E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: কেউ কথা রাখে না

নেপথ্যে কোন রসায়ন, তা প্রবন্ধে সরাসরি উত্থাপিত না হলেও, বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রতি বার পুজোর আগে শহরের খানাখন্দযুক্ত রাস্তা মেরামতের আশ্বাসবাণী শোনা যায়।

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৩

জহর সরকারের ‘লন্ডন নাহয় না-ই হল’ (১২-৯) শিরোনামের প্রবন্ধ শুধু শহরবাসীর মনের কথা নয়, কাজের তাগিদে যাঁরা কলকাতায় নিত্যদিন যাতায়াত করেন, তাঁদের অনেকেরই চাহিদার কথা সেখানে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে জানাই, রুবি মোড় থেকে আনন্দপুরগামী রাস্তার দু’পাশে বাঁধানো ফুটপাত হকারদের দখলে চলে যাওয়ায় পথচারীদের নিরুপদ্রবে হাঁটার উপায় থাকে না, যদিও পুরসভার পক্ষ থেকে স্থায়ী দোকানঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাসবিহারী কানেক্টরের সন্নিকটে, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় যত্রতত্র হোটেল, পানশালা, গেস্ট হাউসের ছাড়পত্রেও জনজীবন বিঘ্নিত। নেপথ্যে কোন রসায়ন, তা প্রবন্ধে সরাসরি উত্থাপিত না হলেও, বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রতি বার পুজোর আগে শহরের খানাখন্দযুক্ত রাস্তা মেরামতের আশ্বাসবাণী শোনা যায়। কিন্তু কয়েকটা পুজো কেটে গেলেও পুরসভার সেই আশ্বাসবাণী এলাকাবাসীর কাছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটির মতোই ঠেকে। শহরের অন্যত্রও কমবেশি এমনতর চিত্র দেখা যাবে। ক্লাবগুলো সরকারি আনুকূল্য পাওয়া সত্ত্বেও ফুটপাত, রাস্তায় খুঁটি পোঁতার ক্ষত চিহ্ন কেন রয়ে যায়, জবাব নেই।

মেয়াদোত্তীর্ণ দৃশ্যদূষণকারী ব্যানার, ফ্লেক্সের জঞ্জাল যদি সরানো সম্ভব না হয়, তা হলে অন্তত নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত পুজো-সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছেঁড়া বিবর্ণ বস্তুগুলো সরালে শহর অনেক পরিচ্ছন্ন হবে। নানা কারণে নেতা-নেত্রীর বন্দনায় বিধায়ক, কাউন্সিলরদের সচিত্র পরিচয়জ্ঞাপক সাইনবোর্ড, ফ্লেক্স সরালে দলের ভোট বাড়বে বই কমবে না। এই শহরের মাঝেই রয়েছে পুরোপুরি দৃশ্যদূষণমুক্ত সেনাদের অধীনে থাকা তরুময় মসৃণ রেড রোড, সবুজ গালিচায় মোড়া গড়ের মাঠ, যার ইতিউতি ঐতিহ্যশালী ভবন, স্থাপত্য। ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানীর গরিমা যারা আজও বহন করে চলেছে।

ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭

উচিত সিদ্ধান্ত

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন— বিশ্বকর্মা পুজোর সরকারি ছুটি অগ্রাহ্য করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখা হবে। কেউ বলেছেন, এটি ধর্মবিরোধী অবস্থান, কেউ আবার প্রশাসনিক কড়াকড়ি হিসেবে দেখছেন। কিন্তু মূল প্রশ্ন: একটি রাষ্ট্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আসলে কোথায়?

একটি বিশ্ববিদ্যালয় মূলত শিক্ষা, গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র। সেখানে ছুটি নির্ভর করা উচিত শিক্ষাবর্ষের উপর, ধর্মীয় রীতি বা উৎসবের উপর নয়। যদি বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়, তবে অন্য সব ধর্মীয় ক্ষেত্রেও তা বাধ্যতামূলক করা উচিত নয় কি? আর যদি সব ধর্মের ছুটি না মানা হয়, তা হলে তো তা বৈষম্যমূলক আচরণ হবে। এই প্রশ্নকে পাশ কাটানো যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির কর্তব্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে যুক্তি ও সাম্যের শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া। যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই এক ধর্মের অনুশাসনে চলে, তা হলে শিক্ষার্থীরা কী ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ শিখবে?

বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষাঙ্গন ধর্মীয় উৎসবের দিন বন্ধ থাকে না। উৎসব মানুষ ব্যক্তিগত ভাবে পালন করে, প্রতিষ্ঠান নয়। আমাদের দেশেও যদি বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদী শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তবে এই ধরনের পদক্ষেপ করা জরুরি। অতএব, উপাচার্যের সিদ্ধান্ত নিছক বিতর্কের সূত্রপাতই করেনি, বরং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পদক্ষেপ আমাদের সামনে এক অমোঘ প্রশ্ন রেখেছে— আমরা কী চাই? আধুনিক, বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, না কি এখনও পুরনো সংস্কারের শিকলে বাঁধা থাকতে চাই?

প্রতাপ চন্দ্র দাস, নবদ্বীপ, নদিয়া

বিসর্জিত

শিল্পের, কর্মের ও পরিশ্রমের আরাধ্য দেবতা বিশ্বকর্মা। নানা জায়গায় ধুমধাম করে বিশ্বকর্মা পুজো হয়। কারখানা, গ্যারাজ, প্রিন্টিং প্রেস থেকে শুরু করে রিকশা, অটো, এমনকি অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মধ্যেও পুজো হয়। কিন্তু এই পুজো যতটা আড়ম্বরপূর্ণ, কর্মসংস্কৃতি ও বাস্তব শিল্প পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নেই।

এটা এক দিনের ঘটনা নয়। এক সময় বাংলার গর্ব ছিল তার শিল্পভিত্তিক পরিকাঠামো। বিখ্যাত শিল্পগোষ্ঠীগুলি নিজেদের বিভিন্ন শিল্পকারখানা এখানে স্থাপন করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও স্বার্থের কারণে এবং পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে সেই সব শিল্পের একে একে অবসান ঘটেছে। অনুকূল পরিবেশ না থাকায় নতুন শিল্প তো আসেইনি, বরং বহু পুরনো শিল্পও পাততাড়ি গুটিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে। শিল্প-বান্ধব ভাবমূর্তির পরিবর্তে রাজ্যে গড়ে উঠেছে শিল্প-বিরোধী ছাপ। ফলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়েছে। হাজার হাজার শিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত যুবক-যুবতী অন্যত্র পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলার শ্রমশক্তি আজ কার্যত বহির্বঙ্গের অনেক রাজ্যের উন্নয়নচক্রকে সচল রাখছে। এ রাজ্যে শিল্প ও কর্মসংস্কৃতির সেই ধারাবাহিকতা নেই বলেই, আজ বিশ্বকর্মা পুজো যেন শিল্পের আরাধনার চেয়ে বেশি উৎসবে পরিণত হয়েছে।

কর্মসংস্থান না থাকলে, শিল্প না থাকলে, প্রতি বছরই বিশ্বকর্মার পুজোর আড়ম্বর আসলে প্রহেলিকার মতোই মনে হয়। শিল্পোন্নয়ন ছাড়া কর্মসংস্কৃতি ফিরবে না।

কাজল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮

বিলীয়মান

সুজিত ভট্টাচার্যের লেখা ‘বাড়ির পুজোর ভবিষ্যৎ’ (রবিবাসরীয়, ১০-৮) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, দেবী নিজে যেমন দশভুজা, তেমনই দশ জন হাত না লাগালে তাঁর পুজো হওয়াও রীতিমতো কঠিন। অনেকে আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বাড়ির পুজোর ঐতিহ্য থেকে দূরে চলে যাচ্ছেন, যা এই পুজোর ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে। অল্প অর্থে, অল্প লোকবলে অধিকাংশ বাড়ির পুজো পরিচালনা করা দিনে দিনে কঠিনতর হয়ে উঠেছে। আর্থিক সহায়তা ও লোকবলের অভাবে পুজোর ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। আগেকার দিনে জমিদারদের বাড়ির জাঁকজমকপূর্ণ পুজোতেও সেই জৌলুস আর নেই।

নতুন প্রজন্ম গ্ৰাম, শহর বা দেশ ছেড়েছে উন্নত মানের জীবনের খোঁজে। যাঁরা আছেন, তাঁরা কোনও মতে নিয়মরক্ষা করছেন। তাঁরা গতাসু হলে আর পরিবারের তেমন কোনও ব্যক্তি নেই যিনি ঐতিহ্যপূর্ণ পুজোর হাল ধরবেন। আবার পারিবারিক অশান্তির জেরে, পুজোর দায়ভার বহনে অক্ষমতার কারণে দেড়শো বছরের পুজো বন্ধ হয়েছে— এমন উদাহরণও আছে। যদিও কিছু পরিবার দীর্ঘদিনের প্রাচীন পুজোকে এখনও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে কী হবে সে নিয়ে উঠে গিয়েছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

উৎপল মুখোপাধ্যায়, চন্দননগর হুগলি

শিউলির গন্ধ

সেবন্তী ঘোষের লেখা ‘চিরবিষণ্ণ, চির-অনিবার্য’ (রবিবাসরীয়, ৭-৯) প্রসঙ্গে কিছু কথা। আমাদের বাড়ি ছিল বকুল গাছের ছায়ায়। শরৎ এলেই ফুলে ফুলে ভরে থাকত শিউলিতলা। শিউলিকে জড়িয়ে থাকা মাধবীলতার গন্ধে মাখামাখি শিউলির গন্ধ। মর্নিং স্কুলে যাওয়ার পথে দেখতাম একটি বাচ্চা মেয়ে কোঁচড় ভরে শিউলি কুড়োত রোজ। এক দিন নিলাম ওর কোঁচড়ভরা ফুল আমার দু’হাত ভরে। স্কুলে এসে বন্ধুদের বললাম, “নে ধর। এই শিউলি ফুলের সুবাসে আমাদের বন্ধুত্ব ও ভালবাসা ছড়িয়ে থাকুক হৃদয় জুড়ে।” কিন্তু থাকেনি বন্ধুত্ব। কোথায় হারিয়ে গিয়েছে সন্ধের শুকিয়ে যাওয়া শিউলির মতো।

করবী হাজরা, কলকাতা-১৫৯

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy