E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: পঙ্কিল রাজনীতি

প্রশাসন দিঘার এই মন্দিরের পুজোপাঠ ইত্যাদির ভার ইসকনের হাতে অর্পণ করে সুকৌশলে এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে। যে কারণে সব ধর্মের মানুষেরই এখানে প্রবেশ অবাধ, যা ধর্মনিরপেক্ষতার এক নিদর্শন হিসাবে দাবি করতে পারে রাজ্য-শাসক দল।

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৫ ০৭:০৩

প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘মন্দির রাজনীতির রাজ্য’ (২৬-৬) প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক, যা সমগ্র দেশের জন্য উদ্বেগজনকও বটে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন কোনও মন্দিরের মূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠায় প্রধান ‘যজমান’ হিসাবে নিজেকে উপস্থাপিত করেন, তখন তাঁর ধর্মীয় আভরণে ঢাকা পড়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর পরিচয়টুকু। এমন আচরণ সাংবিধানিক ভাবে এবং গণতান্ত্রিকতার প্রশ্নেও কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে যথেষ্টই বিতর্কের অবকাশ আছে। উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্বের যে উন্মাদনা এই রামমন্দির ঘিরে লক্ষ করা যায়, সেটা আমাদের পূর্ব ভারতে অবশ্য অনেকটাই ম্রিয়মাণ। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের রাজ্যের হিন্দু বাঙালিদের ভ্রমণের স্থান হিসাবে পুরীই প্রথম দিকে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেও যখন রাজ্যবাসীর এই আবেগের কথা মাথায় রেখে রাজ্য সরকারের আনুকূল্যে দিঘার সমুদ্রের কাছে পুরীর আদলে গড়ে ওঠে জগন্নাথ মন্দির, তখন মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধেও ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রশ্ন উঠবেই।

তবে প্রশাসন দিঘার এই মন্দিরের পুজোপাঠ ইত্যাদির ভার ইসকনের হাতে অর্পণ করে সুকৌশলে এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে। যে কারণে সব ধর্মের মানুষেরই এখানে প্রবেশ অবাধ, যা ধর্মনিরপেক্ষতার এক নিদর্শন হিসাবে দাবি করতে পারে রাজ্য-শাসক দল। এই সমস্ত কাণ্ডকারখানা দেখেশুনে একটা কথাই মনে হয়, সংখ্যালঘুরা আজ বিভিন্ন দলের কাছে শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্ক হিসাবেই বিবেচিত হয়ে চলেছেন।

কাজের অভাবে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে কমছে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। অথচ মুষ্টিমেয় শিল্পপতির সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, যা সমাজের বৈষম্যকেই প্রকট করে। রাজ্যে অনেক ঘটনাকে এক প্রকার ধামাচাপা দিয়ে মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর জি কর কাণ্ড, সম্প্রতি কালীগঞ্জে শাসক দলের বোমার আঘাতে বালিকার মৃত্যু, দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজে যৌন নিগ্রহ, সমস্ত নারকীয় ঘটনাতেই নাম জড়িয়েছে শাসক দলের। বিরোধিতা করলেই তুলে ধরা হচ্ছে অতীতের ঘটনার হিসাবনিকাশ। কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রতিটি রাজ্য সরকারই শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়কে খুব একটা প্রাধান্য যে দেয় না, তা প্রত্যেক ভুক্তভোগী মানুষ জানেন। প্রায় প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে প্রায় একই রকম অপরাধ করে চলেছে। তাই প্রত্যেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এগিয়ে এসে আন্দোলনে যোগ দিতে হবে। বেকারত্ব, উন্নয়নের নামে অনুন্নয়ন, অনৈতিক কাজের প্রতিবাদকে দেশদ্রোহিতা বা সরকার বিরোধী কার্যকলাপ বলে চালিয়ে দেওয়া এবং এ সবের প্রতিবাদ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ধর্মকে সামনে রেখে সঙ্কীর্ণ রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে।

অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি

অনাচারের ঘড়া

প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘মন্দির রাজনীতির রাজ্য’ প্রবন্ধটিকে সর্বাংশে সমর্থন জানিয়ে আরও কিছু কথা জানাই। প্রবন্ধকার যথাযথ ভাবেই বলেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আজকের শাসক এবং বিরোধী দল উভয়েই হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতার রাজনীতিতে মত্ত। কিন্তু এটাও অনস্বীকার্য যে, এই রাজনীতির মূল লক্ষ্য হল যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা দখল করা।

প্রতি দিনই দেখতে পাচ্ছি যে এ রাজ্য-সহ সারা ভারত জুড়ে চলছে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, অস্থিরতা, উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের মধ্যে লড়াকু, বিদ্বেষী মনোভাব। এ সব নেতা নেত্রীরাই সৃষ্টি করছেন। আমাদের রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মিড-ডে মিল রান্না হচ্ছে দু’টি ভিন্ন হাঁড়িতে, দু’টি সম্প্রদায়ের শিশুদের পৃথক ভাবে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে স্কুলে। নিম্নবর্ণের ছাত্র পিপাসার্ত হয়ে উচ্চবর্ণের ছাত্র শিক্ষকের কলসির জল পান করলে, সেই অপরাধে তাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে অন্য এক রাজ্যে। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল বা বিরোধী দলের হিন্দুত্বে ভক্তি কিন্তু ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা পর্যন্ত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়নের ভাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এই হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতা বলেই মনে করি। উভয় দলই সরকারি-বেসরকারি কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে মন্দির নির্মাণ করছে আর মহোৎসব, ভোজ হচ্ছে সর্বত্র। অথচ হাজার হাজার শিশু ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টের জন্যও হাহাকার করছে।

এ রাজ্যে চরম দুর্নীতি ও সরকারি ব্যর্থতার ফলে এতগুলি চাকরি বাতিল হয়ে গেল, স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল কতটা করুণ সে তো দুনিয়া জেনে গেল। এক দিন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল যে, ধর্মকে সম্পূর্ণ রূপে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়া উচিত। ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের বিষয় হওয়া উচিত, ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়। তার পরিচালনা হওয়া উচিত শুধু বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিচারবুদ্ধির দ্বারা। আমাদের দেশের এই সব রাজনৈতিক নেতা প্রতি বছর ২৩ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্রের গলায় মালা দেন, অথচ নিজেদের ব্যক্তিজীবনে বা রাজনৈতিক জীবনে কোনও দিন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু-সহ মনীষীদের এই উন্নত ভাবনাকে রপ্ত করার চেষ্টা করেন না।

এই সমাজ দু’টি ভাগে বিভক্ত। এক দিকে কোটি কোটি টাকার পাহাড়ের চূড়ায় বসে থাকা মুষ্টিমেয় ধনকুবের গোষ্ঠী, অপর দিকে কোটি কোটি নিরন্ন মানুষ। ফলে এই শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় সেই মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থেই। বিজ্ঞানচেতনার অভাবে ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের অতি গভীরে বাসা বেঁধে আছে আর সেটিকে পুঁজি করে এই রাজনৈতিক নেতারা মানুষের সেই স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়কে সুড়সুড়ি দিয়ে ক্ষমতার অলিন্দে টিকে থাকতে চান। উন্নয়ন হোক আর না-ই হোক তাঁদের কিছুই আসে যায় না।

জয়দেব সরকার, দেওয়ানগঞ্জ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

জোট বেঁধে

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধীরা কি সত্যিই তৃণমূল সরকারকে উৎখাত করতে চান? হয়তো সত্যিই চান, কারণ সংবাদপত্রে, টিভিতে, সমাজমাধ্যমে তাঁদের চড়া গলায় বক্তব্য যা পড়া বা শোনা যায়, তাতে তাই মনে হয়। কিন্তু সকলে একজোট হয়ে কিছু করতে তাঁদের দেখা যায় না। এই রাজ্যের বিরোধীদের বিন্যাস এমনই, শক্তিশালী দু’পক্ষ সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর, তাদের নীতি ও ভাবনাচিন্তা সম্পূর্ণ আলাদা। আর এটাই হল এখন এ রাজ্যে তৃণমূলের টিকে থাকার মূল শক্তি।

এ রাজ্যে দীর্ঘদিন বাম রাজত্ব ছিল, বিজেপি তেমন ভাবে ঢুকতে পারেনি। কার সৌজন্যে ও প্রয়োজনে এ রাজ্যে বিজেপির প্রবেশ, সকলেই জানেন। বাংলা বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে কেন্দ্র-বিরোধী ও কিছুটা প্রাদেশিকতামিশ্রিত হিন্দি-বিরোধীও। তার দেশভাগ জনিত ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। এ রাজ্যে নির্বাচনে ভোট পড়ে বিপুল সংখ্যায়, মানুষ রাজনৈতিক ভাবে সচেতন।

ভোটে খুনোখুনি, মারদাঙ্গা এখানে স্বাভাবিক ঘটনা, আর প্রায় প্রতি দিনই খুন, মারপিট, নারী-নির্যাতন লেগেই আছে। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে রাজ্য উত্তাল হয়। পরে সব থিতিয়ে যায়। এত দুর্নীতি সত্ত্বেও বিরোধীরা এখানে কিছু করতে পারছেন না কারণ তাঁরা জোট বাঁধেন না কিছুতেই।

ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণ সব বিরোধীকে একজোট করে ইন্দিরাকে গদি থেকে সরিয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জগদ্দল পাথরের মতো বামফ্রন্টকে উৎখাত করতে সব বিরোধীকে এককাট্টা করেছিলেন। তেমনই এখন তৃণমূল সরকারকে অপসারিত করতেও রাম-বাম সকলের একজোট হওয়া প্রয়োজন।

অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Digha Jagannath Temple Digha Jagannath Mandir Mamata Banerjee West Bengal government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy