের ‘গোরার পদাঘাতে মৃত্যু’ (১০-৪-১৯২৬) শীর্ষক প্রতিবেদনের। সেখানে লেখা হয়েছে, “গত বুধবার মিলের কাজ আরম্ভ হইবার কিছু পরে বয়ন-বিভাগের জগনারায়ণ নামক একজন তাঁতী অসুস্থ বোধ করিয়া ঐ বিভাগের ইনস্পেকটরের কাছে ছুটি লইতে যায়। ইনস্পেকটর প্রথমতঃ তাহাকে ছুটি দিতে নারাজ হন, এবং তাহাকে তাহার কাজে ফিরিয়া যাইতে বলেন। জগনারায়ণ ঐ ঘর হইতে বাহির হয় না, সে বুঝাইতে চেষ্টা করে যে তাহার শরীর বাস্তবিকই অসুস্থ। বেচারা কুলীর এই ঔদ্ধত্য সাহেবের বরদাস্ত হইল না, তিনি সরোষে তাহাকে একটি প্রবল মুষ্টিপ্রহার করিলেন। লোকটার গালে এই ঘুসি লাগিল। ...তাহার তলপেটে বার বার সবুট পদাঘাত করিতে লাগিলেন।”

শাসকের আচরণে কী আশ্চর্য সাদৃশ্য! স্মরণে আসে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পঙ্‌ক্তি— “রাজা আসে যায় রাজা বদলায়/ নীল জামা গায় লাল জামা গায়/ এই রাজা আসে ওই রাজা যায়/ জামা কাপড়ের রং বদলায়.../ দিন বদলায় না!”

কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া

নতুন পরীক্ষা

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের আকস্মিক কর্মচ্যুতি তাঁদের পারিবারিক জীবনে এক ঘোরতর অন্ধকার নামিয়ে এনেছে। রায়ের বিস্তারিত অংশে গেলে জানা যাবে, এঁদের এক অংশের নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। পদ্ধতি একটা ছিল, তবে পরে জানা গেল, তা ছিল গোলমেলে। এক অংশ নিয়োগপত্র পেয়েছিল অসাধু উপায়ে, কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে। নিয়োগের জটিলতা পেরিয়ে যে প্রশ্ন এখন জন-পরিসরে ঘোরাফেরা করছে, তা হল যোগ্যতার নিরিখে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী।

তূর্য বাইন তাঁর লেখা ‘প্রতিশ্রুতি পূরণ কোন পথে’ (১০-৪) প্রবন্ধটিতে সমাধানের রাস্তা খুঁজেছেন। তবে এ বিষয়ে একটি কথা জোর দিয়ে বলা জরুরি। পরীক্ষায় পাশের প্রস্তুতি ও চাকরির পরীক্ষায় পাশের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ আলাদা। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি শেষে যদি ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে, তার পরে আবার নতুন করে চাকরির পরীক্ষায় বসা শুধু অনীহার, অনিশ্চয়তার নয়, বেশ কষ্টকর একটা বিষয়। হয়তো বা সাধ্যাতীতও বটে। তা ছাড়া নতুন করে পরীক্ষাপর্ব পরিচালনা করাও যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। প্রবন্ধলেখক সরকার অনুসৃত ‘সীমাবদ্ধ পরীক্ষা’র প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব কাদের পাওয়া উচিত বা দেওয়া উচিত, সেই প্রশ্ন এখানে সে ভাবে আসেনি। আমার প্রস্তাব, এই দায়িত্ব যেন অবশ্যই শাসক দলের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়।

তমসাঘন পরিস্থিতিতে উষার আবাহনের জন্য একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানের রাস্তা খুঁজে নেওয়ার সময় এসেছে। যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষককুল সে ক্ষেত্রে পুলিশের লাঠির অবমাননার পরিবর্তে সামাজিক সুবিচারের একটু আশা অন্তত করতে পারেন। আর এই অসীম লজ্জার হাত থেকে আমাদেরও হয়তো রেহাই মিলতে পারে।

বরুণ কর, ব্যান্ডেল, হুগলি

ভিন্ন পথের খোঁজ

‘শিক্ষকের আকাল মেটাতে বিকল্প চিন্তা’ (১২-৪) প্রতিবেদনে জানা গেল, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের বর্তমান সভাপতি সাম্প্রতিক কালের গুরুতর সমস্যা শিক্ষক-অভাব মেটানোর জন্য একটি দাওয়াই বাতলেছেন। তা হল, একটি স্কুলে কোনও বিষয়ের শিক্ষকের কাছে পাঠ নিতে আসবে কিছু দূরে অবস্থিত অন্য স্কুলের পড়ুয়ারা, যাদের স্কুলে এই মুহূর্তে ওই বিষয়ের শিক্ষক নেই। আপাত-সুন্দর এই প্রস্তাবের মধ্যে কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে কি? তা ছাড়া তাঁর এই প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত?

এর দ্বারা তো তিনি কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম ‘স্কুল ক্লাস্টার’ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চাইছেন। ভয় হয়, এই অবকাশে বেশ কিছু বিদ্যালয়ের দরজা চিরতরে বন্ধ না হয়ে যায়। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কোচন ভিন্ন পথ ভাবলে ভাল হয়।

তপন কুমার সামন্ত, কলকাতা-১২

ইলিশ-যুদ্ধ

‘মাছের বাজারে গেরুয়া হানা, জমে উঠল তরজা’ (১০-৪) শীর্ষক সংবাদটি পড়ে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভে মন ভরে উঠল। এটা নিছক একটা মাছের বাজার উচ্ছেদের ঘটনা নয়। একটিমাত্র জায়গায় ইলিশ বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়। এটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নতুন অধ্যায়।

অতীতে দেখেছি কখনও গরুর মাংস খাওয়ার নামে, কখনও টুপি পরার নামে সাধারণ মানুষকে শারীরিক নিগৃহীত হতে হয়েছে, প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছে। এখন সেই একই রাজনীতি ঢুকে পড়েছে বাঙালির মাছের পাতে। বলা হচ্ছে, মন্দিরের পাশে মাছ বিক্রি চলবে না, কারণ তাতে নাকি ‘শুদ্ধতা’ নষ্ট হয়। এই তথাকথিত ‘শুদ্ধতা’ কথাটা আসলে এক জাতপাতভিত্তিক চিন্তার আধার। এর চোখে গরিব মানুষ, নিম্নবর্ণ, খাদ্যবৈচিত্র— সবই অপবিত্র। যাঁরা ওই বাজারে মাছ বিক্রি করেন, যাঁরা মাছ কিনতে যান— তাঁরা সকলেই এই ‘শুদ্ধতা’র চোখে অপরাধী।

দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক শুধু বাজার নয়, এক প্রতিরোধের প্রতীক। এই বাজার বহু পুরনো। মাছের গন্ধ, কোলাহল, হাসি-মজায় মুখর এক বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি। বহু পরিবার সেই বাজারে মাছ বিক্রি করে সংসার চালায়। ফ্যাসিবাদ সব সময় সংস্কৃতি দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। ভাষা, পোশাক, খাদ্য— সব কিছু দখলের পর আসে চূড়ান্ত আঘাত। বাঙালি, বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী জনগণ— ভারতের বহুত্ববাদ, যুক্তিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম স্তম্ভ। এঁদের দমন করা মানে গোটা ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিগত ঐতিহ্যকে স্তব্ধ করে দেওয়া।

আজকের এই ইলিশ-যুদ্ধ সেই বৃহৎ যুদ্ধের এক খণ্ডমাত্র। দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ককে গ্রাস করলে, কলকাতার গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট, শ্যামবাজার— সব যে একে একে নিশানা হবে না, কে বলতে পারে? জাতীয় ঐক্যের নামে আমাদের স্বকীয়তাকে খণ্ড খণ্ড করে দেওয়া হবে। তাই এ লড়াই শুধুমাত্র বাজার রক্ষার লড়াই নয়। এ হল সারা ভারতের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় আঘাত। জবাব দিতে হবে যুক্তি দিয়ে, প্রতিবাদ দিয়ে, সম্মিলিত কণ্ঠে।

প্রতাপ চন্দ্র দাস,নবদ্বীপ, নদিয়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

protests Bikash Bhavan Mamata Banerjee West Bengal government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy