‘অঙ্ক কষার ঠেলায়’ (১৭-৪) প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রেমাংশু চৌধুরী একটি জরুরি কথা তুলে ধরেছেন। তবে শিক্ষার আঙিনাকে রাজনীতির বাহনে পরিণত করার ঘটনা শুধু দিল্লি বা পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে, এমনটা নয়, বরং সে প্রচেষ্টা দেশ-কাল নির্বিশেষে সর্বত্র অব্যাহত। শিক্ষার আঙিনাকে রাষ্ট্রশক্তি তার নিজের রঙে রাঙিয়ে তুললে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ধরন কেমন হয়, তা সুন্দর ভাবে দেখিয়েছিলেন আমেরিকান লোকসঙ্গীত শিল্পী পিট সিগার তাঁর ‘হোয়াট ডিড ইউ লার্ন ইন স্কুল টুডে’ গানটির মধ্য দিয়ে। শাসকের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা হিসাবে শৈশব থেকেই কী ভাবে শিশুর মনের খাতা রাঙিয়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তা বোঝাতে গানের একটি চরণ বলছে, “আই লার্নড আওয়ার গভর্নমেন্ট মাস্ট বি স্ট্রং/ ইট’স অলওয়েজ় রাইট অ্যান্ড নেভার রং/ আওয়ার লিডার্স আর দ্য ফাইনেস্ট মেন/ অ্যান্ড সো উই ইলেক্ট দেম এগেন অ্যান্ড এগেন।” গানের বাকি অংশেও একই রকম ভাবে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রুপের সুর ফুটে উঠেছে। সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ছবিতে শাসকের রোষে পড়ে শিক্ষক উদয়ন পণ্ডিতকে পাঠশালার শিশুদের বলাতে হয়েছিল “হীরক রাজা বুদ্ধিমান/ করো সবে তাঁর জয়গান।”
আসলে শিশুমাত্রেই একতাল কাদামাটির মতো। তাকে যেমন খুশি আকৃতি দেওয়ার সেটাই মোক্ষম সময়। শাসক সেটা জানে। তাই সর্বাগ্রে সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কব্জা করার চেষ্টা করে। তবে শাসক তাঁর নিজের প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কতটা কদর্য ভাবে কাজে লাগাবে, তা নির্ভর করে শাসকের শিক্ষা-দীক্ষা ও তার প্রকৃতির উপরে। ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো যুগান্তকারী তত্ত্বকে হেলায় খারিজ করে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারেন এমন শাসক বোধ হয় এই যুগে কমই আছেন। এ-হেন বিরল কৃতিত্বের অধিকারী আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল। অন্য দিকে, রাজ্যের শাসক দল শিক্ষায় দুর্নীতিকরণের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, স্কুলে পড়াশোনা গৌণ হয়ে কে যোগ্য শিক্ষক আর কে অযোগ্য— এই প্রশ্নই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপরে একাধিক সরকারি প্রকল্পের সুবিধা শিক্ষার্থীদের পাইয়ে দেওয়ার জন্যে যে যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষাকর্মীর প্রয়োজন হয়, স্কুলগুলিতে তা না থাকায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই সেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। আলোচ্য প্রবন্ধের কথামতো বলা যায়, স্কুল এখন আর শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয় না, ভোট-রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে প্রাধান্য পায়।
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
বিপন্ন শিক্ষা
প্রেমাংশু চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, (বর্তমানে) স্কুল আসলে শিক্ষাদানের মাধ্যম নয়, ভোট-রাজনীতির হাতিয়ার। জ্ঞানজগৎ এবং শিক্ষাঙ্গন মানব সভ্যতার মহৎ সৃষ্টি। সভ্যতার সঠিক অগ্রগতির লক্ষ্যে সেই জ্ঞানের আলো সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই পরিচালিত হয় শিক্ষাব্যবস্থা। সকলের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ-বৈজ্ঞানিক-গণতান্ত্রিক শিক্ষা পৌঁছে দেওয়াই ছিল নবজাগরণের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য আজ ব্রাত্য। সরকারি শিক্ষাঙ্গন আজ দুর্নীতির অন্ধকার গহ্বরে। এমনিতেই সরকারি স্কুলগুলি শিক্ষকহীনতায়, পরিকাঠামোহীনতায় এবং সরকারি অবহেলায় ধুঁকছিল। এই বার এক ধাক্কায় প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল এবং পরবর্তী পর্যায়ে কেবল এই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশকে এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপাত-বহাল রাখার সিদ্ধান্ত এই সঙ্কটকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। যাঁরা দুর্নীতির সাহায্যে নিযুক্ত হয়েছেন এবং দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন, তাঁদের প্রথমে চিহ্নিত করে শাস্তি না দিয়ে, যোগ্যদেরও চাকরি বাতিলের দিকে ঠেলে দেওয়া কোনও মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
অন্য দিকে, প্রতি বছর সরকারি শিক্ষার বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। বেশির ভাগ স্কুলের নেই উপযুক্ত স্কুল বিল্ডিং, পানীয় জল, শৌচাগার, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি। সরকারি স্কুলগুলিতে পাশ-ফেল নেই। এর পাশাপাশি রয়েছে অবৈজ্ঞানিক পাঠ্যক্রম। কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় পাঠ্যক্রমের গৈরিকীকরণ এবং নিজেদের সুবিধামতো নতুন করে ইতিহাস লেখার ঝোঁক শিক্ষার সর্বনাশ করছে। তুঘলক, খিলজি, লোদীদের সঙ্গে মোগল আমলকে ইতিহাস থেকে উৎখাতের আয়োজন চলছে। বিজ্ঞানের বই থেকে বাদ পড়েছে ডারউইন তত্ত্ব, পর্যায় সারণি, ইত্যাদি। গান্ধী হত্যার পরে যে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। গান্ধী যে বলেছিলেন, ভারতকে শুধু হিন্দুদের রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা হলে ভারতকে বস্তুত ধ্বংস করা হবে, তা-ও বাদ গেছে পাঠ্যপুস্তক থেকে।
এ তো গেল অসম্পূর্ণ এবং ভ্রান্ত শিক্ষার কথা। এর বাইরেও প্রবন্ধকার এই নিয়োগ-দুর্নীতির আবহে যে পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে তা বলতে গিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ছাত্র-ছাত্রীরা যদি জানতে পারে, তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা হয়তো বা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তা হলে তাঁরা কি শিক্ষকদের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করবেন? শিক্ষক-শিক্ষিকারা যদি নিজেদের চাকরির স্থায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিন্ত না থাকেন, তা হলে তাঁরাই বা প্রয়োজনীয় একাগ্রতা নিয়ে পড়াবেন কী করে?
এ নিয়ে ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির কোনও মাথাব্যথা আছে কি? সবাই ব্যস্ত ভোটের অঙ্ক কষতে। তাই এ রাজ্যের বিরোধী দল বর্তমান শাসক দলের শিক্ষাদুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে আগ্রহী নয়। আগ্রহ না থাকার প্রথম কারণ হল, এ ক্ষেত্রে বিজেপির অতীত কীর্তি মোটেই ভাল নয়। গুজরাত, রাজস্থানে ক্ষমতায় থেকে এই সংক্রান্ত দুর্নীতির বিভিন্ন রূপ তারা দেখিয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রদেশের নিয়োগ-দুর্নীতি এবং তার ব্যাপ্তি আজ সর্বজনবিদিত। দ্বিতীয়ত, তারা ভোট রাজনীতির কথা মাথায় রেখে রুটিরুজির প্রশ্ন থেকে নজর সরিয়ে ধর্ম রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। এই হিসাবের ঠেলায় আজ সভ্যতা-সংস্কৃতি-শিক্ষা চরম বিপদাপন্ন।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
অনুপস্থিত
সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে চলেছে রাজনীতির জল মাপার প্রতিযোগিতা। এক দিকে থাকছে তৃণমূল, অন্য দিকে বিজেপি। উভয়েরই লক্ষ্য ধর্ম ও ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি। এই সূত্রে, প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধের সমর্থনে কিছু কথা। সারা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান ও বৃদ্ধির উৎস একমাত্র হিন্দু ধর্মীয় মেরুকরণ। রাজ্যে শাসক তৃণমূলের নানা দুর্নীতি, জনজীবনের সঙ্কট নিরসনে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে বিজেপি দল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তাদের লক্ষ্য হিন্দুরা কতটা বঞ্চিত নির্যাতিত, তা খুঁজে দেখা, এবং নানা ভাবে তাদের উত্তেজিত করে হিন্দু মেরুকরণকে শক্তিশালী করা। প্রায় ছাব্বিশ হাজার চাকরি বাতিল, শিক্ষা, শিক্ষা-পরিকাঠামো বিপর্যস্ত। অথচ, বিজেপি একটা পতাকা খোলাকে কেন্দ্র করে তখন লড়াই চালাচ্ছিল ভাতের নয়, জাতের জন্য। ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে যখন মুর্শিদাবাদ জ্বলছে, দু’জন হিন্দু-সহ তিন জনের মৃত্যু হয়েছে, বিজেপির কাজ তখন ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ স্লোগান দিয়ে মেরুকরণের রাস্তাকে সুদৃঢ় করা।
মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাঁরই এক মন্ত্রীর জেলায় জেলায় প্রতিবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার বার্তা ছিল আসলে হিংসাত্মক কাজের প্ররোচনা। দলে শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি আছে। তা সত্ত্বেও তাঁকে কিন্তু সতর্ক করা হল না। এটাই তো তৃণমূল দলের বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টার জ্বলন্ত উদাহরণ। তৃণমূল, বিজেপি দলের এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্য আগামী বিধানসভার নির্বাচন। এই বিশেষ সন্ধিক্ষণে প্রয়োজন ছিল একটা বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প শক্তির। দুর্ভাগ্য, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে তা অনুপস্থিত।
সারনাথ হাজরা, হাওড়া
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)