Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: নেশাগ্রস্তের অধিকার

প্রথমেই ঝালিয়ে নেওয়া দরকার, মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে মানুষের সংগঠিত উদ্যোগের ইতিহাসটি। শুরুটা ১৯৪০-এর দশকে ক্যালিফর্নিয়া ও নিউ ইয়র্কের গুটিকয়েক মাদকাসক্ত জেলবন্দির বানানো প্রথম সেল্‌ফ-হেল্প গ্রুপ বা স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকে।

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৯ ০০:০১

‘মুক্তির আঁধার’ (২৫-৪, ২৬-৪) শীর্ষক দু’কিস্তির প্রতিবেদনটিতে শহরের বিভিন্ন নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামো ও পরিষেবার ‘বেহাল’ দশার কথা বলা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনটির জন্যে ধন্যবাদ। দু’চারটি কথা যোগ করি।

প্রথমেই ঝালিয়ে নেওয়া দরকার, মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে মানুষের সংগঠিত উদ্যোগের ইতিহাসটি। শুরুটা ১৯৪০-এর দশকে ক্যালিফর্নিয়া ও নিউ ইয়র্কের গুটিকয়েক মাদকাসক্ত জেলবন্দির বানানো প্রথম সেল্‌ফ-হেল্প গ্রুপ বা স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকে। তার পরেও দীর্ঘ দিন আমেরিকায় মাদকাসক্তদের একজোট হয়ে কোনও সভা করায় রাষ্ট্রের নিষেধ ছিল। তখনও মাদকাসক্ত মানুষদের নিজেদের বাঁচার লড়াই নিজেদেরই লড়তে হয়েছে, বৃহত্তর সমাজ কখনওই তাঁদের সমস্যাকে মানবিক হয়ে দেখতে পারেনি।

একবিংশ শতকে এসেও অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ঠিক জনসচেতনতার অভাবে, মাদকাসক্ত নন এ রকম মানুষজন বার বার মাদকের নেশা করাকে অন্য আর পাঁচটা শারীরিক অথবা মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। সারা বিশ্বের অভিজ্ঞতা বলে, মাদকাসক্তদের সমাজে প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনের সংস্থান করায় ডাক্তার এবং সাইকায়াট্রিস্টরা একেবারেই ব্যর্থ। ভারতের ইতিহাসটাও খুব আলাদা নয়, বহু দিন পর্যন্ত সরকারি লাইসেন্স-প্রাপ্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাইকায়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে মাদকাসক্তের চিকিৎসায় অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকারক ওষুধ, এমনকি বৈদ্যুতিক শকেরও ব্যবহার ছিল। ওষুধের মাধ্যমে কারও মন থেকে নেশা করার ইচ্ছে ও চাহিদা মুছে ফেলা সম্ভব, এটা বোধ হয় আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সমর্থকও মেনে নিতে পারবেন না।

প্রতিবেদনটিতে উল্লিখিত নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলিতে প্রয়োজনীয় অনুমোদন এবং সরকারি নজরদারির অভাবের বিষয়টি তলিয়ে দেখার মতো অভিযোগ। তবে সরকারি নজরদারির ওপর অন্ধবিশ্বাস রাখার আগে মনে রাখতে হবে, ২০১৬ সালেই ফিলিপিন্সে প্রেসিডেন্ট রডরিগোর সরকার মাদকের নেশা থেকে দেশকে মুক্ত করার নামে, সরকারি সশস্ত্র বাহিনী ও বেসরকারি মিলিশিয়ার সাহায্যে হাজার-হাজার মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করে। সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের আইনে, যে কোনও মাদক, এমনকি গাঁজা রাখার দায়েও, কারও মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। বেশির ভাগ দেশেই, মাদকের নেশার আসল চরিত্র এবং তা থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে, সরকারের স্বচ্ছ ধারণা নেই, সদিচ্ছাও নেই।

এই দেশে সাধারণ জ্বরেও এক জন আইনগত ভাবে ছুটির দরখাস্ত করতে পারেন, এক জন মাদকাসক্তের কিন্তু মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির প্রয়োজনে ছুটি চাওয়ার অধিকার নেই। আমেরিকার ‘ফ্যামিলি অ্যান্ড মেডিক্যাল লিভ অ্যাক্ট’ মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের এই অধিকার দিয়েছে। সেখানে মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে ১৯৪০-এর দশকে যে মিনেসোটা মডেলটি চালু হয়েছিল, তার উদ্দেশ্যই ছিল এমন একটা সফল চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে মাদকাসক্তের মানবাধিকার-সহ সম্মানের দিকটিও সুনিশ্চিত করা যেতে পারে।

কলকাতার যে নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলির কথা লেখা হয়েছে, তার বেশির ভাগই মিনেসোটা মডেল অনুসরণ করে। কেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহও দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা সফল ভাবে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে যেতে পারেন। এটা স্বীকার করতেই হবে, শহরের এই তথাকথিত ‘বেহাল’ ও ‘অনিয়ন্ত্রিত’ কেন্দ্রগুলিতেই কিন্তু মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার সাফল্যের হার বেশ উঁচু। গত দু’দশকে এই নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলি ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ‘রমরমা’র দৌলতেই এই সাফল্য এসেছে, যা কলকাতার ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি।

কিছু কেন্দ্রে নেশামুক্তির নামে বিভিন্ন অনাচার চলে, তবে এই অজুহাতে কোনও সরকারি সিদ্ধান্তে রাতারাতি নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দেওয়াও কোনও সমাধান হতে পারে না।

পঞ্জাবে এ রকম একটি হঠকারী সরকারি সিদ্ধান্ত সে রাজ্যের নেশামুক্তির লড়াইকে যে এক ধাক্কায় কতটা পিছিয়ে দিয়েছে, তা আমাদের অনেকেরই জানা। নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলির ওপরে নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির প্রয়োজন থাকলেও, তা তখনই সফল হতে পারে, যখন এ বিষয়ে আলোচনায় প্রশাসন, স্বাস্থ্যকর্মী, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি, নেশা ছেড়ে মূলস্রোতে ফিরে আসা মাদকাসক্ত ব্যক্তি, তাঁদের পরিবার-সহ সব পক্ষকেই সামিল করা হবে এবং এ নিয়ে সমাজে প্রতর্ক আরও জোরদার হবে।

রনি সেন

কলকাতা-৯৭

মন ও সমাজ

‘মানসিক রোগীদেরও চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলানো হোক’ (১৩-৫) শীর্ষক নিবন্ধের জন্য লেখিকা রত্নাবলী রায়কে ধন্যবাদ। মানসিক স্বাস্থ্যের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের উপর যদি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র আন্তরিক ভাবে নজর দিত, অনেক অসহায় মনোরোগী ও তাঁদের পরিজন একটু শান্তিতে বঁাচতেন। প্রসঙ্গত খুব কাছ থেকে দেখা তিন জন স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া রোগীর কথা জানাতে চাই।

‘ক’ ছিল মা-বাবার একমাত্র সন্তান। স্নাতক। একটি অসরকারি সংস্থায় কাজ করতে করতেই মনোরোগের শিকার। অসুস্থ বাবা-মা নিয়মিত চিকিৎসা করাতে পারেননি। চাকরিও চলে যায় ওর। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর একা হয়ে পড়ে যুবক। এক সময় জমা টাকাও ফুরোয়। চিকিৎসা তো দূরের কথা, এখন দু’বেলা খাবারই জোটে না। মাঝে মাঝে নিজের ঘরের জানালা কিংবা দরজা খুলে বিক্রি করে কয়েক দিন চালায়। এ বার হাত পড়েছে ইটে। নিজের ঘরেরই দেওয়াল ভেঙে ইট বিক্রি করে পেটের আগুন নেভায়। যখন এটাও শেষ হবে, তখন? ওকে তিলে তিলে শেষ হতে দেখছি আমরা সবাই।

‘খ’-র বয়স ৫০। স্নাতক হলেও কর্মহীন। মা নেই। ৮৫ বছরের বাবা মনোরোগী ছেলের দেখাশোনা করেন। হাসপাতালে নিয়ে যান, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছেলেকে ডাক্তার দেখান। সরকারি চিকিৎসা পরিষেবাটি যদি ওঁর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া যেত! বাবা চোখ বুজলে ছেলের কী হবে, বোঝাই যায়। বাড়িতে ঠাঁই হবে না, চিকিৎসা হবে না। রাস্তায় কিংবা স্টেশনে একটা ভবঘুরের সংখ্যা বাড়বে। ছেলেধরা বা চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলাও অস্বাভাবিক নয়!

‘গ’ এমবিবিএস পাশ। ডাক্তারি পড়তে পড়তেই মনে অসুখ ঢোকে। ওষুধ খেত না। রোগ বাড়তে থাকে। দু’তিনটি ইংরেজি ও বাংলা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। এক সময় মা-বাবাও চোখ বোজেন। এক দিন শুনি, ওকে নাকি কারা মেরেছে। খবরের কাগজ নিয়ে, দাম না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। দিনের পর দিন এক নির্দয় পরিবেশ প্রত্যক্ষ করে, অযত্নে, অনাহারে, এই পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য হল সে। না কি আমরাই ওকে খুন করে ফেললাম!

এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চার পাশেই ছড়ানো। ক, খ, গ-রা যদি মেয়ে হত, তা হলেও গল্পগুলো একই থাকত। আর সঙ্গে হয়তো যোগ হত যৌন নির্যাতন।

এর পর এক সময়, প্রতি পরিবারে হয়তো এক জন করে মনোরোগী তৈরি হবে। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ছাড়া এঁদের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

শিপ্রা ভৌমিক

চন্দননগর, হুগলি

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

ভ্রম সংশোধন

• ‘মমতার বাড়ির ওয়ার্ডেও পদ্মে ঢাকল ঘাসফুল’ (পৃ ৩, ২৫-৫) শীর্ষক প্রতিবেদনে উত্তর কলকাতার পিছিয়ে পড়া ওয়ার্ডের তালিকায় তথ্যগত ভুল রয়েছে। ৪৪, ৫২ এবং ৫৫ ওয়ার্ডে শাসক দল এগিয়ে।

• ‘পাত্রের জলে ফুল দিতেন...’ (পত্রিকা, পৃ ২, ২৫-৫) শীর্ষক প্রতিবেদনে যে ছবিটি ‘বাগবাজারে নন্দলালের বাড়ি’ বলে ছাপা হয়েছে, সেটি আসলে বাগবাজারের মহেন্দ্রনাথ, নন্দলাল এবং পশুপতিনাথ বসুর বাড়ি।

অনিচ্ছাকৃত এই ভুলগুলির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy