জয়ন্ত বসুর ‘দয়া করে শহরটাকে বাঁচান’ (২৬-৯) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রয়োজনীয় দিক উল্লেখ করা দরকার। কলকাতায় জল জমার সমস্যা কেবল এক দিনের অতিবৃষ্টির ফল নয়, এর মূল কারণ দীর্ঘ দিনের অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট হয়ে যাওয়া, খাল-বিল দখল ও আধুনিক ব্যবস্থাপনার অভাব। কলকাতা যে-হেতু গঙ্গার অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত, তাই অতিবৃষ্টি এখানে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু শহরের নালা-খালের ‘নেটওয়ার্ক’ যতটা লম্বা ছিল, পুরসভার রিপোর্টই বলছে তা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। এর অধিকাংশই আজ অবরুদ্ধ বা দখল হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক জলপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এর পাশাপাশি ‘কেন্দ্রীয় ভূগর্ভস্থ জল বোর্ড’-এর তথ্য বলছে, গত ৩০ বছরে কলকাতা শহরে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর কোনও কোনও অঞ্চলে ১-৬ মিটার অবধি নেমে গিয়েছে। কিছু জায়গায় তা আরও বেশি। ফলে বর্ষায় জল জমে থাকে, আর গ্রীষ্মে তৈরি হয় জলসঙ্কট।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। চিনের ‘স্পঞ্জ সিটি মিশন’ এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সেখানে ‘বৃষ্টি উদ্যান’, ছাদের উপর জল সংরক্ষণ, ছিদ্রযুক্ত রাস্তা, কৃত্রিম জলাভূমি প্রভৃতির উপর জোর দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে বৃষ্টির জলকে শোষণ, মজুত ও পুনর্ব্যবহার করা যায়। উদ্দেশ্য, জল জমার সম্ভাবনা কমানো এবং ভূগর্ভস্থ জলের ভান্ডার বৃদ্ধি করা। ভারতে ইতিমধ্যেই কোচি ও সুরাট শহরে পরীক্ষামূলক ভাবে এই মডেল চালু হয়েছে। কলকাতায়ও এই উদ্যোগ সম্ভব। শহরের পুরনো খাল, খোলা মাঠ, সরকারি ভবনের ছাদ ও অব্যবহৃত জমি কাজে লাগিয়ে এই মডেলের বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এতে দীর্ঘমেয়াদে জল জমার সমস্যার নিরসন সম্ভব হবে, একই সঙ্গে জল সংরক্ষণও নিশ্চিত হবে। লক্ষ্য একটাই— বৃষ্টির জলকে সমস্যা নয়, সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করা। তবে, নীতি-নির্ধারক, প্রশাসন ও নাগরিক— সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
অলোক কুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৫
উদাসীনতা
জয়ন্ত বসুর ‘দয়া করে শহরটাকে বাঁচান’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বহু কাল আগে আমার বাবার মুখে শোনা কয়েকটি কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, দায়িত্বের বিচার করতে গিয়ে ‘আমার’-‘ওর’ করে পরস্পর দোষারোপে লিপ্ত হলে কাজের কাজ কিছু হয় না। পরিবেশ রক্ষার জন্য একযোগে প্রত্যেক মানুষকে এগিয়ে আসতে হয়। মানুষের সক্রিয় এবং সচেতন ভূমিকা দ্বারাই সরকার পরিচালিত হয়, এটি মনে রাখা জরুরি। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরলে এর সারবত্তা বোঝা যায়।
প্রায়ই যাতায়াতের পথে নজরে আসে, এক শ্রেণির মানুষ ঘরের বর্জ্য বা আবর্জনা নির্দিষ্ট জায়গার পরিবর্তে যেখানে সেখানে, বিশেষ করে ড্রেনের পাশে ফেলে দিতে অভ্যস্ত। পুরসভার কর্মীরা আজকাল বহু অঞ্চলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করা সত্ত্বেও সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁদের। কোথাও কোথাও বাড়ি তৈরির ইমারতি দ্রব্যে নালা-নর্দমা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ডোবা, জলাভূমি কিংবা পুকুর বুজিয়ে, মাঠঘাট দখল করে যে হারে বহুতল নির্মিত হচ্ছে, সেই হারে নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে না। একটা সময়ে যে সব অঞ্চলে পাঁচশো লোকের বাস ছিল, সেখানে এখন গড়ে উঠেছে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার লোকের আবাস। এ ছাড়া বেআইনি নির্মাণের উৎপাত তো আছেই। কলকারখানা কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণে বিষাক্ত বর্জ্য নিত্য বিভিন্ন পথে গঙ্গায় এসে পড়ছে। প্লাস্টিক কিংবা থার্মোকলের মতো অ-বিনাশী দ্রব্যে নিকাশি ব্যবস্থা লাটে উঠেছে। গঙ্গা কিংবা সংলগ্ন খাল-বিলগুলি হারাচ্ছে গভীরতা।
আমরা শৈশবে প্রায় প্রতি বছরই বর্ষাকাল জুড়ে ভারী বর্ষণ দেখেছি। জলও জমত খুব, তবে নিচু এলাকায়। বৃষ্টির জমা জল গঙ্গার গভীরতায় নেমে যেত অচিরে। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে অবস্থার উন্নতি ঘটেছে প্রভূত। কিন্তু সে সবের প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ নেই। একই সঙ্গে রয়েছে সরকার ও জনগণ— উভয়ের উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি। সুব্যবস্থার পক্ষে একযোগে কাজ করার ইচ্ছা বড় একটা চোখে পড়ে না। সব বিষয়েই ঢুকে পড়েছে অবাধ রাজনীতি।
বাবুলাল দাস, ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
সমাধানের পথ
জয়ন্ত বসুর প্রবন্ধ পড়ে মনে হল, সত্যিই গত সেপ্টেম্বরের আকাশভাঙা বৃষ্টি জনগণকে শুধু বিচলিতই করেনি, ভবিষ্যতের কথা ভেবে আতঙ্কও জাগিয়েছে। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় গভীর রাতের অত্যধিক প্রবল বৃষ্টি ও তার জেরে ভেসে যাওয়া গৃহ ফেলে রাতারাতি মানুষের ‘নিরাপদ’ জায়গায় চলে যাওয়া স্মরণাতীত কালে দেখিনি। এমন বৃষ্টির ভবিষ্যদ্বাণী আবহাওয়াবিদরা করতে পারেননি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে বেআইনি বহুতল, পরিকল্পনাহীন জলনিকাশি ব্যবস্থা, গঙ্গাদূষণ, খাল-বিল-নালা সংস্কারের দিকে নজর না দেওয়া নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। জলবায়ু ও তার ঘন ঘন পরিবর্তন আমরা দেখেছি। জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যাঁরা মারা গেলেন, তাঁদের জন্য পরিবার-পিছু সরকার থেকে এককালীন টাকা ও চাকরি ঘোষণা করা হয়েছে! এর বাইরে ভিন্ রাজ্যের দোহাই দিয়ে নিজেদের বোঝা লঘু করার প্রয়াস ছাড়া সদর্থক কিছু চোখে পড়েনি।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য ভারত সরকার জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা এনএপিসিসি) চালু করেছে ২০০৮ সালে। এই কর্মপরিকল্পনার মূল ভিত্তি হল আটটি জাতীয় মিশন, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবিলা এবং প্রশমনের জন্য কৌশল তৈরি ও বাস্তবায়নে সাহায্য করে। এর মূল লক্ষ্য হল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং একই সঙ্গে দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে প্রশাসনিক সদিচ্ছা যথেষ্ট নয়, সঠিক পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণ জরুরি।
সব্যসাচী পড়ুয়া, কলকাতা-৭৫
বিপদঘণ্টা
অন্তরা হালদারের ‘এ বার বলিষ্ঠ রক্ষাকবচ’ (১৫-৯) শীর্ষক প্রবন্ধ পড়ে আইসিজে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস) কর্তৃক সকল রাষ্ট্রের প্রতি আইনি বাধ্যবাধকতা বিষয়ে জেনে মনে আশা জাগল। বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তার মধ্যে বিশেষ করে সামুদ্রিক অঞ্চলগুলির সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অথচ, বিত্তবান দেশগুলি এ ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করা নাগরিকদের রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য হলেও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলি সে ব্যাপারে তৎপর নয়। অথচ, প্যারিসে ২০১৫ সালে ১৯৫টি দেশকে নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল, যা ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর কার্যকর হয়। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আসন্ন বিপদগুলির সম্ভাবনা মোকাবিলা করার জন্য এক সঙ্গে কাজ করার কথা বলা হয়। কিন্তু সেই চুক্তির নির্দেশগুলি বা করণীয় ব্যবস্থা এখনও অনেকাংশে রূপায়িত হয়নি।
তবে, ধীরে হলেও পরিবেশ সচেতনতা এবং অস্তিত্বের লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়ছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলে গঠিত ‘প্যাসিফিক আইল্যান্ডস স্টুডেন্টস ফাইটিং ক্লাইমেট চেঞ্জ (পিআইএসএফসিসি) সংগঠন যেমন আইসিজে-র সামনে মোক্ষম প্রশ্নগুলি রেখে তাদের টলিয়ে দিয়েছে। তারা মূলত ফিজি, টোঙ্গা, ভ্যানুয়াটু দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী হওয়ায় দেওয়ালে তাঁদের পিঠ ঠেকে গিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূলীয় ক্ষয়, ঘন ঘন তীব্র ঝড়, কৃষিক্ষেত্রে লবণাক্ত জলের প্রবেশ তাঁদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। তাই আইসিজে-র এই রায়ের দিকে আগামী দিনে চোখ থাকবে গোটা বিশ্বের।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)