‘পিছনের বেঞ্চি’ (১৮-৭) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে কিছু কথা। সংবাদে প্রকাশ, মালদহের ইংলিশবাজারে শতাব্দীপ্রাচীন বার্লো গার্লস হাই স্কুল সম্প্রতি ‘সামনের বেঞ্চি’ আর ‘পিছনের বেঞ্চি’র দ্বন্দ্ব মিটিয়ে পড়ুয়াদের শ্রেণিকক্ষে অর্ধবৃত্তাকারে বসার ব্যবস্থা করেছে। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা পড়ুয়াদের বসার নিয়ম ভেঙে নতুন গণতান্ত্রিক বসার ব্যবস্থা রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে পড়ুয়াদের গোল হয়ে মাস্টারমশাইকে ঘিরে বসে পঠনপাঠনের দৃষ্টান্তকে স্মরণ করায়। আমি এক জন স্কুলশিক্ষক। আমরা শিক্ষকেরা বেশির ভাগ সময়ই প্রচলিত নিয়মের দাসত্বে বন্দি থাকি। শ্রেণিকক্ষে প্রতি দিন দেখি কিছু দুষ্টু ও পাঠে অমনোযোগী ছাত্র নিরাপদ বসার স্থান হিসেবে পিছনের বেঞ্চ বেছে নেয়। তুলনায় শিষ্ট ও মেধাবী ছাত্ররা সামনের বেঞ্চ দখল করে বসে এবং শিক্ষকের বেশি মনোযোগ পায়। শিক্ষকের পাঠ শোনা এবং বোর্ডের লেখা ও আঁকা দেখতেও তাদের বেশি সুবিধা হয়। শেখার ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে যায়।
গত বছর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায় ভিনেশ বিশ্বনাথ পরিচালিত মালয়ালম চলচ্চিত্র স্থানার্থী শ্রীকুট্টন। এই ছবিতে সপ্তম শ্রেণির পিছনের বেঞ্চের ছাত্র শ্রীকুট্টন সামনের বেঞ্চের এক ছাত্রের বিরুদ্ধে স্কুল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং স্কুলের এক বিজ্ঞান সেমিনারে ছাত্রদের বসার ভিত্তিতে বিভাজন ঘুচিয়ে অর্ধবৃত্তাকারে সমত্বসূচক বসার ব্যবস্থা করে। চলচ্চিত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত শ্রীকুট্টনের সব শিক্ষার্থীকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার ভাবনাকে স্বীকৃতি দিয়ে শ্রেণিকক্ষেও অনুরূপ বসার ব্যবস্থা করেছিল। এই চলচ্চিত্রটির গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে কেরলের পরিবহণমন্ত্রী কে বি গণেশকুমারের উদ্যোগে কোল্লাম শহরের দু’টি স্কুলে পরীক্ষামূলক ভাবে দেখা হয় বাস্তবে সেটি কতটা সুফলদায়ক। তার পর কেরল, তামিলনাড়ু, দিল্লি ও বাংলার কিছু স্কুলও পড়ুয়াদের অর্ধবৃত্তাকারে বসার ব্যবস্থা করেছে। পড়ুয়ারাও খুশি বসার এই নতুন ব্যবস্থায়।
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
তাচ্ছিল্য নয়
‘পিছনের বেঞ্চি’ সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। স্থানার্থী শ্রীকুট্টন-এর শেষ দৃশ্যটি অনেকের মনে গেঁথে গিয়েছে, যেখানে পড়ুয়াদের বসার বেঞ্চগুলি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সারির পরিবর্তে ‘ইউ’ আকারে সাজানো ছিল। মাঝের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে শিক্ষকমশাই পড়াচ্ছেন। কেরলের বেশ কিছু অঞ্চলে এ ভাবেই ক্লাস করানো হচ্ছে। মালদহের ইংলিশবাজারে বার্লো গার্লস হাই স্কুলও সারিবদ্ধ বসার ধরন পাল্টে পড়ুয়াদের অর্ধবৃত্তাকারে বসার ব্যবস্থা করেছে, যার ফলে সকল শিক্ষার্থী সমান ভাবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারছে। শুধুমাত্র বসার আসন বিন্যাসের কারণে কেউ ‘লাস্ট বেঞ্চার’ বা কেউ ‘ফার্স্ট বেঞ্চার’ অথবা কেউ ভাল, কেউ খারাপ— এই রকম তকমা সেঁটে দেওয়ার জায়গা আর থাকল না, যা শিশুমনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই আশা। প্রচলিত ক্লাসরুম ব্যবস্থায় মাঝের বা পিছনের সারির অনেক পড়ুয়া শিক্ষকের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। ফলে পাঠদানের সময় তারা অমনোযোগী হয়ে পড়ে। এক সময় তারা পিছিয়ে-পড়া পড়ুয়া হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লোটাকম্বল উপন্যাস শুরুই হয়েছিল একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকমশাইয়ের প্রচলিত নিয়মে ক্লাস নেওয়ার ধরন দেখিয়ে। স্বামী বিবেকানন্দ, যুগাবতার রামকৃষ্ণ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, হুড়হুড় করে একগাদা নাম উচ্চারণ করতে করতে প্রধানশিক্ষক রবীন্দ্রনাথে এসে স্তব্ধ হয়ে যেতেন। চোখ ছলছলে হয়ে উঠত। তার পর চটকা ভেঙে শেষ বেঞ্চের কোণের দিকে বসে থাকা শম্ভু সাঁতরার দিকে কটমট করে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াতে বলতেন। শম্ভু কলের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াত। তার পর তাকে ইংরেজি করতে বলা হত— রামেরা দুই ভাই। ইংরেজি করতে না পারার জন্যে সেই সময়ে তাদের কপালে কী জুটত, তা সহজেই অনুমেয়। ঘটনাটি ব্যাকবেঞ্চারদের প্রতি সহপাঠীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের তাচ্ছিল্য বুঝিয়ে দেয়।
প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম থাকে, যাতে সকলে একই পোশাক পরলে তাদের মধ্যে একতা ও সমত্বের বোধ আসে। পঙ্ক্তি করে মিড-ডে মিল খাওয়ার কারণও একই। একই ভাবে পড়ুয়াদের বসার বেঞ্চগুলি অর্ধবৃত্তাকারে সাজানো হলে সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান ভাবে গুরুত্ব আরোপের সুযোগ থাকে।
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
সৃষ্টিশীল চিন্তা
রাজ্যে সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে যেখানে দুর্বল পরিকাঠামো এবং নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা, সেখানে এ রকম পরিস্থিতিতে মালদহের প্রাচীন স্কুলটির পড়ুয়াদের শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণে কিছু করে দেখানোর উদ্যোগ যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। স্কুল ভবনের পলেস্তারা খসে পড়া, জরাজীর্ণ শ্রেণিকক্ষ, ভগ্নপ্রায় চেয়ার-বেঞ্চ-টেবিল, খেলার মাঠের অভাব, ছাত্রসংখ্যা হ্রাস, শিক্ষকের অভাব, সহায়ক সরঞ্জামের অভাব, অপর্যাপ্ত স্কুল ফান্ড— এ সবই রাজ্যের সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলগুলির বাস্তব চিত্র। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি নানা কাজে স্কুলশিক্ষকদের যুক্ত করা ও সরকারের স্কুল ছুটি সংস্কৃতি।
পড়ুয়াদের মধ্যে পাঠের প্রতি আগ্ৰহ ও আকর্ষণ তৈরি করার সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনাও আজকাল শ্রেণিকক্ষে তেমন পরিলক্ষিত হয় না। সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে পরিকাঠামোর উন্নয়ন, সরকারি অনুদান বৃদ্ধি, মধ্যাহ্নকালীন আহারে যথাসম্ভব বরাদ্দ বৃদ্ধি, স্কুলগুলিতে শ্রেণিশিক্ষা যথাযথ ভাবে হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য সরকারি শিক্ষা দফতরের নিয়মিত নজরদারি ভীষণ জরুরি। বার্লো গার্লস হাই স্কুলের এই সৃষ্টিশীল ও অভিনব উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গে বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র। তবে স্কুলগুলির সার্বিক উন্নয়নে সরকারের সদর্থক ও কার্যকর ভূমিকা এই ধরনের প্রয়াসকে আরও বেশি উৎসাহিত করবে।
হারান চন্দ্র মণ্ডল, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
দরদি শিক্ষক
‘পিছনের বেঞ্চি’ সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে বলি, শ্রেণিকক্ষের সব সমস্যাই কি এই নিয়মে মেটানো সম্ভব? নানান কারণে বহু স্কুলে গিয়ে দেখেছি এখন দু’রকম ইউনিফর্ম। এক দিকে সরকারি ইউনিফর্ম, অন্য দিকে এত কালের ঐতিহ্য বহনকারী বিদ্যালয়ের নিজস্ব ইউনিফর্মও শোভা পাচ্ছে। জানতে পারি, পড়ুয়ারা মানসিক ভাবে স্বচ্ছন্দ বোধ করে বিদ্যালয়ের নিজস্ব ইউনিফর্মেই। দ্বিতীয়ত, আজ অধিকাংশ স্কুলে ছাত্রসংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকলেও কিছু কিছু স্কুলে এক-একটি সেকশনে আশি-নব্বই জন পড়ুয়াও আছে! সেখানে অর্ধবৃত্তাকারে বসা সম্ভব কি? সব পড়ুয়া উপস্থিত হলেই সেখানে বসার জায়গা হয় না। সেই পরিস্থিতিও ভাবতে হবে। তৃতীয়ত, অনেক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের সামনে, বাম ও ডান দিকে দুটো করে বেঞ্চ রাখলে সর্বসাকুল্যে ৩০ জন বসতে পারে। কিন্তু অতীতে নির্মিত সেই সব শ্রেণিকক্ষে এমন সমস্যার সমাধান দুরূহ। চতুর্থত, প্রথম বা দ্বিতীয় বেঞ্চের ছাত্র মানে প্রথম সারির, এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। অনেক শিক্ষক রোল নম্বর অনুযায়ী ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বসাতেন। অনেকে আবার পিছনে বসা অমনোযোগী ছাত্রদের সামনের বেঞ্চে বসার নির্দেশ দিতেন। তাদের মনিটর করে দেওয়ারও ব্যবস্থা হত।
আসলে সহমর্মিতা চাই, তদারকি চাই, কিন্তু সরকারই তো চাইছে না। তাদের সদিচ্ছার বড় অভাব! তাই আজ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তানরা বেসরকারি স্কুলমুখো হতে শুরু করেছে। তবুও আমরা বিশ্বাস করি দরদি শিক্ষকরা আজও আছেন। তাঁরা দায়বদ্ধতা, সহমর্মিতা নিয়ে আজও কর্তব্য পালন করে থাকেন।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)