Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: শুধু এক জন কেন?

১৯০৯ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সর্দার গুরমুখ সিংহকে ১৯২২ সালে যখন সেলুলার জেল থেকে মুক্ত করে প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় পঞ্জাবের জেলে পাঠানো হচ্ছিল, তিনি পালিয়ে আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ায় চলে যান।

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

সেলুলার জেলের পরিবেশিত তথ্যানুযায়ী পঞ্জাবের মোট ১০১ জন এবং বাংলার মোট ৪০৬ জন বন্দির নাম পাওয়া যায়। আমার লেখা ‘সেলুলার জেলে নির্বাসিত বিপ্লবীদের কথা’ গ্রন্থখানিতে এই তালিকা বিস্তারিত ভাবে দেওয়া আছে।

সাভারকর (ছবিতে) ফ্রান্স পুলিশ কর্তৃক ধৃত হওয়ার পর যখন তাঁকে ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে ইংল্যান্ডে আনা হচ্ছিল, ইংলিশ চ্যানেলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে আবার ফ্রান্সে ফিরে যান। ব্রিটিশ সরকার ফ্রান্স কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সাভারকরকে বন্দি করে ইংল্যান্ডে এবং পরে ভারতে নিয়ে এসে সেলুলার জেলে নির্বাসন দেয়।

১৯০৯ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সর্দার গুরমুখ সিংহকে ১৯২২ সালে যখন সেলুলার জেল থেকে মুক্ত করে প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় পঞ্জাবের জেলে পাঠানো হচ্ছিল, তিনি পালিয়ে আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ায় চলে যান। পরবর্তী কালে সর্দার ভগৎ সিংহের সঙ্গে দ্বিতীয় লাহৌর ষড়যন্ত্র মামলায় (স্যান্ডারস হত্যা মামলা) অভিযুক্ত হয়ে আবার সেলুলার জেলে নির্বাসিত হন এবং ১৯৩৭-৩৮ সালে মুক্তি পান। দীর্ঘ আত্মগোপনকালে ব্রিটিশ পুলিশের পক্ষে তাঁকে ধরা সম্ভব হয়নি।

গদর পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, ১৯০৯ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বাবা পৃথ্বী সিংহ আজ়াদ। ১৯২১ সালে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেসুলার জেলে বন্দি পাঠানো বন্ধ হলে তাঁকে মাতৃভূমির জেলে ফেরত আনার ব্যবস্থা করার সময়, তিনি প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় ট্রেন থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যান এবং ১৬ বছর আত্মগোপন করে থাকেন।

বিপ্লবী শচীন সান্যাল বারাণসী ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১৯০৯ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে সেলুলার জেলে নির্বাসিত হন। ১৯২১-এ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরে ১৯২৬ সালে কাকোরি রেল ডাকাতি মামলা অভিযুক্ত হয়ে তিনি সেলুলার জেলে পুনঃনির্বাসিত হন এবং ১৯৩৭ সালে মুক্তি পান।

বিপ্লবী নিখিল রঞ্জন গুহরায় শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১৯০৯-এ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে সেলুলার জেলে নির্বাসিত হন। ১৯২১ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরে মুর্শিদাবাদ কান্দি বোমা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১৯৩৩-এ তাঁকে আবার সেলুলার জেলে পাঠানো হয় এবং ১৯৩৭ সালে মাতৃভূমিতে ফেরত এনে কারারুদ্ধ করা হয়।

ত্রৈলোক্য মহারাজ (চক্রবর্তী) সেলুলার জেলে ১০ বছরের সাজা নিয়ে বন্দি হওয়ার পরে ছাড়া পেলেও পাক-ভারতের বিভিন্ন জেলে তাঁর বন্দিজীবন প্রায় ৩০ বছর।

যদি কোনও বন্দিকে বীর বলতে হয়, তা হলে অবশ্যই উপরোক্ত সকলকেই বীর আখ্যা দেওয়া উচিত।

যাবজ্জীবন কারাবাসের কথা বার বার উল্লেখ করে সাভারকরকে উচ্চাসনে বসানো হয়েছে। কিন্তু সেলুলার জেলে নির্বাসিত প্রায় ২০০ জন বিপ্লবী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন। অবশ্য কাউকেই এত দিন জেলে থাকতে হয়নি। যেমন, ১৯০৯ সালে যাঁদের সেলুলার জেলে নির্বাসিত করা হয়েছিল, তাঁরা তৎকালীন সরকার সেলুলার জেলে নির্বাসন বন্ধ করায় ১৯২১ সালে মুক্তি পান। আবার, ১৯৩২-এ যে বিপ্লবীদের সেলুলার জেলে নির্বাসিত করা হয়েছিল, তাঁরা তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৩৭-৩৮ সালে মুক্তি পেয়ে যান। তাই এই কৃতিত্বের দাবিদার প্রায় ২০০ জন, কিন্তু সেলুলার জেলে প্রদর্শিত ‘আলো এবং ধ্বনি’ অনুষ্ঠানে এঁদের কারও উল্লেখ নেই।

১৯৩৩ সালের ঐতিহাসিক অনশন ধর্মঘটে (৪৫ দিন) জোর করে দুধ খাওয়ানোর কারণে তিন জন বিপ্লবী শ্বাসনালীতে দুধ প্রবেশ করায় শহিদ হন। দুঃখের বিষয়, ‘আলো এবং ধ্বনি’ অনুষ্ঠানে মহাবীর সিংহের নাম উল্লিখিত থাকলেও, বাংলার দুই বীর মোহিত মৈত্র এবং মনোকৃষ্ণ নমোদাস-এর উল্লেখ নেই।

স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষে সেলুলার জেলের অত্যাচারে নিহত ছ’জন শহিদের আবক্ষ মর্মরমূর্তি উন্মোচন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মাননীয় কে আর নারায়ণন। আন্দামান নির্বাসিত রাজনৈতিক বন্দি মৈত্রী চক্রের তৎকালীন সম্পাদক বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্র মজুমদার তাঁর ভাষণে ওই পার্ককে ‘শহিদ পার্ক’ হিসাবে নামকরণ করেন। কিন্তু কে বা কারা পরে ওই পার্কের নাম পরিবর্তন করে ‘সাভারকর পার্ক’ সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছেন।

সেলুলার জেলকে ধ্বংস করে স্বাধীন ভারত সরকার গোবিন্দ বল্লভ পন্থ হাসপাতাল নির্মাণে ব্রতী হয়। চারটি উইং ভেঙেও ফেলা হয়। আন্দামান নির্বাসিত রাজনৈতিক বন্দি মৈত্রী চক্রের বিপ্লবীগণ এর বিরুদ্ধে সরব হন এবং দীর্ঘ ১৩ বছর আন্দোলন করে অবশিষ্ট তিনটি উইং ও সেন্ট্রাল টাওয়ার রক্ষা করে সেলুলার জেলকে জাতীয় স্মারক হিসেবে চিহ্নিত করান। এই ঘটনার স্বীকৃতি হিসেবে সেলুলার জেলে ঢোকার মুখে একটি স্বীকৃতিস্তম্ভের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল এবং তা গৃহীতও হয়েছিল, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটা হয়ে ওঠেনি। বরঞ্চ তার জায়গায় সাভারকরের উদ্দেশে অমরজ্যোতি স্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে।

বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ও পুলিন বিহারি দাসের আবক্ষ মর্মরমূর্তি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৬ সালের ২০ মার্চ আন্দামান কর্তৃপক্ষকে প্রদান করেন। আজ পর্যন্ত সেই মূর্তি দু’টি স্থাপন তো দূরের কথা, বাক্সবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তই হয়নি।

এই ভাবে বিকৃত তথ্যের মাধ্যমে অন্যান্য বীর বন্দিদের তাচ্ছিল্য করে এক জনকে বীর বানানো হয়েছে এবং আন্দামানের এয়ারপোর্টকে ‘বীর সাভারকর এয়ারপোর্ট’ নামকরণ করা হয়েছে। যদিও এই সমস্ত কিছু বর্তমান সরকারের আমলে হয়নি, বরঞ্চ অনেক কিছুই পূর্ববর্তী সরকারগুলির আমলে হয়েছে, তাই এই লেখা কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, কেবল ঐতিহাসিক সত্যের স্বার্থে।

অনুপ দাশগুপ্ত

কলকাতা-৩১

‘রস’-এর কথা

উদয়ন বন্দোপাধ্যায়ের ‘সস্তা হাততালির রাজনীতি’ (৫-১) নিবন্ধ বিষয়ে দু’চার কথা। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে রস, হ্যাভলক ও নেল দ্বীপ তিনটিকে নতুন নাম দিয়ে নেতাজির আন্দামানে পদার্পণের ৭৫ বছর পূর্তি পালন করলেন নরেন্দ্র মোদী! সুভাষের নামাঙ্কিত ‘রস’ আইল্যান্ড (দ্বীপ) ছিল ব্রিটিশদের সামরিক ঘাঁটি। তার ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে ও এটি এখনও ভারতীয় সেনা নিয়ন্ত্রিত। পোর্ট ব্লেয়ারে, যেখানে নেতাজি স্বাধীনতার প্রথম পতাকা তুলেছিলেন সেটি চিহ্নিত ও সংরক্ষিত, তবু যেতে হল ‘রস’! সুভাষ নাম দিতে! যে রাজবন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সেলুলার জেলে ‘দ্বীপান্তর’ সাজায় বন্দি ছিলেন তার পরিসংখ্যান ও তালিকা ওই জেলেই টাঙানো, ৮০% যে বাঙালি ও প্রায় ১৭% যে পঞ্জাবি এ তো সরকারি তথ্য। সন্ধ্যায় যে ‘ধ্বনি ও আলোক’ শো-টি দেখানো হয়, সেখানেও সুভাষের নামমাত্র উল্লেখ। সেখানে আলিপুর বোমা মামলার সাজাপ্রাপ্ত ‘বারীন-উল্লাসকর’-এর সঙ্গে একই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ১৩২৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ বই থেকে সেলুলার অভিজ্ঞতার দু’টি উদ্ধৃতি দিলে আর বাঙালির প্রাদেশিকতা সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন উঠবে না। ১) ‘‘আমরা হিন্দু মুসলমান সকলকার হাত হইতেই নির্বিচারে রুটি খাই দেখিয়া মুসলমানেরা প্রথম প্রথম আমাদের পরকালের সদগতির আশায় উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিল, হিন্দুরা কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইয়াছিল; শেষে বেগতিক দেখিয়া উভয় দলই স্থির করিল যে আমরা হিন্দুও নই মুসলমানও নই আমরা বাঙালী। রাজনৈতিক কয়েদী মাত্রেরই শেষে সাধারণ নাম হইয়া উঠিল— বাঙালী।’’ ২) ‘‘মারাঠী নেতারা প্রমাণ করিতে বসিতেন— ‘বন্দেমাতরম’ গানে সপ্তকোটি কণ্ঠের কথা আছে, ত্রিশ কোটি নাই, যেহেতু বাঙালি লিখিয়াছেন ‘বঙ্গ আমার...’ সেইহেতু বাঙালির জাতীয়তাবোধ অতি সংকীর্ণ। ...ভারতবর্ষে যদি একতা স্থাপন করিতে হয় তাহা হইলে মারাঠার নেতৃত্বেই হওয়া উচিৎ ...হিন্দুস্থানী ও পাঞ্জাবী গোঁয়ার, বাঙালী বাক্যবাগীশ, মাদ্রাজী দুর্বল ও ভীরু— একমাত্র পেশোয়ার বংশধরেরাই মানুষের মত মানুষ...!’’ নরেন্দ্র-অমিতের বর্তমান সুরের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে?

স্বরাজ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা-৯৬

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vinayak Damodar Savarkar Cellular Jail
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE